সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ভুট্টা-টমেটো ও বোম্বাই মরিচে লাভবান কৃষক

স্বদেশ ডেস্ক
  ০৮ মে ২০২৪, ০০:০০
ভুট্টা-টমেটো ও বোম্বাই মরিচে লাভবান কৃষক

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে এবার ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়েছে। সেই সঙ্গে ভালো দাম পেয়ে খুশি কৃষক। এদিকে গাজীপুরের কালীগঞ্জে টমেটো চাষে সফলতার মুখ দেখেছেন কৃষক। তাই দিন দিন স্থানীয় অনেক কৃষক টমেটো চাষে ঝুঁকছেন। অন্যদিকে পিরোজপুরের নেছারাবাদে বোম্বাই মরিচে লাভের মুখ দেখছেন একজন উদ্যোক্তা। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-

ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে চারটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার কৃষকরা রবি মৌসুমে ধানের পাশাপাশি সমপরিমাণ জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর ভুট্টার বাম্পার ফলন ও দাম পেয়ে খুশি তারা।

জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল ও নদীর তীরবর্তী এলাকায় রবি মৌসুমে চাষ করা ভুট্টা ঘরে তুলতে কৃষকেরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। এদিকে অনেক জমিতে ভুট্টার পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত কৃষকরা। তবে নদী ও বিভিন্ন নিচু এলাকায় চাষকৃত রবি মৌসুমের ভুট্টা ঘরে তুলতে চাষিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। বর্তমানে জমি থেকে ভুট্টা ভাঙ্গা, মাড়াই, শুকানো ও বাজারজাতের কাজ চলছে।

উপজেলার বুলাকীপুর ইউনিয়নে কালুপাড়া গ্রামের নিরঞ্জন সরকার বলেন, অন্য ফসলের তুলনায় ভুট্টার চাষে খরচ ও শ্রম কম লাগে, ফলন এবং দামও বেশি পাওয়ায় ভুট্টা চাষে আগ্রহ বাড়ছে। এ বছর পোকা-মাকড়ের আক্রমণ এবং রোগবালাই খুবই কম ছিল। এ ছাড়াও আগে যেসব জমিতে বোরো চাষ করা হতো সেসব জমিতে কৃষকরা এ বছর ভুট্টার চাষ করেছেন।

উপজেলার পালশা ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের আবু সায়াদ চৌধুরী জানান, গত বছর একরপ্রতি ৯০ থেকে ১০০ মণ ভুট্টা হলেও এ বছর একর প্রতি ১৩০ থেকে ১৫০ মণ পর্যন্ত ফলন হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় বেশি। গত বছর প্রতি মণ ভুট্টা ৭২০ থেকে ৭৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। চলতি বছরে ৮৫০ থেকে ৯৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রফিকুজ্জামান জানান, এ বছর উপজেলায় ১ হাজার ৯২৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ করা হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় বেশি। অক্টোবর মাসের ১৬ তারিখ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত রবি মৌসুমের ভুট্টা চাষ করা যায়। এ পরিমাণ জমিতে চলতি মৌসুমে ২৪ হাজার ৫৪৪ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের পরামর্শসহ নানাভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।

কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, প্রতি বছরই বিভিন্ন জাতের বাহারি সবজি চাষে বেশি মুনাফা অর্জন করলেও এবার আগাম ও উচ্চ ফলনশীল জাতের টমেটো চাষে বাজিমাত করেছেন গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরসাদী ইউনিয়নের দক্ষিণবাগ গ্রামের কৃষক ফিরোজ মিয়া (৪৫)। ইতোমধ্যে লক্ষাধিক টাকার টমেটো বিক্রি করেছেন। আরও লক্ষাধিক টাকার টমেটো বিক্রি করবেন বলে তিনি আশাবাদী। উন্নত জাত, সঠিক পরিচর্যা ও কৃষি অফিসের আন্তরিকতা থাকলে কৃষকের ভাগ্য বদলাতে পারে এমন প্রত্যাশা তার।

জানা গেছে, উচ্চ ফলনশীল জাতের টমেটো খেতে বেশ সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। তার দামও রয়েছে বেশ ভালো। ফলে কৃষকরা অসময়ের টমেটো চাষে ঝুঁকছেন। কৃষক ফিরোজ মিয়া পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারের মতো এক বিঘা জমিতে মালচিং পদ্ধতিতে সামার টমেটো চাষ করে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন। তিনি চারাগুলো উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় সংগ্রহ করেন। চারা রোপণের ৪৫ দিন অতিবাহিত হওয়ার আগেই গাছে ফুল ও ফল আসায় বেশ উৎফুলস্ন কৃষক ফিরোজ।

কৃষক ফিরোজ জানান, এক বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে সামার টমেটোর চাষ করেছেন। এতে তিনি মালচিং পেপার ছাড়াও পোকা-মাকড় আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ইয়েলো ট্রেপ, চেরানং, গাছের গঠন ঠিক রাখতে বাঁশের খুঁটি, রশি, সুতা, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণে নেট মাচা ব্যবহার করেছেন। এতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ১ লাখ টাকা। তবে ফলন দেখে খরচের কয়েক গুণ টাকা তিনি লাভের প্রত্যাশা করছেন।

তাকে দেখে আগামী বছরে এই উচ্চ ফলনশীল জাতের টমেটো চাষ করবেন বলে জানান একই গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব দুলাল মিয়া, ত্রিশোর্ধ্ব মিজান মিয়া ও মাসুম মিয়া। তবে এমন উন্নত জাতের বিষয়ে কৃষকের সঙ্গে কৃষি অফিসকেও এগিয়ে আসতে হবে এমন দাবি আগ্রহী কৃষকদের।

সরেজমিন দেখা যায়, পরিত্যক্ত অনাবাদি জমিতে সামার টমেটোর চাষ করা হয়েছে। মালচিং পেপার ব্যবহার করায় আগাছা নেই বাগানে। ফলে টমেটো গাছগুলো বেশ পরিপক্ব হয়েছে। প্রায় প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে কাঁচা-পাকা টমেটো।

উপজেলার বাহাদুরসাদী বস্নকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস আসমা জানান, জমিকে উত্তমভাবে তৈরি করে প্রয়োজনীয় জৈব ও রাসায়নিক সার মিশিয়ে বেড তৈরি করে সেখানে বীজ বপন করতে হয়। তারপর সে বেডগুলো মালচিং পেপার দিয়ে ঢেকে দিতে হয়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফারজানা তাসলিম বলেন, মালচিং পদ্ধতিতে উচ্চ ফলনশীল এই টমেটো জাতটি ফলনও ভালো দেয় এবং বাজারে এটির চাহিদা ও দাম দুটি বেশি। যে জমিটিতে এ টমেটো চাষ করা হয়েছে জমিটি ছিল পতিত জমি। প্রথমবারের মতো এ জমিতে মালচিং পদ্ধতিতে টমেটো চাষ করে বাজিমাত করেছেন স্থানীয় কৃষক ফিরোজ। তাকে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা করা হয়েছে।

নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) প্রতিনিধি জানান, বোম্বাই মরিচ, শুনলেই মনে হয় এটি বোম্বে থেকে এসেছে। আসলে এই বোম্বাই মরিচের চাষ আমাদের দেশেই হয়ে থাকে। আমাদের দেশে বোম্বাই মরিচের চাহিদা প্রচুর। এই মরিচের সুঘ্রাণ এতটাই, যা মানুষকে মুগ্ধ করে। এই মরিচের চাষ বাণিজ্যিকভাবে ছাড়াও দেশের গৃহস্থরা বাড়ির আঙিনায় এই মরিচ গাছ রোপণ করে থাকেন। শাকসবজিতে এই মরিচ প্রচুর ব্যবহার করা হয় স্বাদ ও ঘ্রাণের জন্য। তাছাড়া বর্তমানে দেখা যায় এই মরিচ বিভিন্ন হকারও ব্যবহার করে থাকেন তাদের ব্যবসায়।

এই মরিচ চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে লেখাপড়া শেষ করে চাকরির পেছনে না ঘুরে কৃষির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন নেছারাবাদ উপজেলার সুটিয়াকাটি ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. আশিক আহমেদ। প্রথমে তিনি পরীক্ষামূলক ৩৩ শতাংশ জমির ওপরে বোম্বাই মরিচ চাষ করেন। মরিচ বাগানের পরিচর্যার জন্য নিজেই মনোনিবেশ করেন। তার ওই মরিচ বাগানে বাম্পার ফলনে তিনি হন লাভবান। পরবর্তীতে আশিক আহমেদ আরও ৩৩ শতাংশ জমি নিয়ে মোট দুই বিঘা সম্পত্তির ওপরে মরিচসহ ড্রাগন, সাম্বা কাঁচা মরিচ ও আদার চাষ শুরু করেন। বর্তমানে তার এই কৃষির উৎপাদন দেখে গ্রামের অনেক যুবকই চাকরির কথা ভুলে কৃষি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।

আশিক আহমেদ বলেন, 'আমাদের দেশে যে পতিত জমি আছে আমরা চাকরির পেছনে না ঘুরে ওই জমিতে কৃষি ফলনের উপযোগী করে তুলে কৃষিকাজ করলে সহজেই স্বাবলম্বী হতে পারব। তাতে যেমন বাংলাদেশ সরকারের ওপরে চাপ কমবে তেমনি গ্রামগঞ্জের বেকারত্ব কমে যাবে।'

তিনি বলেন, 'এই মরিচের বিপুল পরিমাণ চাহিদার কারণে পাইকাররা আমার এই বাগান থেকেই মরিচ পাইকারি দরে কিনে নিয়ে যায়। বাজারে খুচরা বিক্রেতারা প্রতিটি মরিচ দুই টাকা করে বিক্রি করেন। তাতে তারাও লাভবান এবং আমিও লাভবান হই। আমাদের দেশের মাটিতে যে কোনো ধরনের কৃষি করলেই তার ফলন ভালো হয়। পাশাপাশি কৃষিতে মাটির গুণাগুণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'

বোম্বাই মরিচ ভারতের সাউথ এশিয়ার একটি প্রজাতি হিসেবে পরিচিত। এটি প্রায়ই মার্টিন দ্বীপে উৎপন্ন হয়, যা বাংলাদেশের নিকটস্থ এলাকার মধ্যে অবস্থিত। বোম্বাই মরিচের চাষ ও উৎপাদন প্রধানত বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ভুটান এবং ইন্দোনেশিয়ায় হয়।

বোম্বাই মরিচে মূলত ক্যাপসি কামিন এবং ডাইহাইড্রো ক্যাপসি কামিন নামক উচ্চ তাপমাত্রা ধরনের যৌগ থাকে, যা এই মরিচের গরম প্রকৃতির কারণ। এছাড়াও বোম্বাই মরিচে ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, আলক্যালয়েড, লিকোপেন, ক্যারোটিনযুক্ত লাইকোপেন এবং ভিটাক্যারোটিনসহ অনেকগুলো পুষ্টিগুণ থাকে। এ মরিচের মধ্যে থাকা প্রোটিন, অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, মিনারেল, অ্যাল্কালোইড, ব্যাক্টেরিসাইড, অ্যান্টিফাংগাল, এন্টিব্যাক্টেরিয়াল এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল গুণের জন্য পরিচিত।

বোম্বাই মরিচের চাষে সাধারণত উচ্চ নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম, ফসফরাস সার ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, পটাশিয়াম ও নাইট্রোজেনের সার ব্যবহার করা হয় যাতে প্রত্যেক প্রস্তুতি বারবারিতা এবং উচ্চ ফলন প্রদান করতে পারে। প্রতিটি উপকরণের প্রয়োজনীয় পরিমাণ পূরণের জন্য স্থানীয় জলবায়ু এবং মাটির গুণগত অবস্থার সঙ্গে মিলে যাওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় সারের পরিমাণ ও ধরন বিভিন্ন কৃষিবিদদের পরামর্শে নির্ধারিত হতে পারে। কারণ এটি স্থানীয় মাটি, আবশ্যকতা এবং অন্যান্য পরিবেশবাদী শর্তাদি ওপর নির্ভর করে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে