শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
শতভাগ মাদ্রাসায় এখনো তৈরি হয়নি শহীদ মিনার

চেতনার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার

তারেক মাহমুদ, ঝিনাইদহ
  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০
ঝিনাইদহের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শহীদ মিনার -যাযাদি

একুশের চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে ঝিনাইদহ পৌরশহরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহীদ মিনার। ৮১ ফুট উচ্চতা আর ৫২ ফুট প্রস্থের শহীদ মিনারটি ২০১৫ সালের নভেম্বরে নির্মাণকাজ শুরু হয়। শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকার প্রেরণা ৭১ চত্বরসংলগ্ন চার রাস্তার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে। প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করে ঝিনাইদহ পৌরসভা। ২০১৬ সালের ২০ ফেব্রম্নয়ারি মিনারটি উদ্বোধন করেন 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি' গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ।

তবে ঝিনাইদহ জেলার ৬০ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো তৈরি হয়নি শহীদ মিনার। এসব প্রতিষ্ঠানে দায়সারা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে পালিত হয় মহান ভাষা দিবসের কর্মসূচি। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার না থাকায় দিনটিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কলাগাছ দিয়ে প্রতীকী শহীদ মিনার তৈরি করেই ভাষাশহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেখা যায়।

ঝিনাইদহ জেলায় কলেজ রয়েছে ৫৬, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৩০২, মাদ্রাসা ১১৬ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় ৯০৭টি। এর মধ্যে প্রায় শতভাগ কলেজে শহীদ মিনার থাকলেও প্রায় ৪০ ভাগ মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসায় কোনো শহীদ মিনার নেই। যেসব প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার আছে, তা সারা বছরই অবহেলা আর অযত্নে পড়ে থাকে। সারাদিন ছাগল-গরুর বিচরণক্ষেত্র আর রাতে বখাটেদের আড্ডা বসে এসব মিনারে।

ঝিনাইদহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসা। ১৯৪৭ সালে স্থাপনের পর ৭৩ বছর পার হলেও এখানে নির্মিত হয়নি শহীদ মিনার। এ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মো. রুহুল কুদ্দুস জানান, শহীদ মিনার না থাকায় প্রতিবছর কাঠ দিয়ে প্রতীকী মিনার তৈরি করেই শহীদ দিবসের কর্মসূচি পালন করা হয়। মাদ্রাসায় আলোচনা ও দোয়া মাহফিলের মধ্যদিয়ে ভাষাশহীদদের স্মরণ করা হয়।

শৈলকুপা ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এএসএম আখতারুজ্জামান মাদ্রাসায় শহীদ মিনার নেই উলেস্নখ করে জানান, উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে আমরা দিবসের কর্মসূচি পালন করি। পরে প্রতিষ্ঠানে দোয়া ও আলোচনা করা হয়। কেন শহীদ মিনার নেই এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকারিভাবে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি, তাই শহীদ মিনার তৈরি করা হয়ে ওঠেনি।

ঝিনাইদহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, জেলায় ৯০৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। তবে কতগুলো প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই, তা নিশ্চিত করতে না পারলেও; প্রায় ৪০ ভাগ বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই বলে জানান তিনি। তবে যেসব স্কুলে শহীদ মিনার নেই সেখানে নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নগরবাথান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তৈয়ব হোসেন মোলস্না জানান, আমার প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনারটি অনেক পুরনো। স্কুলের এক পাশে হওয়ায় শহীদ মিনারটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে রয়েছে। তাই নতুনভাবে একটি শহীদ মিনার তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান তিনি।

ঝিনাইদহ সদর পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম বলেন, পুরনো শহীদ মিনারের সামনে জায়গা কম থাকায় শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হিমশিম খেতে হতো। সময়ের প্রয়োজনে নতুনভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়। যে শহীদ মিনারটি খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বড় শহীদ মিনার।

এদিকে, জেলার কালীগঞ্জ শহরের আলহাজ আমজাদ আলী ও ফাইজুর রহমান ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী সোনাহা আফরোজ জানান, 'বড়দের কাছে শুনে শুনে একুশের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় অনেকবারই প্রভাতফেরিতে যোগ দিয়েছি। এখনো একুশ এলেই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই।'

ঝিনাইদহ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সানিদ নোমানি জানান, 'প্রতি বছর দিনটির জন্য আমি অপেক্ষায় থাকি। প্রভাতফেরি করে ভাষাশহীদের স্মরণে ফুল দিতে যাই। এদিনে শহীদ মিনারে যেতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু যখন তাদের আত্মত্যাগের কথা শুনি মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যায়।'

ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আব্দুলস্নাহ আল মাসুদ জুয়েল জানান, 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি' বাঙালির জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। একুশ ফেব্রম্নয়ারি এখন 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃত। এ দিবসের সঙ্গে বাঙালির জীবনের অনেক ত্যাগ, মহিমা ও আবেগ জড়িত। এদিন আমাদের জাতীয় জীবনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তোলা, বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তির প্রেরণা জোগায়।

ঝিনাইদহের জনপ্রিয় তরুণ সংগঠক সাকিব মোহাম্মদ আল হাসান জানান, একটি দেশ এবং জাতিকে সমগ্র বিশ্বে উপস্থাপনের অন্যতম মাধ্যম হলো সেই জাতির ভাষা এবং সংস্কৃতি। শিক্ষকদের মুখে শুনেছেন, ভাষার জন্য কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে পুলিশের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিলেন। সালাম-বরকতের শহীদ হওয়ার গল্প শুনে তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়। বহু আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা ভাষা পেয়েছি, যা পৃথিবীর আর অন্য কোনো দেশের ভাষার জন্য তাদের জীবন দিতে হয়নি।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী আঁখি আলমগীর জানান, আত্মত্যাগের বিনিময়ে ভাষা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। তাই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। যখন দেখি সুদূর সিওরালিয়নের মানুষও বাংলাকে ভালোবাসে, তখন ভালো লাগে। কিন্তু আমরা দিনে দিনে বাংলা ভাষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি! শুধু ফেব্রম্নয়ারি এলেই বাংলার চর্চা হয় বলে মত দেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে