বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১
প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী উদ্বোধন

বিএনপির চিন্তাধারা ছিল আমরা হাত পেতে চলব : প্রধানমন্ত্রী

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনীর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান -ফোকাস বাংলা

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, '১৯৯৮ সালের বন্যায় আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা বলেছিল- আমরা এ দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারব না। দুই কোটি মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। আমি তখন চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলেছিলাম- আলস্নাহর রহমতে একটি মানুষকেও না খেয়ে মরতে দেবো না। আর বিএনপির চিন্তাধারা ছিল, আমরা প্রতিনিয়ত অন্যের কাছে হাত পেতে চলব, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকব, আর ভিক্ষা চেয়ে খাবার এনে খাব।'

বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের পাশে পুরনো বাণিজ্য মেলার মাঠে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনীর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার কথা উলেস্নখ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'আমাদের দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু রেডক্রিসেন্টের সহায়তা নিয়ে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষকে বাঁচাতে সাইক্লোন শেল্টার করেছেন, তেমনি গবাদিপশু রক্ষায় বিভিন্ন স্থানে মাটির কিলস্না বানানোর নির্দেশ দেন। মানুষই এর নাম দেন 'মুজিব কিলস্না'।

তিনি বলেন, 'স্বাধীনতার পর কোনো এক সাংবাদিক জাতির পিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- আপনার তো কোনো সম্পদ নেই, আপনি কী দিয়ে এ দেশ গড়ে তুলবেন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, 'আমার মাটি আছে, মানুষ আছে। এই মাটি-মানুষ দিয়েই এই বাংলাদেশ গড়ে তুলব।'

বঙ্গবন্ধুর উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, '১৯৭৩ সালে উন্নত মানের গবাদিপশু আনার জন্য বঙ্গবন্ধু অস্ট্রেলিয়া থেকে অধিক উৎপাদনশীল ফ্রিজিয়ান ও জার্সি জাতের গাভি ও ষাঁড় আমদানি করেন এবং বাংলাদেশে কৃত্রিম প্রজননের সূচনাও বঙ্গবন্ধু করে দিয়ে যান।'

প্রথম সরকারের অভিজ্ঞতা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, '১৯৯৬ সালে যখন সরকার গঠন করি, তখন দেখি ৪০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি। আর তা ছাড়া প্রাণী-পশুর খাদ্যের তো অভাবই। এই অবস্থায় আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম। তখন রিজার্ভ মানিও তেমন ছিল না। মুদ্রাস্ফীতিও বেশি ছিল। এশিয়াও খাদ্যমন্দা। ওই অবস্থায় যাত্রা শুরু করি। লক্ষ্য ছিল কারও কাছে হাত পেতে চলব না। নিজের ফসল নিজে উৎপাদন করব। বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন, 'আমরা কারও কাছে ভিক্ষা চাইব না, কারণ ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না।' আমরা মানসম্মান নিয়েই বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলতে চাই। সেই আদর্শে আমরা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছি।'

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, '২০০১ সালে আমার সরকারের মেয়াদ শেষ হলে যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করি, তখন ২৬ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ত রেখে গিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য, ২০০৯ সালে যখন আমরা আবার ক্ষমতায় আসি, তখন দেখি ২৬ লাখ মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত তো দূরের কথা বরং বাংলাদেশে ৩০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি।'

বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'সংসদে যেদিন ঘোষণা দিলাম বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তখন বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া বসা ছিলেন। আর অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান উঠে

দাঁড়িয়ে বলল, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া ভালো না। তাহলে খাদ্যে সাহায্য পাওয়া যাবে না। তাদের চিন্তাধারা ছিল আমরা প্রতিনিয়ত অন্যের কাছে হাত পেতে চলব, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকব, আর ভিক্ষা চেয়ে খাবার এনে খাব।'

১৯৯৮ সালের মতো দীর্ঘস্থায়ী বন্যা আর কখনও বাংলাদেশে হয়নি উলেস্নখ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'গবাদিপশু থেকে শুরু করে মৎস্যসম্পদ নষ্ট হয়, শিল্পকারখানা অচল হয়ে পড়ে। তখন আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা বলেছিল, বাংলাদেশ এ দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারবে না। দুই কোটি মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। আমি তখন এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আলস্নাহর রহমতে একটি মানুষকেও না খেয়ে মরতে দেবো না।'

তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, '২০০৬ সালে বিএনপির আমলে গবাদিপশুর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪ কোটি ২৩ লাখ। এখন ৭ কোটি ৯৮ লাখ। প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। তাদের আমলে পোলট্রি ছিল ১৮ কোটি ৬ লাখ, এখন তা ৫২ কোটি ৭৯ লাখ। অর্থাৎ আমরা চরা গুণ বৃদ্ধি করেছি। সেই সাথে লবণ, চা, দুধসহ সবকিছুই আমরা বৃদ্ধি করেছি। দুধ সাত গুণ বৃদ্ধি করেছি। আমরা মাংস আট গুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। ডিম উৎপাদন চার গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আগে ৫৬২ কোটি ৩০ লাখ ছিল, এখন ২ হাজার ৩৩৭ কোটি ৬৩ লাখ ডিম উৎপাদিত হয়। আমরা কৃষি খাতে ব্যাপকভাবে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছি।'

