শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
ভোলা-২

মুকুল-হাফিজের পালে তরুণদের টান

এমএইচ শিপন
  ২১ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

ভোলার চারটি আসনের মধ্যে ভোলা-২ এ ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচন করায় আসনটির রয়েছে আলাদা মর্যাদা। জেলার বোরহানউদ্দিন ও দৌলতখান উপজেলা নিয়ে এ আসনটি গঠিত। তবে স্বাধীনতার আগে থেকে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এ আসনের দাপ্তরিক নাম ছিল বাকেরগঞ্জ-৪। ওই সময় বোরহানউদ্দিন উপজেলাসহ লালমোহনের ৪টি ও তজুমদ্দিন উপজেলার ১টি ইউনিয়ন নিয়ে এ আসনের সীমানা ছিল। ১৯৮৪ সালে ভোলা মহকুমা থেকে জেলা ঘোষণার পর থেকে বোরহানউদ্দিন ও দৌলতখান উপজেলা নিয়ে ভোলা-২ আসনের সীমানা নির্ধারণ করা হয়।

এ আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৯৭৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৫ হাজার ৪৬০ জন, মহিলা ভোটার ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৮ জন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মোট ভোটার ছিল ২ লাখ ৯৭ হাজার ২৩ জন। ভোটার বেড়েছে ৯১ হাজার ৯৫৫ জন। সচেতন মহলের মতে, প্রায় ৯২ হাজার তরুণ ভোটার যেকোনো প্রার্থীর ভাগ্য বদলে দিতে পারে।

১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচন করেন। পরে তার ছেড়ে দেওয়া আসনে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে অনেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪০৩ জন সদস্য নিয়ে সংবিধান প্রণয়ন করার লক্ষ্যে গঠিত ১৯৭২ সালের অস্থায়ী সংসদকে প্রথম জাতীয় সংসদ হিসেবে অভিহিত করে ওই সংসদের সদস্যদের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ সদস্য দাবি করেন। ওই দাবি অনুযায়ী এ আসনের প্রথম সংসদ সদস্য হন রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়া।

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এ আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তারা দলীয় মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে যাতায়াত শুরু করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেরা প্রার্থিতা জানান দিচ্ছেন। পাশাপাশি নেতাকর্মীরাও প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। একই সঙ্গে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। ভোটারদের সঙ্গেও মতবিনিময় করছেন তারা। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ধীরে চলো নীতিতে কার্যক্রম চালাচ্ছে।

এ আসনে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আলী আজম মুকুল সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির (জেপি) বাইসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী ছালাউদ্দিনকে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৮ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিএনপি-দলীয় ধানের শীষের প্রার্থী হাফিজ ইব্রাহিমকে ২ লাখ ১১ হাজার ৫২৩ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে বিজয়ী হন।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাবেক শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা চারদলীয় জোট (বিজেপি, না-ফি) প্রার্থী ডক্টর আশিকুর রহমান শান্তকে ২৫ হাজার ১৪৪ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তোফায়েল আহমেদ গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বড় ভাই বিএনপি-দলীয় প্রার্থী হাফিজ ইব্রাহিমের কাছে ২৮ হাজার ৪৯০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। আবার ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওই হাফিজ ইব্রাহিম তোফায়েল আহমেদের কাছে ৮ হাজার ২৮১ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তোফায়েল আহমেদ জাতীয় পার্টির সাবেক স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী নাজিউর রহমান মঞ্জুকে ১৫ হাজার ১৮৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে তিনি এ আসনটি আলী আজম মুকুলকে ছেড়ে দিয়ে ভোলা-১ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা বলছেন, যদি আগামী নির্বাচনে বর্তমান সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল ও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ ইব্রাহিম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাহলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।

বোরহানউদ্দিন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জসিমউদ্দিন হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলামসহ নেতাকর্মীরা বলেন, নির্বাচনী মাঠে আলী আজম মুকুলের কোনো বিকল্প নেই। গত প্রায় দশ বছর ধরে এ জনপদে অন্য কোনো নেতার পা পড়েনি। এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বর্তমান সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুলের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক। গণসংযোগ ও সাংগঠনিক কাঠামোয় তিনি শক্ত অবস্থানে আছেন। একই রকম কথা বলেন দৌলতখান উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মঞ্জুর আলম খান ও সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন জাহাঙ্গীর।

আগামী নির্বাচন বিষয়ে আলী আজম মুকুল বলেন, 'আমি দুই মেয়াদে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর এ এলাকার প্রাণের দাবি মেঘনার ভাঙন রোধে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার টেকসই বস্নক বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছি। ৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছি। বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে টানা ৬৪ দিন সাধারণ মানুষের পাশে ছিলাম। ১৬ হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তাসহ আর্থিক সহায়তা দিয়েছি। নিজে এলাকায় থেকে দুইবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছি। কিন্তু এলাকা ছাড়িনি। এলাকায় নানামুখী উন্নয়ন করেছি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আমি মনোনয়ন প্রত্যাশী। শেখ হাসিনা আমার কর্মকে অবশ্যই মূল্যায়ন করবেন।'

তরুণ রাজনীতিবিদ কেন্দ্রীয় যুবলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জুরের ছেলে ডক্টর আশিকুর রহমান শান্তও এ আসন থেকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হতে চাচ্ছেন। তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে জানান, ভোলায় প্রায় এক সপ্তাহ অবস্থান করে নিজ নির্বাচনী এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে সভা ও মতবিনিময় করেছেন। যথেষ্ট সাড়া পেয়েছেন। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের টিকিটের জন্য আবেদন করেছিলেন বলেও জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. ওমর শরীফ এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। নৌকা প্রতীক পাওয়ার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা তাকে যোগ্য মনে করে মনোনয়ন দিলে তিনি নির্বাচন করবেন বলে জানান।

কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ হাওলাদারও এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি জানান, 'শেখ হাসিনা রাজপথের ত্যাগীদের মূল্যায়ন করেন। তাই মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আমি আশাবাদী।' তিনিও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের টিকিটের জন্য লড়েছিলেন।

এছাড়া আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের ছেলে ডা. আফতাব ইউছুফ রাজও মনোনয়ন প্রত্যাশী বলে জানা গেছে। তবে তিনি এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

দৌলতখান উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফারুক হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সাজুসহ বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও আসনটির সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ ইব্রাহিম। তারা বলেন, '১৯৯১ সালে দৌলতখানে ভোটে আমরা তৃতীয় অবস্থানে ছিলাম। হাফিজ ইব্রাহিমের দক্ষ নেতৃত্বে ২০০১ সালে বিএনপি এ আসন পায়। আসন্ন নির্বাচনে তার কোনো বিকল্প নেই।'

বোরহানউদ্দিন উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক জাকির হোসেন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সারোয়ার আলম খান বলেন, বলা চলে হাফিজ ইব্রাহিম একক প্রার্থী হচ্ছেন। তিনি কোনো প্রতিবন্ধকতার শিকার হলে তার ছেলে মারুফ ইব্রাহিম আকাশ প্রার্থী হতে পারেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, ভোলা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ ইব্রাহিম বলেন, 'আমি দলীয় মনোনয়ন পাবার ব্যাপারে আশাবাদী। আওয়ামী লীগ যদি ২০১৮ সালের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে তাহলে জনগণ আমাকে নির্বাচিত করবে। তবে নির্বাচন করা- না করাটা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। কারণ বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে অনড়।'

কেন্দ্রীয় শ্রমিক দলের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির নির্বাহী সদস্য রফিকুল ইসলাম মমিনও এ আসন থেকে নির্বাচন করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি বলেন, 'এলাকার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। নেতাকর্মীদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক।' তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকের টিকিটের জন্য লড়েছিলেন।

কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি শহিদুলস্নাহ তালুকদার বিএনপি থেকে এ আসনে মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা যায়। তিনি বলেন, 'বিএনপি নির্বাচনে গেলে ভোলা-২ আসন থেকে মনোনয়ন চাইব।'

জাতীয় পার্টির (এরশাদ) প্রার্থী হিসেবে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ভোলা জেলার আহ্বায়ক মো. মিজানুর রহমান এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হিসেবে মাওলানা মিজানুর রহমান নিজ দল থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী।

জামায়াতে ইসলামীর বোরহানউদ্দিন উপজেলার আমির মো. মাকছুদুর রহমান জানান, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। অবস্থা দেখে করণীয় ঠিক হবে। এখন পর্যন্ত জোটবদ্ধ বা একক স্বতন্ত্র নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়নি।

আগামীকাল : ভোলা-৩ আসনের বিস্তারিত

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে