শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
৪ থেকে ৬ ডিজিটের নম্বর থেকে আসা কল রিসিভ না করার পরামর্শ

ফাঁদে ফেলে হ্যাক করা হচ্ছে ইমেইল ও ফেসবুক আইডি

গাফফার খান চৌধুরী
  ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
ফাঁদে ফেলে হ্যাক করা হচ্ছে ইমেইল ও ফেসবুক আইডি

ভালো ব্যবহারের ফাঁদে ফেলে হ্যাক করা হচ্ছে ইমেইল ও ফেসবুক আইডি। সম্প্রতি বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম্পিউটার থেকে সরাসরি কল করা হচ্ছে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের। ফোন রিসিভ করে চার বা ছয় ডিজিটের নম্বর বলে দেওয়ার পর মুহূতেই হ্যাক হয়ে যেতে পারে ওই ব্যক্তির ইমেইল ও ফেসবুক আইডি। এজন্য চার থেকে ছয় ডিজিটের নম্বর থেকে আসা ফোন রিসিভ না করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রযুক্তিবিদ, বিটিআরসি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার বিভাগসহ সংশ্লিষ্টরা।

সোমবার বেলা সাড়ে ৩টায় এক ব্যক্তির কাছে আগে যোগ চিহ্ন সংবলিত ছয় ডিজিটের নম্বর থেকে কল আসে। তাৎক্ষণিকভাবে ওই ব্যক্তি ফোন রিসিভ করতে পারেননি। প্রায় ১৫ মিনিট পর সরাসরি মোবাইল ফোন নম্বর থেকে তার ফোনে কল আসে। ফোন রিসিভ করতেই পুরুষ কণ্ঠে সালাম দিয়ে বলা হয়, 'আমি বগুড়া থেকে বলছি। পেশায় আমি একজন কাপড় ব্যবসায়ী। আপনি কি চট্টগ্রামের কাপড় ব্যবসায়ী সোহরাব সাহেব বলছেন? উত্তরে কল রিসিভকারী জানান, না। আমি তাকে চিনি না'।

এরপর অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কল করা ব্যক্তি বলেন, 'আপনার কাছে যে নম্বরটি থেকে ফোন গিয়েছিল, সেটি মূলত একটি কোড নম্বর। এই কোড নম্বরটি চট্টগ্রামের ওই কাপড় ব্যবসায়ীকে পাঠানোর কথা। কোড নম্বর না জানতে পারলে ওই ব্যবসায়ী কুরিয়ার সার্ভিস থেকে কাপড় নিতে পারবেন না। ঈদের আগে তো, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আপনার ফোনে কলটি ঢুকে পড়েছে। ওই ব্যবসায়ীর নম্বরের সঙ্গে আপনার মোবাইল নম্বরের মিল থাকায় ঘটনাটি ঘটেছে'।

আরও বলা হয়, 'আপনি যদি দয়া করে যে নম্বর থেকে ফোনটি গিয়েছিল, সেই নম্বরটি বলেন তাহলে অনেক উপকার হবে। অন্যথায় অন্তত ৮ হাজার টাকার ক্ষতি হবে আমার। মানবিক কারণে ফোন নম্বরটি দিলে খুবই কৃতজ্ঞ থাকব'।

এমন কথোপকথনে ফোন রিসিভকারীর মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, আপনি ফোন করে আপনিই নম্বর চাইছেন, এ কেমন কথা! এমন কথায় ফোনের লাইন কেটে দেন কল করা ওই ব্যক্তি। এরপর আবার চার ডিজিটের একটি নম্বর থেকে ফোন আসে। পরে সেটি আর তিনি রিসিভ করেননি।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে অক্টাগ্রাম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রযুক্তিবিদ হাসান শাহরিয়ার ফাহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, এটি সম্পূর্ণ একটি নতুন প্রযুক্তি। হ্যাকাররা তাদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। সম্প্রতি তারা অভিনব এই কৌশলে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের সরাসরি ফোন করছে। তারা অত্যন্ত সুন্দর ব্যবহারের ফাঁদে ফেলে ওইসব ব্যক্তির কাছ থেকে যে নম্বর থেকে ফোন করেছিল, সেই নম্বরটি জেনে নিচ্ছে। এটি মূলত একটি কোড নম্বর।

এই প্রযুক্তিবিদ জানান, যেটি মূলত ওই ব্যক্তির ইমেইল বা ফেসবুক আইডির শেষের কয়েকটি সংখ্যা বলে হ্যাকাররা প্রাথমিকভাবে ধরে নেয়। নম্বরগুলো বলে দিলে হ্যাকারদের পক্ষে ওই ব্যক্তির ইমেইল ও ফেসবুক আইডি হ্যাক করতে সুবিধা হয়। কোড নম্বরটি তারা টার্গেটকৃত ব্যক্তির ইমেইল বা ফেসবুকের পাসওয়ার্ডের সঙ্গে মিলিয়ে রিসেট বা পুনস্র্থাপন করার চেষ্টা করে। নানাভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নম্বর পরিবর্তন করে কয়েক দফায় চেষ্টার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সফলও হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে প্রযুক্তিগত নানা বিষয় নিয়ে কাজ করা এই প্রযুক্তিবিদ আরও জানান, ৪ থেকে ৬ পর্যন্ত সংখ্যা থেকে সাধারণত কলগুলো আসে। এসব নম্বরের আগে অবশ্যই যোগ চিহ্ন থাকবে। কল যারা রিসিভ করবেন তাদের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য এ ধরনের ডিজিট থেকে মোবাইল ফোনে কল এলে রিসিভ না করাই সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। তবে কেউ কল রিসিভ করলে তার উচিত চার বা ছয় ডিজিটের নম্বরটি না বলা। চার বা ছয় ডিজিটের নম্বর থেকে আসা নম্বরে ফোন করলে তাদের আর পাওয়া যাবে না। এমনকি তাদের কল করাটাও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এসব কল আসে কম্পিউটারের বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে।

তিনি আরও জানান, কেউ ফোন রিসিভ না করলে হ্যাকাররা বা স্ক্যামাররা বিশ্বস্ততা অর্জন করার জন্য মোবাইল ফোন থেকে সরাসরি কল করে। এ ধরনের কল রিসিভ করলেও, ৪ বা ৬ ডিজিটের নম্বর বলা কোনোভাবেই উচিত না। সাধারণত যাদের ফেসবুক বা ইমেইল আইডির পাসওয়ার্ড দুর্বল থাকে তাদেরই টার্গেট করে অভিনব এই হ্যাকার বা স্ক্যামার চক্রের সদস্যরা। এজন্য ফেসবুক বা ইমেইলের পাসওয়ার্ড জটিল করার কথা বলা হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। এমনকি বিভিন্ন অফিস আদালতে এ নিয়ম পালিত হচ্ছে। ছোট-বড় নানা অক্ষরের পাশাপাশি এলোমেলো সংখ্যা দিয়ে পাসওয়ার্ড তৈরি করলে এ ধরনের বিপদ এড়ানো সম্ভব। জটিল পাসওয়ার্ড মনে রাখা সম্ভব না হলে প্রয়োজনে নিজস্ব গোপন জায়গায় লিখে রাখার পরামর্শও দেন তিনি।

প্রযুক্তিবিদ হাসান শাহরিয়ার ফাহিম আরও জানান, আগে হ্যাকাররা টার্গেটকৃত বিভিন্ন ব্যক্তির মোবাইল ফোন নম্বরে মেসেজ পাঠাত। সেই মেসেজের পর কল করে ওই ব্যক্তির কাছে মোবাইল ফোন নম্বর বা বার কোড বা কোড নম্বর সম্পর্কে জানতে চাইত। এ ছাড়া নানা আকর্ষণীয় লিঙ্ক পাঠাত। লিঙ্কের ওপরের দিকে খুবই আকর্ষণীয় ছবিও ব্যবহার করত। অনেকেই কৌতূহলবশত এসব লিঙ্কে ক্লিক করতেন। ক্লিক করলেই ওই ব্যক্তির ফেসবুক বা ইমেইল আইডি সম্পর্কে নানা তথ্য পেয়ে যেত হ্যাকাররা। এরপর ইমেইল ও ফেসবুক আইডি হ্যাক করত। হ্যাক করা আইডি ব্যবহার করে তারা রীতিমতো বস্ন্যাকমেইল করত।

এই প্রযুক্তিবিদ জানান, আপত্তিকর ছবিসহ নানা কিছু যোগ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব আইডি ফিরিয়ে দিতে হ্যাকাররা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত হ্যাক হওয়া আইডির মালিকের কাছ থেকে। মানুষ সচেতন হওয়ায় পুরনো সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য হ্যাকার বা স্ক্যামাররা নতুন এই কৌশল নিয়েছে। সম্প্রতি হ্যাকার ও স্ক্যামারদের এমন বহু গ্রম্নপ কাজ করছে। তাই ইমেইল ও ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড শক্তিশালী করা উচিত ব্যবহারকারীদের। অন্যথায় হ্যাকারদের কবলে পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে।

এসব বিষয়ে সিআইডির সাইবার বিভাগের অ্যাডিশনাল ডিআইজি রেজাউল মাসুদ যায়যায়দিনকে বলেন, এটি মূলত হ্যাকার বা স্ক্যামারদের নতুন একটি কৌশল। এমন বেশকিছু অভিযোগ এসেছে অনেকের কাছ থেকেই বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে এ ধরনের নম্বর থেকে ফোন এলে রিসিভ না করার পরামর্শও দেন তিনি।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ খলিল-উর-রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, সাইবার অপরাধীদের এটি একটি নতুন ধরনের কৌশল। এ ব্যাপারে বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট টিম কাজ করছে। আপাতত ৪ থেকে ৬ নম্বরের ডিজিট থেকে আসা ফোন কল রিসিভ না করাই ভালো। কারণ এতে সাইবার ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে