শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার দুর্ঘটনা

বার্ন ইউনিটে এখনো চাপা কান্না

গাফফার খান চৌধুরী
  ২৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতদের ঘটনায় চাপা কান্না বিরাজ করছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। বিশেষ করে চিকিৎসাধীন স্বজনদের গগনবিদারী আর্তনাদে বার্ন ইউনিটের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আছে। রীতিমতো শোকের ছায়া নেমে এসেছে সেখানে। ইতোমধ্যেই ১৪ জনের মৃতু্য হয়েছে। চিকিৎসাধীন ১২ জনের মধ্যে ৬ জনের অবস্থা গুরুতর। তারা অনেকটাই জীবনমৃতু্যর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, সেখানকার ৫২০ নম্বর পোস্ট অপারেটিড ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ছয়জন। এদের মধ্যে দুইজন রীতিমতো মৃতু্যর সঙ্গে লড়ছেন। চিকিৎসকরা তাদের বাঁচার আশা এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছেন।

ওয়ার্ডের সামনে বিলাপ করে কাঁদছিলেন নাজমা বেগম (৩৬)। খানিকটা স্বাভাবিক হওয়ার পর বলেন, 'আমি গার্মেন্টসে কাজ করি। স্বামীর নাম আব্দুল কুদ্দুস (৪৫)। তার শরীরের ৮০ ভাগই পুড়ে গেছে। ডাক্তার সাহেব তার বাঁচার আশা এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছেন। স্বামীর নিশ্চিত মৃতু্য জেনেও প্রাণের মানুষের বেঁচে যাওয়ার আশায় দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেগে আছি। বলতে গেলে এক প্রকার স্বামীর মৃতু্যর প্রহর গুনছি।'

তিনি বলেন, 'কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে গেছে। আমি কী করব, কিছুই জানি না। আমি রীতিমতো দিশেহারা। স্বামীর কারণে আমি চাকরিতে যাই না। চাকরি চলে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ গার্মেন্টসের চাকরি বলে কথা! আমার পিতা সুরুজ আলী মারা গেছেন অনেক আগেই। গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট জেলার কালিগঞ্জ থানাধীন উত্তর মৌসুদ এলাকার মাদাতি গ্রামে।'

কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বলেন, 'আমার নাসিম নামে এক পুত্র ও ফেরদৌসী নামে এক মেয়ে আছে। ছেলে এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে। প্রায় দুই বছর ধরে সপরিবারে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানাধীন তেলিচালা এনায়েতের ওই বাড়ির একটি রুম মাসিক ১৭৬০ টাকায় ভাড়া নিয়ে বসবাস করছি। স্বামী পেপসি কোম্পানিতে দিনমজুর হিসাবে কাজ করতেন।'

কান্না জড়িত কণ্ঠেই তিনি বলছিলেন, 'ঘটনার পর থেকেই আমি হাসপাতালে আছি। চাকরি নেই। হাতে টাকা নেই। ঠিকমতো রোজা রেখে ইফতারি ও সেহরি খেতে পারছি না। সরকারের তরফ থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকা দিয়েছিল। তা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন কীভাবে চলছে একমাত্র উপরওয়ালা জানেন। ইতোমধ্যেই অনেক ঋণ করে ফেলেছি। মানবিক কারণে মানুষ ধার দিয়েছে। আমারও তো উচিত দুঃসময়ে যাদের কাছ থেকে ধার নিয়েছি, তাদের টাকা ফেরত দেওয়া। কীভাবে দিব, সেই চিন্তায় আমি দিশেহারা। স্বামীর অবস্থা যদি ভালোর দিকে থাকত, তবুও মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। এখন আর কোনো সান্ত্বনাই খুঁজে পাচ্ছি না।' তিনি আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।

ওয়ার্ডটির সামনে গাউন পরিহিত অবস্থায় অঝোরে কাঁদছিলেন রত্না বেগম (২৩) নামে আরেক নারী। তিনি বলছিলেন, 'আমার স্বামী কবির হোসেন (৩০) ও একমাত্র মেয়ে রাহিমা ওরফে রহিমা (৩) দু'জনই মৃতু্যর সঙ্গে লড়ছে। আমি মাঝখানে নিরুপায় হয়ে শুধু বসে আছি। আমার সঙ্গে কেউ নেই। মেয়ে ১০ তলায় শিশু ওয়ার্ডে আর স্বামী ৫ তলায় চিকিৎসাধীন। দশতলা আর পাঁচতলা দৌড়াতে দৌড়াতেই আমার কখন দিন হয় কখন রাত হয় বুঝতে পারি না।'

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'মাত্র ৫ বছরের বিবাহিত জীবন আমার। স্বামীর বাড়ি নরসিংদীতে। তার আপন বলতে কেউ নেই। আমার বাড়ি নাটোর জেলা সদরের হবিতপুর গ্রামে। মাত্র এক মাস আগে কাজের সন্ধানে নরসিংদী থেকে গাজীপুরে আসি। মাসিক ২ হাজার টাকা ভাড়ায় একটি রুমে উঠি। আমি গার্মেন্টসে চাকরি করি। স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। গার্মেন্টস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতেই আমার স্বপ্ন শেষ। বাসায় কাছে গিয়ে দেখি স্বামী মেয়েকে কোলে নিয়ে গড়াগড়ি দিয়ে অনেক বাঁচার চেষ্টা করছেন। স্বামীর শরীরের ৪৫ ভাগ পুড়ে গেছে। আর মেয়ে রাহিমার (রহিমা) শরীরের ১০ ভাগ পুড়ে গেছে। স্বামীর অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে বলে ডাক্তাররা জানিয়েছেন। সরকার যে সাড়ে ৭ হাজার টাকা দিয়েছিল তা আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন চলছি ধার দেনার উপরে। এভাবে

কতদিন চলতে পারব জানি না।'

জীবন-মৃতু্যর সন্ধিক্ষণে থাকা চিকিৎসাধীন রাজমিস্ত্রি মুন্নাফ (১৮) ও তার ফুপাতো ভাই তারেক রহমান (১৭)। মুন্নাফের ভাই ইকরাম বলছিলেন, 'তার পিতার নাম হবিবর রহমান। মায়ের নাম রহিমা বেগম। পিতা রিকশা চালায়। বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপাড়া থানাধীন ভবানীপুর গ্রামে। ভাই-ভাবীর সঙ্গে গাজীপুরের ওই বাসায় থাকি। আমিও পেশায় রাজমিস্ত্রি। ফুপাতো ভাইও রাজমিস্ত্রির কাজ করত। ঘটনার সময় ভাই একাই বাসায় ছিল। ভাবী গার্মেন্টসে ছিল। বাসায় ফিরে দেখি সব শেষ। সরকারের তরফ থেকে দেওয়া সাড়ে ৭ হাজার টাকা অনেক আগেই শেষ। এখন ধার-দেনা করে চলছি। কাজে যেতে পারি না। তাই রোজগারও নেই। ভাইকে তো ফেলে যেতে পারি না।'

চিকিৎসাধীনদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতালের তরফ থেকে রোগীদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। তবে রোগীরা সেই খাবার খেতে পারেন না। কারণ তাদের শ্বাসনালী প্রায় পুড়ে গেছে। অনেককেই সু্যপ দেওয়া হচ্ছে। তবে রোগীর স্বজনদের কোনো খাবার দেওয়া হয় না হাসপাতাল থেকে। বাইর থেকে খাবার কিনে খেয়ে কোনো মতে রোজা রাখছেন ও ইফতার করছেন। ইতোমধ্যেই প্রত্যেক রোগীর পেছনে প্রতিটি পরিবারের ব্যক্তিগতভাবে অন্তত ২০ হাজার টাকা করে খরচ হয়ে গেছে। সরকার যদি বিষয়টি মানবিকভাবে দেখে তাহলে পরিবারগুলোর খুব উপকার হয়। তা না হলে অনেকেই আর হাসপাতালে থাকতে পারবেন না।

গাজীপুরের ভয়াবহ দুর্ঘটনা সম্পর্কে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান বার্ন চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমি বহু বছর ধরে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করার কথা বলে আসছি। এমনকি গ্যাস সিলিন্ডারের সঙ্গে যুক্তদের এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। যথাযথ নিয়ম মেনে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডারের কারিগরি ত্রম্নটি আছে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে বিক্রেতাদের সিলিন্ডার বিক্রি করা উচিত। একই সঙ্গে গ্রাহকদেরও এ ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে। যাতে করে বিক্রেতা ত্রম্নটিপূর্ণ কোনো সিলিন্ডার বিক্রি করতে না পারেন। মোট কথা ক্রেতা, বিক্রেতা ও ব্যবহারকারীদের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটার সম্ভবনা থেকেই যাবে।'

শনিবার বিকালে বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক মো. তরিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, চিকিৎসাধীন ১২ জনের কেউই আসলে আশঙ্কামুক্ত নন। এর মধ্যে শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া কুদ্দুস (৪৫), ৪০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া লালন (২৪), ৪০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া শিশু নাঈম (১২), ৫৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়া নাদিমের (২২), ৩২ শতাংশ পুড়ে যাওয়া শিশু নিরব (৭) ও ৪৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়া কবিরের (৩০) অবস্থা বেশি গুরুতর।

চিকিৎসাধীন অন্যদের মধ্যে ৪০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া মুন্নাফ (১৮), ২৫ শতাংশ করে পুড়ে যাওয়া সুমন (২৫) ও শিল্পী (৪০), ৮ শতাংশ করে পুড়ে যাওয়া ৩ বছর বয়সি শিশু নিলয় ও রাহিমার (রহিমা) এবং ২০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া তারেক রহমানের (১৭) অবস্থার দিন দিন উন্নতির দিকে।

প্রসঙ্গত, গত ১৩ মার্চ বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানাধীন তেলিরচালা এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধদের মধ্যে ৩২ জন বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। সবশেষ গত ১৯ মার্চ মারা যান কমলা খাতুন (৬৫)। তার আগে মারা যান সোলাইমান মোলস্না (৪০), মনসুর আলী (৪৫), তায়েবা (৩), আরিফুল ইসলাম (৪০), মহিদুল (২৫), নার্গিস খাতুন (২৫), জহিরুল ইসলাম কচি (৪০), মোতালেব (৪০), সোলায়মান (৯), রাব্বি (১৩), তাওহীদ (৭), ইয়াসিন আরাফাত (২১) ও মশিউর রহমান (২২) সবমিলিয়ে মোট ১৪ জনের মৃতু্য হয়েছে। গত ২০ মার্চ পর্যন্ত অবস্থার উন্নতি হওয়ায় চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়েছে আজিজুল (২৪), শারমীন (১২), রত্না (৪০), রমিসা (৩৬), সাদিয়া খাতুন (১৮) ও সাফিয়া (৮)।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে