বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বোরো ধানে বস্নাস্ট রোগের আক্রমণ দিশেহারা কৃষক

স্বদেশ ডেস্ক
  ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম ও বাজিতপুরে বস্নাস্ট রোগে আক্রান্ত বোরো ক্ষেত -যাযাদি

কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের হাওড় এলাকার একমাত্র ফসল বোরো ধানে চলতি মৌসুমে বস্নাস্ট রোগের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। এ রোগে ধান চিটা হয়ে ঝরে পড়ছে। একমাত্র ফসলের এ দুর্দশা দেখে দিশেহারা হওড়াঞ্চলের কৃষকরা। তাদের অভিযোগ, এখনো কৃষি অফিস থেকে কেউ সরেজমিন পরিদর্শন করেননি। ক্ষতির পরিমাণের তালিকা নেই স্থানীয় কৃষি অফিসের কাছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-

হাওরাঞ্চল প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের হাওড় উপজেলা অষ্টগ্রামে বোরো জমিতে বস্নাস্ট রোগের কারণে দেখা দিয়েছে চিটা। ফলে উপজেলার বহু কৃষক মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বলে জানা গেছে। এদিকে এমন মারাত্মক সময়ে দেখা পাওয়া যাচ্ছে না স্থানীয় কৃষি অফিসের লোকজনদের বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।

হাওড় অধু্যষিত এ উপজেলার অধিকাংশ আবাদি জমিতেই বোরো আবাদ হয়ে থাকে। এমনিতেই উপজেলার জমিগুলো অধিকাংশই নিমাঞ্চল হওয়ায় এবং নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে প্রায়ই কয়েক বছর পর পর ধান কাটার মৌসুমে আগাম বন্যায় ফসল তলিয়ে যায়। তখন ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কৃষকদের পথে বসতে হয়। এর মধ্যে এবার নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে বোরো ধানের বস্নাস্ট রোগ।

বিস্তীর্ণ এই হাওড় উপজেলার আব্দুলস্নাহপুর হাওড়, আদমপুর, কলমা, কাস্তুলের হাওড়, পূর্ব অষ্টগ্রামের হাওড়, সদরের বড় হাওড়, বাংগাল পাড়ার নোওয়া গাওয়ের হাওড়, দেওঘরের হাওড়সহ বেশ কয়েকটি হাওড়ের একাধিক কৃষক জানান, আর মাত্র কয়েক দিন পরে ঘরে ধান তোলা হতো। এ সময় উপজেলার কয়েক শত একর বোরো জমিতে বস্নাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। এতে লোকসানের মুখে পড়বেন কৃষকরা।

সদর ইউনিয়নের কলাপাড়ার বাসিন্দা ষাটোর্ধ বয়সি কৃষক মেনু মিয়া বলেন, তিনি পূর্ব অষ্টগ্রামের খাওরাইলের হাওড়ে ১৫০ শতাংশ জমিতে ব্রি-ধান ২৮ জাতের বোরো ধান চাষ করেছিলেন। সেই জমিতে তার ৮০-৯০ মণ ধান পাওয়ার কথা। কিন্তু বস্নাস্টের কারণে বর্তমানে ১০-১৫ মণ ধানও পাবেন কি না সন্দেহ প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য কৃষি অফিসের লোকজনের দেখাও পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন তিনি।

খয়েরপুর-আব্দুলস্নাহপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন খান জানান, তার ইউনিয়নের প্রতিটি হাওড়ে কি রোগ হয়েছে জানেন না। তবে ব্রি-২৮ জাতের ধান যারা চাষাবাদ করেছিলেন তারা একমুঠো ধানও কাটতে পারবেন না। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে অষ্টগ্রাম উপজেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ১০০ হেক্টর জমি। আবাদ হয়েছে ২৪ হাজার ১১০ হেক্টর।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অভিজিৎ সরকার বলেন, উপ-সহকারীদের বলা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করার জন্য। তবে এখন পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারেননি। এখন মাঠে সবাই আছে। যদি কেউ মাঠে না থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক আব্দুস সাত্তার বলেন, ব্রি-২৮ জাতের ধানে কিছু সমস্যা হয়েছে। এখনো কৃষকদের নিয়ে ইটনার হাওড়ে আছেন অষ্টগ্রামের বিষয়টি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে দেখবেন।

বাজিতপুর (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার ১১ ইউনিয়নে এ বছর বিআর-২৮ ধানে বস্নাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে ধানি জমিগুলি সাদা হয়ে গেছে। অন্তত কয়েক হাজার একর জমি নষ্ট হওয়ার কারণে স্থানী কৃষকদের মাথায় হাত পড়েছে। হাওড়ের কৃষকরা বিআর-২৮ ধান কিছুদিন পর কাটার কথা থাকলেও এখন বস্নাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে জমিগুলো খড়ের জন্য কেটে নিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। অনেক কৃষক মহাজন ও বিভিন্ন এনজিও থেকে সুদে টাকা এনে জমির জন্য প্রস্তুত করলেও এখন তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

শুক্রবার সকালে দিঘিরপাড় ইউনিয়নের নদীর ওই পাড়ের বাইগুনের টেক কোম্পানি বাড়ির হাওড়ের বিআর-২৮ বস্নাস্ট রোগ হয়ে যাওয়ায় ধানি জমি গুলির কৃষক আকাশ দাস, সন্তুষ দাস, সজিব দাস, মন্টু দাস, টিটু লাল দাস, প্রভু রঞ্জন দাস, জুয়েল দাস, তপন দাস, রতন দাস, নিশি লাল দাস, হেম লাল দাস, খোকন দাস, বিনুদ দাস, বাবুল দাস, রাজেন্দ্র দাস, নির্মল দাস, অবিনাশ দাস, সত্য বান দাস, সঞ্জিত দাসসহ অনেক কৃষক এ প্রতিবেদককে বলেন, এ হাওড়ের প্রায় একশ' একর জমি বস্নাস্ট রোগ হয়ে ধানের গাছ গুলো সাদা হয়ে গেছে। হাওড়ের একমাত্র ফসল নষ্ট হওয়ায় মহাজনের সুদ, ব্যাংক ও এনজিও ঋণের টাকা হয়তো তাদের দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। আছানপুর গ্রামের নদী বেষ্টিত কৃষকরা ঘোড়াউত্রা নদীর কড়াল গ্রাসে তাদের বসতঘর হারাচ্ছেন। এরপরেও তাদের শেষ আশা ছিল এ বছর ধান পেলে হয়তো ব্যাংক ও এনজিও ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন। কিন্তু তাদের আশা যেন একেবারেই নিরাশায় পরিণত হয়েছে। ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার স্বরবিন্দু দাস বলেন, তিনি নিজেও বিআর-২৮ ধান করেছেন। তিনিও এখন নিরাশার মধ্যে আছেন। পরিবার নিয়ে কীভাবে চলবেন তার কোনো উপায় দেখছেন না। দিঘিরপাড় ইউনিয়ন উপসহকারী কর্মকর্তা মুছলেহ উদ্দিন বলেন, বিআর-২৮ ধানে বস্নাস্ট রোগ হওয়ার কারণে হাওড়ের কৃষকরা বেকায়দায় পড়েছেন। এ জমিগুলোতে এ রোগ হওয়ায় কৃষক অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মধ্যনগর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার হাওড়গুলোতে বৈশাখের সোনালী ফসল বোরো ধান গাছে বস্নাস্ট রোগের আক্রমণে শুকিয়ে যাচ্ছে ধানের শীষ, কৃষক হয়ে পড়ছে দিশেহারা। রোগটির আক্রমণে দেখা গেছে গাছের গোড়া থেকে কালো হয়ে, ধীরে ধীরে গাছটি মরে যায় এবং রোগের পাদুর্ভাবে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান বিনিষ্ট হতে চলছে। এতে ব্যাপক ফসল হানির ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।

প্রায় এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ বস্নাস্ট রোগের পাদুর্ভাব দেখা গেছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ধান ক্ষেতে। আক্রান্ত জমি থেকে ধীরে ধীরে রোগটি বিস্তারলাভ করে এবং আশপাশের জমিগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে এ রোগ। এ অবস্থায় সাড়া বছরের একটি মাত্র ফসলে দেখা দিয়েছে বিঘ্ন। এতে এলাকার কৃষক হয়ে পড়ছেন উদ্বিগ্ন ও দিশেহারা। মধ্যনগর উপজেলার ছোট ঘোরাডোবা ও বড় ঘোরাডোবা হাওড়ে ৩৭৪ হেক্টর জমিতে ব্রি ২৮-২৯-৮৮-৮৯-এবং বিভিন্ন জাতের হাইব্রিড ধান আবাদ করেছেন কৃষকরা। কিন্তু ধান পাকা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ করেই বস্নাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে উপজেলার সবকটি হাওড়ে। বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ ছিটিয়েও কোনো কাজ হয়নি। এতে ফলনের ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে কৃষকরা আশঙ্কা করছেন।

উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামের কৃষক মো. হবিমিয়া বলেন, তার ব্রি ২৮ ধানে বস্নাস্ট রোগ আক্রমণ করেছে। অনেক ওষুধ ছিটিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না।

একাধিক কৃষক বলেন, শুরুর দিকে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বোরো আবাদে তেমন কোনো রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়নি। কৃষকরা ভালো ফলনের আশা করেছিল। ধান এখন পাকতে শুরু করেছে। এরমধ্যেই বস্নাস্ট রোগের আক্রমণ হওয়ায় ফসলের ক্ষতির পরিমাণ কি হবে এখনো নির্ণয় করা যাচ্ছে না।

মধ্যনগর উপসহকারী কৃষি অফিসার কবীর হোসেন বলেন, ব্রি ২৮ ধান চাষাবাদে এ বছর নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু এরপরেও কৃষকরা চাষাবাদ করেছে। বস্নাস্ট রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তিনি ২ মাস আগেই কৃষকদের ট্রিটমেন্ট দিয়েছেন। যারা ট্রিটমেন্ট অনুযায়ী ওষুধটি ব্যবহার করেছেন তারা উপকৃত হয়েছেন। যারা ব্যবহার করেননি তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখনো ওষুধ স্প্রে করলে রোগ দমনে অনেকটা উপকার পাওয়া যাবে।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, এখন পর্যন্ত খুব একটা আতংকের কিছু নেই, প্রতি বিঘায় ট্রুপার ৭৫ ডবিস্নউপি ১২ গ্রাম ১৬ লিটার পানি স্প্রে করলে বস্নাস্ট রোগের আক্রমণ ঠেকাতে পারে। প্রথম ডোজ দেওয়ার ১০ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। কিন্তু কৃষকরা কৃষি অফিসের পরামর্শ মেনে চলেন না। তারা তাদের মতো করে কাজ করার চেষ্টা করেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মীর হোসেন আল বান্না বলেন, হঠাৎ করে আবহাওয়া পরিবর্তন, রাতে ঠান্ডা দিনে গরম ঘুড়ি ঘুড়ি বৃষ্টি কিংবা ঝড় হওয়ার কারণে কিছু জমিতে বস্নাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতি ইউনিয়ন পরিষদে কৃষক সমাবেশ করেছেন এবং রোগবালাই প্রতিরোধের জন্য লিফলেট বিতরণ করেন। অথচ কৃষি পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধটি ব্যবহার করেনি কৃষকরা। এখনো ব্যবহার করলে রোগবালাই থেকে রক্ষা পাবে কৃষক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে