খায়রুজ্জামান খাজা। আলোচনা আছে, ৩৮ বছর বয়সী এই খাজা নিজ নামে এলাকায় গড়ে তুলেছেন 'খাজা বাহিনী'। বিভিন্ন সময় যার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়েও মুখ খুলতে সাহস পায়নি সাধারণন মানুষ। নিরবে-নিভৃতেই কেঁদেছেন তারা।
গত ৫ আগস্টের পর থেকে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন খাজা ও তার বাহিনী। ভাই ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কাউকেই তোয়াক্কা করেননি এই খায়রুজ্জামান খাজা। সর্বশেষ নির্মমভাবে নির্যাতন করে প্রাণ কেড়ে নেন ওবায়দুর রহমান খান (২৮) নামে এক যুবকের। এরপর থেকেই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে অত্যাচারিত মানুষগুলো।
খায়রুজ্জামান খাজা জেলা সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের ভাটী লক্ষ্ণীপুর গ্রামের হানিফ মাতুব্বরের ছেলে। তার বড় ভাই বর্তমান কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আলতাফ হুসাইন। খাজার বিরুদ্ধে কোতয়ালী থানায় চাঁদাবাজি, ডাকাতি, দসু্যতাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
পুলিশ,র্ যাব, গোয়েন্দা পুলিশের হাতে একাধিকবার আগ্নেয়াস্ত্র, ইয়াবা, দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হলেও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জামিনে বের হয়ে আসেন খাজা। এরপর পুনরায় শুরু করেন ত্রাসের রাজত্ব।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রহমানের হস্তক্ষেপে একটি সাজাপ্রাপ্ত মামলায় খালাস পেয়ে বের হয়ে আসেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়।
বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তারের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৬ এপ্রিল একটি বিদেশী পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলিসহর্ যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন খায়রুজ্জামান খাজা। সড়কে বাসে ডাকাতির প্রস্তুতির সময় খাজাকে আটক করা হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি ধারালো অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়।
২০২১ সালের ১৫ মে দুইজন সহযোগীসহ কোতয়ালী থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে খাজাকে। তৎকালীন সময় এক প্রেসব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামাল পাশা জানান, তার বিরুদ্ধে কানাইপুর ইউনিয়নসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, দসু্যতা, ভূমি দখলসহ নানা বিষয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া চাঁদাবাজি, ডাকাতি, দসু্যতাসহ ১৮টি মামলা রয়েছে।
এরপর ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল ইয়াবাসহ গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে। একই বছরে তৎকালীন ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান অন্যত্র বদলির পরদিন এলাকায় ছাত্রলীগের বিভক্তিকরণে সহযোগীদের নিয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেন খাজা। যার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরেই ২৮ আগস্ট দেশীয় অস্ত্রসহ খাজা ও তার ৪ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
কিন্তু বার বার গ্রেপ্তার হওয়ার পরেই ক্ষমতার দাপটে জামিনে বের হয়ে আসেন খাজা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী নেতা আব্দুর রহমানের আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ট হিসেবে প্রকাশ্যে আসেন খাজা। তার ছত্রছায়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কানাইপুরে যুবলীগ নেতা পরিচয়ে আধিপত্য বিস্তার করেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা সমাবেশে ব্যানার ও ফেস্টুন টাঙিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে নিজেকে জানান দিতেন খাজা।
এরপর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যুবদলের সমর্থক পরিচয় দিয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। যুবদল নেতা হিসেবে জাহির করে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হন। চাঁদার টাকা না দিলে একাধিক ব্যক্তিকে ছাড়তে হয় এলাকা। এভাবেই গত কয়েক মাসে অন্ততপক্ষে কোটি টাকার চাঁদাবাজি করেছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার রাজনৈতিক ব্যক্তি ও এলাকাবাসী এ প্রতিবেদককে জানান।
সর্বশেষ তার হাতে বলি হয়েছেন ওই ইউনিয়নের ঝাউখোলা গ্রামের বিলস্নাল খানের ছোট ছেলে ওবায়দুর রহমান খান। গত শুক্রবার কানাইপুর মমতাজ ফিলিং স্টেশনে মোটর সাইকেলের তেল কিনতে গিয়েছিলেন ওবায়দুর। সেখান থেকে খায়রুজ্জামান খাজার নেতৃত্বে ১০ থেকে ১৫ জন যুবক ওবায়দুরকে মারধর করে তুলে নিয়ে যান। এরপর কানাইপুর শ্মশানে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন চালায়। তখন ওবায়দুরের দুই চোখে লোহার পেরেক দিয়ে খোঁচানো হয়, হাত পায়ের রগ কেটে ফেলাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কুপিয়ে জখম করা হয়।
গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান ওবায়দুর।
এ ঘটনায় শনিবার দিবাগত রাতে খাজাকে প্রধান আসামি করে ইউপি চেয়ারম্যানসহ ১৫ জনের নাম উলেস্নখ এবং ১০-১৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে কোতয়ালী থানায় হত্যা মামলা করেন নিহতের মা রেখা বেগম।
নিহতের বাবা বিলস্নাল খান বলেন, 'আমার ছেলে বিভিন্ন সময়ে খাজার অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। খাজাসহ হত্যাকান্ডে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানাই।'
নিহতের বড় ভাই রাজিব খান বলেন, 'খাজার বিভিন্ন অপকর্ম দেখে আমার ভাই প্রতিবাদ জানাতো। এ কারণে আমার ভাইয়ের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে হত্যা করেছে। এরপূর্বেও আমার ভাইকে পাঁচবার হত্যার চেষ্টা করেন খাজা ও তার লোকজন। কিন্তু তার ভাই চেয়ারম্যানকে বলা হলেও কোনো প্রতিকার পাইনি।'
এদিকে যুবক ওবায়দুর রহমানকে হত্যার পর মুখ খুলতে শুরু করেছে এলাকাবাসী। একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, গত ৫ আগস্টের পর থেকে খাজাকে টাকা দিয়ে এলাকায় থাকতে হয়েছে। কেউ টাকা না দিলে তাকে ভয়ভীতি ও মারধর করা হতো।
কোশাগোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা লাবলু মোল্যা অভিযোগ করে বলেন, 'আমাকে তার দলে যোগ দিতে বলেন। যোগ না দেওয়ায় আমার কাছে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন খাজা। টাকা না দেওয়ায় আমার জমি বিক্রি করে টাকা নেওয়ার ও মেরে ফেলার হুমকি দেন। খাজার কারনে কানাইপুরের একজন মানুষও সুস্থ্যভাবে রাতে ঘুমাতে পারছে না।'
ফরিদপুর কোতয়ালী থানার ওসি মো. আসাদউজ্জামান জানান, 'খাজাকে গ্রেপ্তারে আমাদের একাধিক টিম বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। শিগগিরই তাকে গ্রেপ্তার করতে পারব।'