শনিবার, ০৩ মে ২০২৫, ১৯ বৈশাখ ১৪৩২

যশোরাঞ্চলের 'প্রাচীনত্বের ধারণা' বদলে দেওয়া 'ধনপোতা ঢিবি' ফের খনন

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর
  ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যশোরাঞ্চলের 'প্রাচীনত্বের ধারণা' বদলে দেওয়া 'ধনপোতা ঢিবি' ফের খনন
যশোরের 'ধনপোতা ঢিবি'তে খনন করে পাওয়া সেই ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন -যাযাদি

যশোরের সেই ঐতিহাসিক নিদর্শন 'ধনপোতা ঢিবি'তে ফের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই 'ধনপোতা ঢিবি'সহ এলাকার প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনগুলো এ অঞ্চলের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের পূর্ববর্তী প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নব্বই দশকের পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে সংশয় ছিল। প্রথাগত ঐতিহাসিকদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, ভূমি গঠন নবীন হওয়ায় এ অঞ্চলে আদি ঐতিহাসিক যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু মণিরামপুরের ধনপোতা ঢিবি, দমদম পীরস্থান ঢিবি, ডালিঝাড়া প্রত্নস্থল খননের পর সেখানে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও নিদর্শন প্রাপ্তির ঘটনা প্রথাগত ঐতিহাসিকদের প্রচলিত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে। এ কারণে প্রত্নস্থল সম্পর্কে আরও জানার অভিপ্রায়ে যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া গ্রামের ধনপোতা ঢিবিতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছর প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রম ফের শুরু হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন।

মঙ্গলবার প্রধান অতিথি হিসেবে খনন কাজের উদ্বোধন ঘোষণা করেন মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত তামান্না। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার লোকজন অংশগ্রহণ করেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এ-ই প্রত্নঢিবিটি ২০০৭ সালে চিহ্নিত হয়। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর থেকে প্রথম প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও দিকনির্দেশনায় এর খনন কার্যক্রম শুরু হয়। বিগত অর্থ বছরে ১১টি বর্গে হ্যারিস ম্যাট্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রাচীন স্থাপনার ধবংসাবশেষ উন্মোচনসহ খননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুসমূহ নথিভুক্তকরণ করা হয়েছে। গত ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রত্ন ঢিবির সীমিত একটি অংশে খনন পরিচালনা করে প্রাচীন ইট নির্মিত চতুষ্কোণ প্রার্থনাকক্ষ সমেত একটি বর্গাকার স্থাপনার সন্ধান পাওয়া যায়। উন্মোচিত স্থাপনাটিকে প্রাথমিকভাবে আদি মধ্যযুগের কোন স্থাপত্য নিদর্শনের বলে ধারণা করা হয়। কোন প্রামাণ্য ঐতিহাসিক উপাদান (শিলালিপি, মুদ্রা বা স্মারক নিদর্শন) পাওয়া না যাওয়ায় স্থাপত্য কাঠামোর ব্যবহারিক উদ্দেশ্য, প্রকৃতি এবং ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া গ্রামে চারদিকে ধূ-ধূ মাঠ। মাঠের মাঝখানে সুউচ্চ একটি ঢিবি। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে এটি পরিচিত ধনপোতা ঢিবি/ বিরাট রাজার ঢিবি/ধনপতি সওদাগরের বাড়ি নামেও পরিচিত। প্রাচীন এই ঢিবিকে কেন্দ্র করে শতশত বছর ধরে এ অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে নানা জনশ্রম্নতি। জনশ্রম্নতির কাহিনীর সঙ্গে মহাভারতের পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মহাভারতের 'বিরাট' পর্বে উলেস্নখ আছে, পঞ্চপান্ডব বনবাস থেকে বিরাট রাজার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। খেদাপাড়ার ধনপোতা ঢিবিকে কেউ কেউ মহাভারতের কাহিনীতে উলিস্নখিত বিরাট রাজার বাড়িটির ধ্বংসাবশেষ বলেও মনে করেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও প্রত্নসূত্রের ভিত্তিতে যশোরের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে আমাদের প্রথম ধারণা প্রদান করেন বরেণ্য প্রত্নতত্ত্ববিদ কে এন দীক্ষিত। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বরেণ্য এ প্রত্নতত্ত্ববিদ যশোরের ভরত ভায়না/জটার দেউল বা ভরত রাজার দেউল পরীক্ষামূলক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করে ঢিবির নিচে বিলুপ্ত প্রাচীন স্থাপনার অস্তিত্বের কথা প্রথম জানান। কে এন দীক্ষিতের এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার যশোরের প্রাচীনত্ব ঐতিহাসিকদের দীর্ঘ দিনের প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা পরিবর্তনে সাহায্য করে। এরপর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার দমদম পীরস্থান ঢিবি, কেশবপুর উপজেলার গৌরিঘোনা ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামে ডালিঝাড়া প্রত্নস্থানে খননের ফলে বাংলাদেশের আদি ঐতিহাসিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে