শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর রাজকীয় জীবনযাপন!

প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে গ্রেপ্তার চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত মাসে একবার বিদেশ যেতেন ক্যাসিনোতে জুয়া খেলতে নেপালে ক্যাসিনোতে জুয়া খেলে ৭০ লাখ টাকা হেরেছেন বিদেশে অতিরিক্ত ডলার কেনার কারণে জেলও খেটেছেন
গাফফার খান চৌধুরী
  ০১ জুন ২০২৩, ০০:০০

চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী হয়েও রাজকীয় জীবনযাপন করতেন দেবাশীষ কুমার সাহা। তিনি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ২০তম গ্রেডের কর্মচারী। ভূমি জরিপকারীদের সহকারী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি আলিশান জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তার জীবনযাপনের স্টাইল বিত্তশালীদের জীবনযাপনের স্টাইলকেও হার মানিয়েছে। প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ দিয়ে তিনি বিলাসী জীবনযাপন করতেন। মাসে অন্তত এক দিন বিদেশে ক্যাসিনোতে জুয়া খেলতেন। সম্প্রতি নেপালে গিয়ে ক্যাসিনোতে জুয়া খেলে ৭০ লাখ টাকা হেরেছেন। আর অতিরিক্ত ডলার বিদেশে নেওয়ার কারণে দেশটিতে জরিমানা দিয়েছেন প্রায় এক কোটি টাকা। সেই সঙ্গে জেলও খেটেছেন ২৩ দিন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ এমন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, এক ভুক্তভোগী নারীর করা একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। ঢাকার রামপুরা থানায় ওই নারী রাজউক কর্মচারী দেবাশীষের (৪৮) বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন। পরবর্তীতে ওই নারীর আবেদনের প্রেক্ষিতে এবং মামলাটির ছায়া তদন্তকালে বেরিয়ে এসেছে এমন পিলে চমকানো তথ্য।

দায়েরকৃত মামলায় ওই নারী অভিযোগ করেন, তার বাবা-মা অসুস্থ থাকার কারণে তিনি তাদের জমিজমা ও সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে রাজউক অফিসে যাতায়াত করতেন। যাতায়াতের সুবাদে তার সঙ্গে পরিচয় হয় রাজউকের কর্মচারী দেবাশীষের। পরবর্তীতে ওই নারীর বাবা মারা যান। এমন পরিস্থিতিতে দেবাশীষ পরিকল্পিতভাবে ওই নারীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।

সম্পর্কের সূত্র ধরে দেবাশীষ ওই নারীকে পূর্বাচল ও ঝিলমিল হাউজিং প্রকল্পে পস্নট পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। দেবাশীষের কথায় বিশ্বাস করে ওই নারী তার দু'টি ফ্ল্যাট বিক্রির ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ১৫০ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রির ১ কোটি ২০ লাখ টাকা, একটি পস্নট বিক্রির ২ কোটি ১০ লাখ টাকা, সঞ্চয়পত্র বিক্রির ৫০ লাখ টাকা, প্রাইভেট কার বিক্রির ১০ লাখসহ মোট ৮ কোটি ৮০ লাখ দেবাশীষকে দেন।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, পরবর্তীতে দেবাশীষ পস্নট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলে নানা টালবাহানা করতে থাকেন। একপর্যায়ে ওই নারী টাকা ফেরত চান। দেবাশীষ টাকা ফেরত দিতে রাজি না হয়ে পস্নট দেওয়ার কথা বলে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। একদিন ওই নারী দেবাশীষকে টাকা ফেরত দিতে চাপ দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে দেবাশীষ উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে ওই নারীকে মারধর করেন। এ ঘটনায় ওই নারী বাদি হয়ে রামপুরা থানায় মামলাটি দায়ের করেন। ওই নারী মামলাটি ডিবি পুলিশকে ছায়া তদন্ত করতে লিখিতভাবে আবেদন করেন।

মামলাটির ছায়া তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের দক্ষিণ বিভাগের ফাইন্যানসিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। টিম লিডার পুলিশের উপকমিশনার মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, মামলা তদন্তের ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার রাতে দেবাশীষের অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ওইদিন গভীর রাতে রাজধানীর রামপুরা থানাধীন বনশ্রীর একটি বাড়ি থেকে দেবাশীষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করার সময় দেবাশীষের লাইফ স্টাইল দেখে রীতিমতো ভিমড়ি খাওয়ার যোগাড়। চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মচারীর লাইফ স্টাইল দেখে রীতিমতো হতবাক হয়েছি। তাকে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

দায়িত্বশীল একজন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দেবাশীষের লাইফ স্টাইল বড় বড় শিল্পপতিদের লাইফ স্টাইলকেও হার মানিয়েছে। মাঝারি ধরনের শিল্পপতিরাও এমন জীবনযাপনে অভ্যস্ত কি না সন্দেহ আছে।

দেবাশীষের পাসপোর্টসহ নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তিনি প্রতি মাসে অন্তত একবার বিদেশ যেতেন জুয়া খেলতে। সেই জুয়া কোনো সাধারণ জুয়া নয়। দুনিয়াব্যাপী জুয়ার বড় আসর হিসাবে পরিচিত ক্যাসিনোতে জুয়া খেলতেন তিনি। সম্প্রতি তিনি জুয়া খেলার উদ্দেশ্যে নেপালে গিয়েছিলেন। নেপালে প্রবেশের সময় তাকে আটক করে ইমিগ্রেশন বিভাগ।

দায়িত্বশীল ওই কর্মকর্তা আরও জানান, নেপালে ৫ হাজার ডলারের বেশি পরিমাণ অর্থ নিয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে আইনি নিষেধাজ্ঞা আছে। তিনি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ৩০ হাজার ডলার নিয়ে নেপালে ঢুকেছিলেন। এজন্য ইমিগ্রেশনে তাকে আটক দেয় দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ। অতিরিক্ত ডলার নেওয়ার অপরাধে তাকে প্রায় কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। কোটি টাকা জরিমানাও তিনি পরিশোধ করেন। একই সঙ্গে আইন অমান্য করায় তাকে ২৩ দিন নেপালের কারাগারে থাকতে হয়েছে। এরপর তিনি মুক্ত হয়ে নেপালে ক্যাসিনো খেলেছেন। ক্যাসিনোতে জুয়া খেলে বাংলাদেশি টাকায় ৭০ লাখ টাকা হেরেছেন। এরপর তিনি দেশে ফেরেন।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের দক্ষিণ বিভাগের ফাইন্যানসিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে দেবাশীষ আলিশান জীবনযাপন করার জন্য ব্যয় হওয়া অর্থ এবং বিদেশে ক্যাসিনোতে জুয়া খেলার সব অর্থই প্রতারণার মাধ্যমে যোগাড় করেছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। তার কাছ থেকে জব্দ হওয়া একটি মোবাইল ফোনেও প্রতারণামূলক নানা কর্মকান্ডের তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায়। দেবাশীষ একজন পেশাদার প্রতারক।

এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও জানান, দেবাশীষকে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। এদিকে বুধবার বিকালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতারণার দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া দেবাশীষকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে