রাজশাহীর পুঠিয়ায় খেজুর রস থেকে গুড় ও পাটালি তৈরিতে ব্যস্ত গাছিরা। ভালো দামে খুশি তারা। এদিকে, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে গুড়ের দোকানেগুলোতে বেড়েছে ক্রেতাদের ভিড়। প্রতিনিধিদেও পাঠানো বিস্তারিত খবর-
পুঠিয়া (রাজশাহী) প্রতিনিধি জানান, রাজশাহীর পুঠিয়ায় খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গাছিরা। প্রতিদিন ভোরে তারা বেরিয়ে পড়ছেন রস সংগ্রহে। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের গাছিরা এখন খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বিভিন্ন গ্রামে ইতোমধ্যে গাছ তোলার কাজ শেষে নলেন গুড় ও পাটালি বাজারে উঠতে শুরু করেছে। শীত কম থাকলেও আগাম গুড় ও পাটালিতে দাম ভাল পাওয়া যাচ্ছে বলে এলাকায় পাটালি গুড় তৈরির ধুম পড়েছে।
উপজেলার বানেশ্বর, বেলপুকুর, কাপাসিয়া, ভালুকগাছী ও ঝলমলিয়ায় প্রুচুর সংখ্যক খেজুর গাছ লক্ষণীয়। এসব এলাকায় প্রতিটি বাড়িতে, জমির আইলে, রাস্তার পাশে, পতিত জমিতে সারি সারি খেজুর গাছ দেখা যায়। বর্তমানে এসব এলাকায় বাণিজ্যিক ভাবেও খেজুর বাগান গড়ে তুলছেন অনেকে। শীতের সঙ্গে খেজুর রসের রয়েছে এক অপূর্ব যোগাযোগ। শীত যত বাড়তে থাকে খেঁজুর রসের মিষ্টতাও তত বাড়ে।
এ সময় গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতিক মধুবৃক্ষ থেকে সু-মধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে পুরোদমে শুরু হয় ভাপা পিঠাসহ বিভিন্ন ধরনের পিঠা, পায়েস ও গুড় পাটালী তৈরির ধুম। খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা নলের গুড়, ঝোলা গুড়, দানা গুড় ও পাটালি গুড়ের মিষ্টি গন্ধেই যেন অর্ধভোজন হয়ে যায়। খেজুর রসের পায়েস, রসে ভেজানো পিঠাসহ বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের মতো জুড়িই নেই।
উপজেলার ধলাট এলাকার গাছি সোহাগ জানান, তার লিজ নেওয়া ও নিজেরসহ প্রায় ৬০ টার মত খেজুর গাছ রয়েছে। শীত মৌসুমে এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় ও পাটালি তৈরি করে স্থানীয় বানেশ্বর হাটে বিক্রি করেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাপারীরা এসে এসব গুড় পাটালি কিনে নিয়ে যায়। দামও বেশ ভালো পাওয়া যায়। গত বছর তিনি ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে গুড় বিক্রি করেছেন। এবছরও ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে।
ছান্দাবাড়ীর মো. মন্টু ও মাড়িয়া এলাকার লুৎফর রহমান বলেন, খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় ও পাটালি তৈরি করে স্থানীয় হাটে গুড় বিক্রি করেন। এবার খেজুর গুড় ও পাটালির দাম ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে।
তবে কিছু অসাদু গাছী ও মালিকরা গুড় তৈরিতে ব্যবহার করছে চিনি। গুড়ের কালার এবং দানা তৈরির জন্য কিছু লোভি অসাধু লোক গুড়ের সাথে চিনি মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করছে। এতে করে সঠিক মানের গুড় পাচ্ছেনা ক্রেতারা। তবে একটি বড় অংশ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনলাইনের মাধ্যমে প্রচুর সংখ্যক গুড় বেচাকেনা হয়।
জ্বালানিসহ সব ধরনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এবছর দাম বেশি থাকলেও লাভের পরিমাণ কমে যেতে পারে। তবে দাম ভালো পাওয়ায় তা পুষিয়ে যাবে বলে আসা গাছ মালিকদের। ভোরে গাছিরা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বাড়িতে আনছেন। পরিবারের সবাই রস জালানো, কলস পরিষ্কার করাসহ নানা কাজে সহযোগিতা করছেন। আবার দুপুরেই গাছিরা বাটাল, হাসুয়া, ঠুঙি, দড়ি ও মাটির কলস (ভাড়) নিয়ে ছুটে চলেছেন মাঠে। পুঠিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্মৃতি রানী সরকার জানান, এ বছর উপজেলায় ২৭০ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৫০ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। উৎপাদন লক্ষমাত্রা প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন ধরা হয়েছে। তবে শীত যত বাড়বে উৎপাদন তত বেশি হবে এবং শীত কম হলে উৎপাদন আরও কমে যাবে। তবে গাছ মালিকরা সঠিকভাবে গাছের পরিচর্যা না করায় খেজুর গাছ আজ বিলপ্তির পথে।
রায়গঞ্জ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, পিঠাপুলির ঋতু হিসেবে পরিচিত শীতের মৌসুমে বাজারে বেড়েছে গুড়ের কদর। শীতের আমেজের সঙ্গে সঙ্গে দোকানগুলোতে বেড়েছে ক্রেতাদের ভিড় ও বিক্রেতাদের ব্যস্ততা।
সরজমিনে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, অন্যান্য সময়ের তুলনায় শীতের এ মৌসুমে গুড়ের দোকানে ক্রেতাদের ভিড় চোখে পড়ার মতো।
উপজেলার চান্দাইকোনা বাজারে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ক্রেতারা রীতিমতো নাকে শুকে, কিছুটা খেয়ে, পরখ করে কিনছেন খেজুরের গুড়। প্রতি কেজি গুড় বিক্রি হচ্ছে মান ভেদে ১৪০-২৫০ টাকায়। তবে পাটালি গুড়ের কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ -২৫০ টাকায়। আর আখের গুড় বিক্রি হচ্ছে প্রতি ঢিমা ৮০ টাকা।
বাজারে গুড় কিনতে আসা ক্রেতা গোলাম রাব্বি বলেন, পরিবারের সবাই পিঠা খাবে। তাই গুড় কিনতে এসেছি। তিনি আরো বলেন, 'আগে খেজুর গুড় থেকে আলাদা একটা গন্ধ ও স্বাদ পাওয়া যেত। ভেজালের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় গন্ধ আর স্বাদ কোনটাই নেই। প্রশাসন সোচ্চার থাকলে অসাধু ব্যবসায়ীরা এগুলো করার সাহস পেত পাবে না।'
পশ্চিম লক্ষিকোলা গ্রামের আরেক ক্রেতা শামীম হোসেন বলেন, প্রতি বছরই শীত এলে আমরা পরিবার-আত্নীয় স্বজন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরি করে খেয়ে থাকি। এখন একটু শীত বেশি পড়ায় সবাই গুড় কিনতে ব্যস্ত হয়েছেন। যার কারণে ব্যবসায়ীরাও এই সুযোগে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে খেজুরের রসের সাথে চিনি মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন অনেক ক্রতারা।
গুড়ের দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে উত্তর চান্দাইকোনা বাজারের গুড় বিক্রেতা শহীদ, নেনহাজ ও নবির উদ্দিন বলেন, শীত মৌসুমে খেজুর রসের পিঠা, পায়েস, গুড়ের মুড়ি-মুড়কির জন্য ভালো মানের গুড় নিচ্ছেন। বাজারে ভালো মানের খেজুরের গুড়ের চাহিদা বেশি। 'আমরা অনেক কমেই বেচি। এখানে যে গুড়ের দাম ২০০ টাকা, ওইটা অন্য জায়গায় ৩৫০ টাকার নিচে পাওয়া যাবে না। তবে এ হাটে মানভেদে ১৪০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে খেজুর গুর পাওয়া যাচ্ছে। আর আখের গুড় প্রতি ঢিমা (৭০০ গ্রাম) বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।
গুড়ের পাশাপাশি নারিকেল ও আতপ চালের চাহিদাও বেড়েছে। অনেকে চাল কিনে বাসায় নিয়ে নিজেরা গুঁড়া করছেন, অনেকে আবার বাজার থেকেই গুঁড়া করে নিয়ে যাচ্ছেন। বাজারে নারিকেলের দোকান গুলোতেও ক্রেতাদের ভীড় লক্ষ্য করা গেছে।
উপজেলার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য এম এ হুসাইন বলেন, ভেজাল গুড় যারা তৈরি করে, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করা উচিত। মানুষকে মৃতু্যর মুখে ফেলে দিচ্ছে এসব অসাধু বিক্রেতারা। তাই ক্রেতাদের সর্বদাই সচেতন হওয়া দরকার।
শীতকালে বাঙালির এক অনন্য ঐতিহ্য ঘরে ঘরে পিঠা তৈরির ধুম। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের মানুষ নিজেদের পুরনো ঐতিহ্যকে ভোলেনি পৌষ-মাঘের ঘরে ঘরে পিঠা উৎসব তারই প্রমাণ দেয়।