'একটু তরকারি দেবে না বলে যে প্রতিবেশি কড়াই ঢেকে রেখেছিল, তার মেয়ের বিয়েতে ৪০ হাজার টাকা ধার দিয়েছি!' দিন বদলের গল্প শোনাতে শোনাতে অশ্রম্নসিক্ত কণ্ঠে কথাটি বলেন যশোর শহরের পুরাতন কসবা লিচুবাগান এলাকার বাসিন্দা হামিদা আক্তার বিউটি।
বাল্যবিয়ের শিকার হনুফা খাতুন চা দোকানি স্বামীর সংসারে একটু সচ্ছলতার আশায় হাতের কাজের দেড়শ' টাকা মজুরি দিয়ে নিজের সূচিশিল্পের কাজ শুরু করেন। কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা হনুফা খাতুন এখন মাসে গড়ে ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করেন। ছেলেকে পড়াচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেয়ে মেডিক্যালে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে।
৫ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়ে যাওয়া রূপালী খাতুন দর্জি প্রশিক্ষণ নিয়ে সেলাই এবং কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। এখন ব্যাগ বানিয়ে মাসে তার প্রায় ১৫ হাজার টাকা উপার্জন। উপশহরের বাসিন্দা রূপালীর সংসারেও এসেছে স্বাচ্ছন্দ্য।
আর রাজিয়া খাতুন তো সংগ্রাম নারী হিসেবে অন্যদের কাছে উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। শূন্য থেকে শুরু করে হস্তশিল্প, শাড়ি কাপড়ের ব্যবসা, মুদি দোকান, হাঁস, মুরগি ও গরুর খামার করে নিজের জীবন যেমন বদলে নিয়েছেন, তেমনি অন্য নারীদেরও উৎসাহিত করছেন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার। পেয়েছেন এলজিআরডি মন্ত্রণালয় থেকে দেশসেরার স্বীকৃতিও।
আত্মপ্রত্যয়ী এই নারীদের দিন বদলের গল্পের নেপথ্যের সারথী 'ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-আইইডি'। কোনো ঋণ কার্যক্রম নয়, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে এই নারীদের স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করে যাচ্ছে সংস্থাটি। শুধু বিউটি, হনুফা, রূপালী বা রাজিয়া নয়; এমন অসংখ্য নারী স্বাবলম্বী ও উদ্যোক্তা হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। বদলে গেছে তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক চিত্র। পরিবার ও সমাজের নানা উন্নয়ন কর্মকান্ডেও তারা ভূমিকা রাখছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও আইইডি'র এই কার্যক্রমের ইতিবাচক মূল্যায়ন করছেন।
হামিদা আক্তার বিউটির দিনবদলের গল্প : যশোর শহরের পুরাতন কসবা লিচুবাগান এলাকার হামিদা আক্তার বিউটি বাবা মায়ের ৮ সন্তানের মধ্যে ৬ষ্ঠ। মাত্র ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে ১৩ বছর বয়সে বিয়ে করেন মহুরি মনিরুজ্জামান হীরনকে। বিউটির বিয়ের মাত্র ৫ মাস পর স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। তখন তিনি গর্ভবতী। এক বছর পর স্বামী ফিরে এলেও মাদকাসক্ত-বেকার। উপায়ন্তর না পেয়ে বিউটি সংসারের হাল ধরার জন্য বাসাবাড়িতে কাজ করেন। পরে অনেক চেষ্টায় ৩৮০০ টাকা বেতনে শহরের একটি ক্লিনিকে চাকরি নেন। সেখানে ৮ বছর চাকরি করেন। সংসারের সমস্ত ব্যয়ভার তার ওপরই ছিল। স্বামীর মন চাইলে কিছু টাকা দিত। চাকরি করে সংসার চালাতে তাকে হিমশিম খেতে হত। এটা দেখে তার বড় বোন তাকে কাপড়ের ব্যবসা করার পরামর্শ দেন এবং সেই সঙ্গে ১০ হাজার টাকা ধার দিয়ে কুষ্টিয়ার পোড়াদহে নিয়ে যান। সেখান থেকে প্রতি সপ্তাহে শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিস, বিছানার চাদর নিয়ে এসে বাড়িতেই বিক্রি শুরু করেন। এ সময় তিনি আইইডি'র সচেতনতা দলের সদস্য হন।
এ সময় আইইডি'র সহযোগিতায় ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসার পরিধি বাড়িয়েছেন। এখন প্রতি সপ্তাহে পোড়াদহ থেকে অন্তত ৫০ হাজার টাকার শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিস, বিছানার চাদর নিয়ে আসেন। সঙ্গে থাকে যশোরের হাতের কাজের শাড়ি, থ্রি-পিস, বেডশিটসহ বিভিন্ন কাপড়সামগ্রী।
হামিদা আক্তার বিউটি জানালেন, প্রতিমাসে দু'লক্ষাধিক টাকার বেচাকেনায় প্রায় ৪০ হাজার টাকা আয় হয় তার। এখন তার পুঁজি প্রায় দশ লাখ টাকার। ঘটা করে সম্প্রতি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
স্বপ্নবান নারী হনুফা খাতুন : বুকের মাঝে লালিত স্বপ্নকে পূরণ করতে সমাজের প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে গিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন হনুফা খাতুন। যশোর জেলা সদরের কাজীপাড়ার ভাড়া বাসায় হনুফা খাতুনের বসবাস। স্থানীয় মানুষের অতি পরিচিত হনুফা আপা পেশাগত জীবনে একজন কাপড় ব্যবসায়ী। আইইডি যশোর কেন্দ্রের নারী দলের সভানেত্রী হনুফার আইইডি যশোরের সঙ্গে পথ চলার শুরু ২০০৫ সালে নারী উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে।
স্বামী সাধারণ চা দোকানদার। ফলে সংসার জীবনে অভাব অনটন ও কখনো বা কঠোর দরিদ্রতা ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। সংসারে এক ছেলে, এক মেয়ে, স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে মোট ছয় সদস্যের পরিবার। তাই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন।
শুরুটাও হয়েছিল সেলাই কাজে নিজের আয় করা শাড়ি সেলাই থেকে পাওয়া মাত্র দেড়শ' টাকা দিয়ে। সেই টাকা দিয়ে অন্যের মাধ্যমে কাপড় ও সুই-সুতো কিনে সেলাইয়ের কাজ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে হাতের কাজের শাড়ি, থ্রি-পিস, বেডসিট বিক্রি শুরু করেন। বাড়িতে বসেই এখন তিনি প্রতিমাসে অর্ধলক্ষাধিক টাকার শাড়ি, থ্রি-পিস, বেডসিট। খরচ বাদ দিয়ে প্রতিমাসে গড়ে ১৫ হাজার টাকা তার উপার্জন হয়।
\হস্বামীর উপার্জনের বাইরে এই টাকায় তিনি সংসারে ব্যয় করছেন, সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। ছেলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। মেয়ে এ বছর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে।
হনুফা খাতুন জানালেন, উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পাশাপাশি নারী দলের সব সদস্যকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছি। দলের কোনো সদস্যের কোনো ধরনের সমস্যা হলে দলের অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি।
এছাড়া এলাকার কোনো ব্যক্তি বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা পাওয়ার জন্য যোগ্য হলে তাদেরকে নিয়ে সমাজসেবা, মহিলা অধিদপ্তরে যোগাযোগ করে ভাতা পেতে সহযোগিতা করি।
সংগ্রামী নারী রূপালী খাতুন : রূপালী খাতুনে জন্ম যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের শেখহাটি এলাকায়। ৫ম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় ১৩ বছর বয়সে ২০০৭ সালে বাবা-মা তাকে বিয়ে দেয় উপশহরের বিরামপুর এলাকার টুটুল হোসেন মন্ডলের সঙ্গে। তার স্বামী পেশায় একজন পস্নাম্বার। বিয়ের পর তার লেখাপড়া থমকে যায়। বিয়ের দুই বছর পর কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। ১৩ বছর আগে উপশহর এলাকায় আইইডি পরিচালিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে জানতে পেরে আইইডি'র নারী দলের সঙ্গে যুক্ত হন।
দলীয় সভার মাধ্যমে বিভিন্ন সচেতনতামূলক বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেন। আয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চিন্তা থেকেই শেখেন দর্জির কাজ। তারপর স্বামীর সহযোগিতায় একটি পুরাতন সেলাই মেশিন কিনে এলাকায় মজুরির ভিত্তিতে দর্জির কাজ শুরু করেন। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে আয়ের টাকা সংসারে খরচের পাশাপাশি সঞ্চয়ও করতে থাকেন।
স্বামী বাজার থেকে চট ও সিমেন্টের বস্তা কিনে এনে কেটে দেন। রূপালী বেগম ও একজন সহযোগী সেই ব্যাগ সেলাই করেন। এই ব্যাগ থেকেই প্রতিমাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকা উপার্জন হচ্ছে তার।
অন্যের জন্য উদাহরণ রাজিয়া খাতুন : রাজিয়া খাতুন আট ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। অভাবের সংসারে ১৩ বছর বয়সে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পরে স্বামীর সংসারেও নুন আনতে পানতা ফুরায় এমন অবস্থা। ১৯৮২ সালে প্রথম সন্তানের মা। প্রথম সন্তানের জন্মের পর সিদ্ধান্ত নিয়ে নৈশবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৮৯ সালে এসএসসি পাস করেন। ইচ্ছা থাকলেও উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি আর পেরোতে পারেননি। তখন নিজেকে সংসারের আয়বর্ধক নানা কর্মকান্ডে জড়িয়ে ফেলে এবং বাড়িতে ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। পরবর্তীতে আইইডি থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ করে দুই দশক আগে টিউশনির জমানো দুই হাজার তিনশত পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সেলাই মেশিন ক্রয় করেন। সেলাই কাজের পাশাপাশি নকশিকাঁথা সেলাই কাজ শুরু করেন। এ কাজে অল্পদিনের মধ্যে এলাকায় বেশ সাড়া পড়ে যায়। হস্তশিল্পের কাজের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এলাকার অন্য নারীদের দিয়েও কাজ করিয়ে বিক্রি শুরু করেন। শাড়ি, থ্রি-পিস, বেড সিট, টু-পিস পাইকারি কিনে এনে এলাকার নারীদের দিয়ে নকশি ও ফুল তুলে বিক্রি করতে থাকেন। পাশাপাশি হাঁস, মুরগি ও গরুর খামার গড়ে তুলেছেন। মুদি দোকান দিয়েছেন। শহরের লিচুবাগান এলাকায় তিন শতক জমি কিনে বাড়ি করেছেন। ছেলেকেও আলাদা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিয়েছেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে হস্তশিল্প ব্যবসায়ী ও খামারি হিসাবে সফল তিনি।
কঠোর পরিশ্রম করে দারিদ্র্যকে জয় করা রাজিয়া কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ স্থানীয় সরকার পলস্নী উন্নয়ন (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয় নগর উন্নয়ন সেক্টর ক্যাটাগরিতে দেশসেরার স্বীকৃতি পেয়েছেন। দরিদ্র শ্রেণির প্রতিনিধি হিসাবে ঢাকা ও ভারতের মুম্বাই শহর সফর করে বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিদর্শন করেছেন।
শুধু বিউটি, হনুফা, রূপালী বা রাজিয়া নয়, এমন অসংখ্য নারী স্বাবলম্বী ও উদ্যোক্তা হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। বদলে গেছে তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক চিত্র; পরিবার ও সমাজের নানা উন্নয়ন কর্মকান্ডেও তারা ভূমিকা রাখছেন। আত্মপ্রত্যয়ী এই নারীদের দিন বদলের গল্পের নেপথ্যের সারথী 'ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-আইইডি'।
আইইডি যশোর কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক বীথিকা সরকার জানান, ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আইইডি একটি জাতীয় পর্যায়ের বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ২০০৪ সাল থেকে যশোরে এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। যশোরে আইইডি'র ৫০টি নারী দলে ১ হাজার ১১ জন তৃণমূল পর্যায়ের বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে নাগরিক পস্নাটফর্ম 'জনউদ্যোগ' রয়েছে।
নারী ফোরামের আহ্বায়ক অ্যাড. সৈয়দা মাসুম বেগম বলেন, সমাজের প্রান্তিক অবস্থানে থাকা নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলে স্বাবলম্বী করতে ভূমিকা রাখছে আইইডি। নানাভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে এই নারী আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করে আয় উপার্জন করে।
জনউদ্যোগ যশোরের আহ্বায়ক প্রকৌশলী নাজির আহমেদ বলেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া, দরিদ্র যে নারীরা এক রকম গৃহবন্দি ছিল। আইইডি তাদের প্রশিক্ষিত ও কর্মমুখী করেছে। আর্থিক ভিত্তি পাওয়ায় এই নারীরা এখন তাদের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের জেলা প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা মুনা আফরিন জানান, আইইডিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা পিছিয়ে পড়া নারীদের নানাভাবে প্রশিক্ষিত করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে।
যশোর সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক অসিত কুমার সাহা বলেন, সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলছে। সমাজের প্রান্তসীমার এই নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে পরিবার ও সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। সরকারও নানা ধরনের প্রণোদনায় তাদরকে উদ্বুদ্ধ করছে এবং আরও অগ্রসর হতে সহযোগিতা করছে।