নওগাঁ জেলার ৭ উপজেলায় অবৈধ ইটভাটায় পুড়ছে কাঠ। এর ফলে পরিবেশ হচ্ছে বিপন্ন। সেই সঙ্গে জেলায় খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে।
নওগাঁর ধামইরহাট, নিয়ামতপুর, সাপাহার, পোরশা, বদলগাছী, মহাদেবপুর ও আত্রাই উপজেলায় নীতিমালার তোয়াক্কা না করে ইটভাটায় গাছ কেটে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। ভাটা মালিকরা মেতে উঠেছেন ফসলি জমির মাটি কাটা নিয়ে। কৃষকের ৩ ফসলি জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ভূমি অফিস অথবা প্রশাসনের কোনো অনুমতি ছাড়াই মাটির প্রাণ টপ-সয়েল কেটে পুকুর খনন করা হচ্ছে। আর পুকুর খননের এ সব মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইট ভাটায়। সারা জেলায় যদি এভাবে ফসলি জমি কেটে শুধু পুকুরে পরিণত হয় তাহলে এক সময় শস্য ভান্ডার খ্যাত জেলা নওগাঁয় যেকোনো সময় খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, পুরো জেলায় পুকুর রয়েছে ৪৭ হাজার ৩৯২টি, যার আয়তন ১২৮৪১.০ হেক্টর। মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদৌস আলী জানান, এ জেলায় মাছের চাহিদা মিটিয়ে পাশের অন্য জেলাতেও রপ্তানি করা হয়। আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ পুকুর রয়েছে। নতুন করে পুকুর খনন বর্তমানে কোনো প্রয়োজন নেই। ধানী ৩ ফসলি জমি নষ্ট করে পুকুর খনন করা যাবে না। জেলায় কোনো এক সময় যদি পুকুরের প্রয়োজন হয় তবে এক ফসলি জমি অথবা ধান চাষ হয় না এরকম উঁচু জায়গা দেখে করা যেতে পারে।
২০১৯ এর ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইনে বিশেষ কোনো স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা অনুরূপ কোনো স্থান বা প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরে ইটভাটা স্থাপনের কথা বলা হলেও মানা হয়নি। এদিকে পরিবেশ বিপর্যয়রোধে দ্রম্নত কার্যকরী আইনি পদক্ষেপের কথা বলছেন পরিবেশবাদীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার ইসবপুর নুরু শেখের এস,আর,এম ব্রিকস ইটভাটায় খড়ি রয়েছে। নিয়ামতপুর উপজেলার ভাটকুন্ডু ভাবিচা ইউনিয়নের আনজুম হোসেন সোনার এম,এ,বি ব্রিকস ইটভাটার ভেতরে স'মিলের কড়াত মেশিন বসিয়ে গাছ কেটে ছোট লাকড়ি তৈরি করে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬শ' মণ কাঠ পোড়ানো হয়। ওই এলাকায় রয়েছে আরও দুই অবৈধ লাকড়ির ভাটা। সাপাহার উপজেলার পাতাড়ী ইউনিয়নের কলমুডাঙ্গা নাইমুল হকের হক ব্রিকস পোরশা উপজেলার নীতপুরে পাশাপাশি একই এলাকার মধ্যে প্রায় ৭ ভাটায় রলাকড়ি পোড়ানো হয়। বদলগাছীর রসুলপুর মাধবপাড় দীপ্তি ব্রিকস্ ও খান ব্রিকস্, মহাদেবপুর উপজেলার শাহাজাদপুর মেসার্স এম,আর ব্রিকস্, আত্রাই উপজেলার কালিকাপুর বিষ্ণুপুর গ্রামে সিদ্দিকুর রহমান মেম্বারের ও,এস,বি ব্রিকস্ ইট ভাটায় বন উজার করে পোড়ানো হচ্ছে হাজার মণ কাঠ। প্রতিটি ভাটার সামনে রয়েছে হাজার হাজার মণ খড়ি। পাশেই রয়েছে উঁচু মাটির স্তূপ।
এভাবে গাছ কেটে কাঠ পোড়ানোর কারণে পরিবেশ হচ্ছে বিপন্ন। অবশ্য সরেজমিনে গেলে কিছু কয়লা দেখা গেলেও মূলত এগুলো লোক দেখানো। আসলে কাঠ দিয়েই পোড়ানো হচ্ছে ইট।
অন্যদিকে এসব উপজেলার সাধারণ কৃষকদের ভাটা মালিকরা ভুল বুঝিয়ে তাদের ৩ ফসলি জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই পুকুরে পরিণত করছে। কৃষকদের বোঝানো হচ্ছে ধান, আলু, গম, ভুট্টা, আম ইত্যাদি চাষের চেয়ে মাছ চাষে অধিক লাভ। এতে কৃষক ৩ ফসলি জমির মাটি ভাটা মালিকদের কাছে বিক্রি করছে। আবার এসব মাটি ট্রাক্টর ও ড্রাম ট্রাকে জেলা ও উপজেলার প্রধান রাস্তা দিয়ে ভাটায় নিয়ে যাচ্ছে। ট্রাক্টর ও ড্রাম ট্রাকের উপরিভাগের অতিরিক্ত এটেল মাটি রাস্তায় পড়ে সড়কের বেহাল দশা হচ্ছে। ফলে বর্ষায় এসব রাস্তা দিয়ে মানুষের চলাচল একেবারে অযোগ্য হয়ে পড়বে। ঘটতে পারে সড়ক দুর্ঘটনা।
এ ছাড়া জনসংখ্যার দিক থেকে ওই ৭ উপজেলা সবচেয়ে বড় ও ঘনবসতি এলাকা। রয়েছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোও আবার অর্ধ কিলোমিটার দূরত্বের ভেতরে অবস্থিত। ভাটার কালো ধোঁয়ায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নানা রকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী জেলায় মোট ভাটা রয়েছে ১৭৯টি। এরমধ্যে মাত্র ২৬টির বৈধ কাগজপত্র আছে। আর বাকি ১৫৬টি অবৈধভাবে চলছে। এবিষয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করলে তাদের ম্যাজিস্ট্রেট স্বল্পতা থাকার কারণে অভিযান সম্ভব হচ্ছে না বলে কর্তৃপক্ষ জানায়।
ধামইরহাট ইউএনও মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উপজেলা প্রশাসন তদন্ত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নওগাঁ একুশে পরিষদ সংগঠনের সভাপতি অ্যাডভোকেট ডি.এম.আব্দুল বারী বলেন, যেসব কারণে প্রতিনিয়ত পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো ও কৃষকের ৩ ফসলি জমি কেটে মাটির প্রাণ টপ-সয়েল পোড়ানো এবং লোকালয়ে স্থাপন সেগুলির মধ্যে অন্যতম। তারা দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে কাজ করছেন। ইতোমধ্যে তারা অনেকবার নওগাঁ জেলা প্রশাসককে বিষয়গুলো জানিয়েছেন। ভূমি সুরক্ষা আইনের বিধান ভাটা মালিকরা লঙ্ঘন করছে। তাই এগুলো যারা করছে তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির দাবি জানান তিনি।
নওগাঁ জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিঠু হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি সভাপতির সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর নওগাঁর সহকারী পরিচালক নাজমুল হোসাইন বলেন, 'আমি নওগাঁয় এসেছি মাত্র ছয়মাস হলো। এসে দেখছি জেলার অনেক জায়গায় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। আমাদের তথ্য অনুযায়ী জেলায় ১৭৯টি ইটভাটা রয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ২৬টির বৈধ কাগজপত্র আছে, বাকিগুলো অবৈধ। আমরা অবৈধ ভাটার তালিকা বিভাগীয় অফিস এবং প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছে। পর্যায়ক্রমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁর উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভাটায় খড়ি পোড়ানোর কোনো অনুমতিই নেই। কয়লা অথবা গ্যাস দিয়ে তাদের ইট পোড়ানোর কথা। ফসলি জমি কেটে পুকুর তৈরি করা যাবে না। এসব করতে গেলে প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে। আর যারা এসব করছে তাদের আইনের আওতায় এনে যথাযোগ্য শাস্তি দিতে হবে।
নওগাঁ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, ভাটায় যেনো কাঠ না পোড়ানো হয় সেজন্য স্ব-স্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লিখিত আকারে নির্দেশ দেওয়া আছে। তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। আমাদের ১১ উপজেলার মধ্যে ৯টিতে নতুন ইউএনও এসেছেন। তারা খোঁজ নিয়ে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
ফসলি জমি কেটে পুকুর তৈরির বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, মান্দা উপজেলায় একটি মাটির পয়েন্টে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জেলার কোথায় ৩ ফসলি জমি কাটার তথ্য দিলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব। তাছাড়া আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট স্বল্পতা থাকার কারণে এসব অবৈধ ইট ভাটায় সব সময় অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে শিগগিরই এসব অবৈধ ভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।