কৃষি গবেষণা ও উৎপাদনে সফলতার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'এখন অন্তত বলতে পারি, মাছ-ভাতের অভাবটা নাই, ডাল-ভাতেরও অভাব নাই। তবে মানুষের চাহিদা এখন মাংস।'

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ?'আমাদের আগে যারা ক্ষমতায় ছিলেন, যেমন খালেদা জিয়া ঘোষণা দিল যে দেশের মানুষকে ডাল-ভাত খাওয়াবে। সেই ডাল-ভাত খাওয়াতেও কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর ২০০৭ সালে আসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ফখরুদ্দীন সাহেব প্রধান উপদেষ্টা, ইয়াজউদ্দিন রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান মঈন উদ্দিন। মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন আবার ঘোষণা দিলেন আলু খাওয়ার জন্য। হাজার পদের আলুর নানা রকমের তালিকা তৈরি করা হলো এবং তার আবার প্রদর্শনী হলো। বেশ উন্নত হোটেলে। মানুষ ভাত পাচ্ছে না তাতে কী! আলু খাবে।'

তিনি বলেন, 'কেউ আমাদের ডাল-ভাত খাওয়াতে চাইল, কেউ আমাদের আলু খাওয়াতে চাইল, মাছে-ভাতে বাঙালি আমরা; আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি, মাছ-ভাত পেলেই তো যথেষ্ট। সেটাই তো আমরা চাই। সেটাই তো আমাদের লক্ষ্য। কাজেই আমরা সেদিকে দৃষ্টি দিয়েছি। এখন অন্তত বলতে পারি, মাছ-ভাতের অভাবটা নাই, ডাল-ভাতেরও অভাব নাই। তবে মানুষের চাহিদা এখন মাংস। আরও বড় বড় মাছ, সব কিছু খাবে।'

শেখ হাসিনা আরও বলেন, 'অনেক হারিয়ে যাওয়া দেশি মাছ গবেষকরা গবেষণা করে করে সেগুলো কিন্তু আজকে উৎপাদন করছেন। আমরা আমাদের অনেক প্রায় বিলুপ্ত মাছ আবার ফিরে পাচ্ছি। গবেষণা ছাড়া কোনো দেশ এগিয়ে আসতে পারে না, এটাই হলো বড় কথা। তাছাড়া মুরগির ক্ষেত্রেও গবেষণা করে বিভিন্ন ধরনের পাখি এখন উৎপাদন হচ্ছে। শুধু ডিমই না, মাংসও এখন মানুষ খেতে পাচ্ছে।'

প্রোটিনের স্থানীয় চাহিদা মেটাতে ডেইরি ও পোলট্রি খাতকে আরও সমৃদ্ধ করতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান বলেন, 'এখন দেখি জিনিসের দাম নিয়ে চিন্তিত, পেঁয়াজের দাম বাড়ল কেন? আমাদের কিন্তু ৯০ ভাগ পেঁয়াজই আনতে হতো ভারত থেকে, সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলাম। ভোজ্যতেল ৯০ ভাগ আনতে হয় বিদেশ থেকে। কেন আনতে হবে? নিজের দেশে আমরা তো উৎপাদন বাড়াতে পারি। তবে এবার সুখবর হলো, আমাদের গবেষণার মধ্য দিয়ে সর্ষের উন্নত জাত নিয়ে আসা হয়েছে। আজকে আমাদের সর্ষে উৎপাদন ভালো হচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'সরিষার তেল হচ্ছে, যেটা হার্টের জন্য সব থেকে নিরাপদ। সেই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চালের তুষ থেকে যে তেলটা হয়, সেটা হচ্ছে। তিলের তেল, আমরা আরও বহুমুখী করতে পারি বা করার সে সুযোগ আরও আছে। আমরা এখন করেও যাচ্ছি।'

উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী ঘুরে ঘুরে প্রদর্শনী পরিদর্শন করেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ প্রদর্শনীতে দর্শনার্থীরা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ঘুরতে পারবেন। প্রবেশমূল্য ছাড়াই তারা প্রবেশ করতে পারবেন মাঠে। দুই দিনব্যাপী প্রদর্শনী শেষ হচ্ছে আজ শুক্রবার।

সারাদেশের পোলট্রি ও ডেইরি খামারিরা মেলায় তাদের গবাদি পশু-পাখি প্রদর্শনের জন্য যোগ দিয়েছেন। একই সময়ে ৬৪ জেলার ৪৬৬টি উপজেলায় অনুরূপ মেলার আয়োজন করা হয়েছে।

প্রদর্শনীতে দেশের বিভিন্ন জাতের প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনের জন্য প্রদর্শনী ময়দানে প্রায় ২৫টি প্যাভিলিয়ন ও ৩০টি স্টল স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি প্যাভিলিয়ন সরকারি কর্তৃপক্ষের।

মেলায় ঢাকা, কুমিলস্না, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, যশোর, বেনাপোল, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গাসহ অন্যান্য জেলা থেকে বিডিএফএ'র মোট ৫৫ হাজার সদস্যের মধ্যে তিন হাজারের বেশি কৃষক মেলায় যোগ দিয়েছেন।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম উদ্দিন।

অন্যান্যের মধ্যে দেশের ডেইরি খাতের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি ইমরান হোসেন এবং পোলট্রি খাতের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) যুগ্ম আহ্বায়ক মশিউর রহমান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে