রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভাটার আগুনে জ্বলছে কৃষিজমির টপ সয়েল

জেলা প্রশাসনের জিরো টলারেন্স উদাসীন স্থানীয় প্রশাসন
ইমরান হোসাইন লিখন, বগুড়া
  ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বগুড়ায় এভাবেই ভেকু মেশিন দিয়ে কাটা হচ্ছে ফসলি জমির 'টপ সয়েল' -যাযাদি

পৃথিবীতে সব প্রাণের ভিত্তি হচ্ছে মাটি। আমাদের খাবারের পঁচানব্বই শতাংশ আসে মাটি থেকে। এই মাটি তথা টপ সয়েল বা ওপরের স্তরের উর্বর মাটি বছরের পর বছর চেষ্টা করেও এক ইঞ্চি তৈরি করার সাধ্য নেই আমাদের। অর্থাৎ কৃত্রিম উপায়ে কোনোভাবেই টপ সয়েল তৈরি করা সম্ভব নয়। মৃত্তিকা গবেষকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী কোনো স্থান থেকে টপ সয়েল সরিয়ে নিলে ওই স্থানে টপ সয়েল তৈরি হতে অন্তত ৫০ বছর সময় লাগবে। তারপরও হাজার হাজার বছরের সৃষ্ট এই টপ সয়েল তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিনিয়ত অতি সহজেই ভূমিদসু্যদের হিংস্র থাবায় এবং এই মাটিখেকোদের কৌশল ও ভয়ে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে মাত্র কিছু অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিয়ত শত-শত একর জমির টপ সয়েল বিক্রি করছে। যা ব্যবহার হচ্ছে ইটভাটায়।

বিভিন্ন সময় থানা ও উপজেলা প্রশাসন বরাবর ভুক্তভোগীরা আবেদন করলে তাদের পড়তে হয় মহাবিপদে। কারণ প্রশাসন ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিযোগকারীদেরই ঘটনাস্থলে হাজির করে। এরপর অভিযুক্তদের সামনেই ঘটনার বিবরণ শুনে থাকে। এসব কারণে ঘটনাস্থল থেকে প্রশাসন চলে যাওয়ার পর থেকেই তাদের ওপর নেমে আসে প্রভাবশালীদের নানা ধরনের অত্যচার ও মিথ্যা মামলা-হামলা। এই সময়গুলোতে প্রশাসনের আর কোনো সহযোগিতা পায় না ভুক্তভোগীরা। এ ছাড়া প্রশাসনের মধ্য থেকেই আবার কিছু অসাধু কর্মচারী ও কর্মকর্তা যারা এসবের পেছনের হাত। তারা প্রভাবশালী এই অবৈধ ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে ও অভিযোগকারীদের নাম বলে দেয়। এসব কারণে প্রশাসন বরাবর আর তেমন কোনো অভিযোগ করতে দেখা যাচ্ছে না ভুক্তভোগীদের।

অন্যদিকে উপজেলা প্রশাসনের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, অভিযোগ না করলে তারা কিভাবে জানবে কোথায় এসব অনিয়ম হচ্ছে। প্রশাসনের এমন কথায় হতবাক ভুক্তভোগী, সাধারণ মানুষ ও সচেতন মহল। তারা বলেন তাহলে প্রশাসনের কাজ কি জেলার সোনাতলা উপজেলার দীগদাইড় ইউনিয়নের কাতলাহার এলাকায় গেলে দেখা যায়, প্রতিনিয়ত একাধিক ট্রাকে শতাধিকবার টপ সয়েল ও মাটি নিয়ে যায় ইটভাটায়। এতে করে রাস্তাটি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে আশপাশের বাড়িগুলো দেবে ও হেলে যেতে শুরু করেছে।

একটু এগোতেই এলাকাবাসীর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। কারণ ঘটনাস্থলে যাওয়ার একটু আগেই দুইজন ব্যবসায়ী এসে বলেন- 'ওদিকে যেয়ে কি করবেন, এখানেই কথা বলি।' এ সময় বারিউল রুমি নামে এক ব্যবসায়ী বলেন প্রতিনিয়তই এখানে সাংবাদিক আসে, আপনাদের কিভাবে সম্মান করতে হবে বলেন।

ঘটনাস্থল থেকে এসব বিষয় বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামকে জানালে তিনি তাৎক্ষণিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দ্রম্নত ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু প্রায় তিন ঘণ্টা পার হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে বিষয়টি সোনাতলা থানার অফিসার ইনচার্জ বাবু সাহাকে জানালে তিনি কয়েকজন পুলিশ পাঠিয়ে দেন। কিন্তু পুলিশের এসআই ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের কাছে টাকা নেওয়ার প্রমাণ চান। এতে বোঝা যায়, এসব কারণেই প্রশাসনের কাছে অভিযোগের প্রবণতাও কমে গেছে।

এসব বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাবেয়া আসফার সায়মার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা এখানে এসে কাউকে পাইনি। তাই এস্কেভেটরের ব্যাটারি খুলে নেওয়া হয়েছে এবং এস্কেভেটরটি স্থানীয় ইউপি সদস্যের জিম্মায় দেওয়া আছে। এ বিষয়ে একটি নিয়মিত মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

জেলার প্রত্যেক উপজেলা ঘুরে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে শাজাহানপুর ও সোনাতলা উপজেলায়। অর্থাৎ এই দুই উপজেলার প্রশাসন সবচেয়ে উদাসীন। সোনাতলা উপজেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যনুযায়ী ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৬টি স্থানে মোবাইল কোর্টে জরিমানা করা হয়েছে।

দেশে একদিকে খাদ্য চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে অন্যদিকে প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে খাদ্য উৎপাদনের জন্য উর্বর জমি। পৃথিবী তথা দেশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সম্পদ টপ সয়েল। কিন্তু বগুড়ায় প্রতিনিয়ত এই সম্পদ, প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে চিতায় নিয়ে পুড়িয়ে ইট তৈরি করতে থাকলেও এ বিষয়ে তেমন কোনো গুরুত্ব দেখা যায় না।

উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগে মোট ইটভাটা রয়েছে ৯৮২টি। এর মধ্যে বগুড়ায় রয়েছে ১৯৩টি। এগুলোর মধ্যে পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে মাত্র ১৪টির অন্য সবগুলোই অবৈধ। রংপুর বিভাগে রয়েছে মোট ৯৫৩টি এর মধ্যে বৈধ ভাটা ১৩৫টি। আবার শুধু রংপুর জেলায় ইটভাটা রয়েছে ২৪২টি এর মধ্যে বৈধ ভাটা মাত্র ২৯টি। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মতলুবর রহমান বলেন, 'আমাদের সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে যাচ্ছি টপ সয়েল রক্ষার জন্য। কৃষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী আমরা এসব বিষয় প্রশাসনকে অবগত করি এবং সে অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।'

বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আমরা এই টপ সয়েল কাটার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে এর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। প্রত্যেকটা উপজেলা প্রশাসনকে কঠিনভাবে বলে দিয়েছি যেন কোনো অবস্থাতেই এই টপ সয়েল কাটা না হয়।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে