শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
আট বছরে নিহত চার শতাধিক এলজিইডি'র ওপর দায় চাপাচ্ছে রেলওয়ে

কুমিলস্না অঞ্চলে রেলের ১৭২ কিলোমিটারে অনুমোদনহীন শতাধিক লেভেল ক্রসিং

মো. আবদুল জলিল ভূঁইয়া, কুমিলস্না
  ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
কুমিলস্না অঞ্চলে রেলের ১৭২ কিলোমিটারে অনুমোদনহীন শতাধিক লেভেল ক্রসিং
কুমিলস্না অঞ্চলে রেলের ১৭২ কিলোমিটারে অনুমোদনহীন শতাধিক লেভেল ক্রসিং

কুমিলস্নায় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের আওতায় ১৭২ কিলোমিটার পথে অন্তত ১১৬টি অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এসব স্থানে 'অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিং, নিজ দায়িত্বে পারাপার হউন' এমন সাইন বোর্ড ঝুলিয়েই দায় এড়ায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। আবার কোনো কোনো স্থানে এমনটিও সাইনবোর্ড নেই। তবে এসব অনুমোদনহীন গেটে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ফলে কুমিলস্নার এসব রেলক্রসিং সাধার মানুষের কাছে মরণফাঁদ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছে। গত ৮ বছরে এ অঞ্চলে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে চার শতাধিক। সর্বশেষ গত ২৬ নভেম্বর বুড়িচংয়ের একটি অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিং অতিক্রম করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে অটোরিক্সার ৭ যাত্রী। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছেন, বিধান না মেনেই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) ও পৌরসভা অনুমতি ছাড়াই রেল লাইনের উপর দিয়ে ইচ্ছামতো সড়ক তৈরীর ফলে এসব এলাকায় অনেকটা মরন ফাঁদ তৈরী হয়েছে। তবে এলজিইডি বলছে, জনস্বার্থে রাস্তা তৈরী করতে গিয়ে নানা শর্তের কারণে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনাপত্তি মিলে না। রেলওয়ে জানিয়েছে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এলজিইডির ১৭টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং বৈধতা দিতে যাচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

কুমিলস্না রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, কুমিলস্নার লাকসাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার রেলপথে বৈধ ৩৩টি লেভেল ক্রসিং আছে। অবৈধ আছে ৩৮টি। এর মধ্যে ৩২টি এলজিইডির তৈরি করা রাস্তা। বাকিগুলো পৌরসভার ও ইউনিয়ন পরিষদের। শর্ত পুরণ সাপেক্ষে সম্প্রতি এলজিইডির ১৭টি লেভেল ক্রসিংকে বৈধতা দেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। অপর দিকে লাকসাম-নোয়াখালী রেল পথের ৪৯ কিলোমিটার এলাকায় বৈধ ক্রসিং ১৯টি, অবৈধ ৪২টি এবং লাকসাম-চাঁদপুর ৫১ কিলোমিটার এলাকায় বৈধ ২৩টি ও অবৈধ ৩৬টি রেলক্রসিং আছে। গত ২৬ নভেম্বর বুড়িচংয়ের কালিকাপুর লেভেল ক্রসিংয়ে গেট না থাকায় অটোরিক্সার ৭ যাত্রী প্রাণ হারানোর পর এ দুর্ঘটনার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দায় চাপিয়েছে এলজিইডির উপর। রেলওয়ের বক্তব্য রেল লাইনের উপর দিয়ে পাবলিক পরিবহণ ও জনগণের চলাচলের রাস্তা (লেবেল ক্রসিং) তৈরি করার আগেই সরকারি বিধি মোতাবেক কাজ তদারকি এলজিইডি, সওজ ও পৌরসভাকে পূর্বানুমতি নিতে হবে। এ জন্য গেট তৈরির প্রয়োজনীয় টাকা ও এক বছরের জন্য গেটম্যানের বেতনের টাকা রেলওয়ের কোষাগারে আগাম পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু কুমিলস্নায় এলজিডির রাস্তার তৈরীর পর স্থানীয়রা নিজ দায়িত্বেই ৩২টি অবৈধ গেট নির্মাণ করে। এ জন্য এলজিইডিই দায়ি।

1

সম্প্রতি রসুলপুর রেলস্টেশনের কাছে একটি লেভেল ক্রসিংয়ে নিরাপত্তা গেইট বা কোন বেরিয়ার না থাকায় সেখানে রসুলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী মিম আক্তার ঢাকাগামী চট্টলা ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায়। এর আগে আগে সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর এলাকায় স্কুলে যাওয়ার পথে ট্রেনে কাটা পড়ে বিজয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তিন শিক্ষার্থী নিহত হয়। পরে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়ের পাশের রেল লাইন এলাকায় ৫০০ ফুট ফ্যান্সিং (কাঁটা তারের বেড়া) দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রতিটি লেভেল ক্রসিংয়ে ১০০ ফুট করে ফ্যান্সিং করে। লাকসাম রেলওয়ে থানা সূত্রে জানা যায়, অবৈধ লেভেল ক্রসিং ও অবৈধভাবে রেললাইন অতিক্রমকালে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় ২০১৭ সালে ৭৪ জন, ২০১৮ সালে ৬৮, ২০১৯ সালে ৬৬, ২০২০ সালে ৩৭, ২০২১ সালে ৪২ জন, ২২ সালে ৪৯, ২০২৩ সালে ৪৫ এবং চলতি বছরের (২০২৪) ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৬৩ জন নিহত হয়েছে।

লাকসাম রেলওয়ে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমরান হোসেন বলেন, লাকসাম রেলওয়ে থানার আওতাধীন ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গঙ্গাসাগর রেলস্টেশন থেকে ফেনীর ফাজিলপুর, লাকসাম-নোয়াখালী রুট এবং লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে লাকসামের চিতোষীর আগ পর্যন্ত। এসব এলাকায় বেশ কিছু অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এতে অসাবধানতার কারণে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটছে। মানুষের সচেতনার অভাবে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক দুর্ঘটনার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই স্থানীয়রা মরদেহ নিয়ে যায়। তাই মৃতু্যর সঠিক সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।

রেলওয়ে কুমিলস্নার ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (পথবিভাগ) লিয়াকত আলী মজুমদার জানান, জনগণের ভোগান্তি নিরসনে সরকারি দপ্তর গুলি রেল সড়ক সংলগ্ন এলাকায় সড়ক তৈরিতে রেলওয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করলে এমন সমস্যা হতো না। এমনিতেই রেলওয়েতে জনবল সংকট। তাই নতুন নতুন অবৈধ লেভেল ক্রসিং তৈরীতে জনবল সংকট ও দুর্ঘটনা দুটিই বাড়ছে। ওই কর্মকর্তার ভাষ্য সদর উপজেলার গোমতী ব্রিজের উভয় পাশে সওজ'র অর্থায়নে গেইট তৈরী ও এক বছরের জন্য গেটম্যানের টাকাও সওজ দিয়েছে। পরে গেটম্যানদের বৈধ করে নেয়া হয়। শর্ত সাপেক্ষে কুমিলস্না অঞ্চলে এলজিইডির ১৭টি অবৈধ গেট অনুমোদন দেয়ার কাজ চলছে।

তবে কুমিলস্না এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জিয়াউল ইসলাম মজুমদার বলেন, রেললাইনের উভয় প্রান্তে রেললাইনের জায়গা বাদ রেখেই এলজিইডি রাস্তা তৈরী করে। রেলের জায়গায় আমরা রাস্তা নির্মাণ করি না। রেল এ বিষয়ে এনওসি (অনাপত্তি) দেয় না। কিন্তু গেট তৈরি এবং কর্মী নিয়োগের আগাম এক বছরের বেতনের টাকা রেলওয়ের কোষাগারে জমা দেয়ার বিষয়টি কুমিলস্নায় যোগদানের পরই জানলাম। ওই কর্মকর্তার ভাষ্য জনস্বার্থে তৈরি করা রাস্তার জন্য রেলওয়েকে গেট নির্মাণ ও কর্মী নিয়োগ দেয়া উচিত। তবুও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে আগাম অর্থ দেয়ার বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে