বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

হালদায় ভয়াবহ দূষণে মরছে মা মাছ-ডলফিন

হুমকিতে জীববৈচিত্র্য উৎকণ্ঠায় পরিবেশবাদীরা
মীর আসলাম (চট্টগ্রাম), রাউজান
  ০১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
হালদায় ভয়াবহ দূষণে মরছে মা মাছ-ডলফিন
হালদায় ভয়াবহ দূষণে মরছে মা মাছ-ডলফিন

চট্টগ্রাম শহরের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া হালদা নদীতে একের পর এক মা মাছ মরে ভেসে উঠছে। রোববার সকালে সর্বশেষ মাছটি ভেসে ওঠে নদীর রাউজান অংশের আজিমের ঘাট এলাকায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন ভেসে ওঠা মা মাছটির ওজন প্রায় ২০ কেজি। শরীরে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে মারা গেছে ৪টি রুই জাতীয় মা মাছ ও একটি ডলফিন। মাছ ও ডলফিনের এই মৃতু্যর মিছিল বঙ্গবন্ধু হ্যারিটেজ ঘোষিত দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, নদীদূষণ, মাছ শিকারের জন্য বিষ প্রয়োগ, রাবার ড্যামে জমে থাকা রাসায়নিক ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি এবং মা মাছ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কারণে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদার জৈববৈচিত্র্য ধ্বংসের পথে। এ কারণে হালদায় মা মাছ ও ডলফিনের অস্বাভাবিক মৃতু্যর ঘটনা ঘটছে। এ জন্য দায়ী হালদা তীরবর্তী রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার মাছ চোররা। যারা রয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়।

1

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হালদা নদীতে প্রাকৃতিকভাবে মা মাছ ডিম দিয়ে আসছে আদিকাল থেকে। প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে একাধিক দফায় মাছ ডিম দেওয়ার নজির

আছে। নদী পাড়ের অনেক মানুষ মৌসুমি ডিম সংগ্রহ করে অতি কষ্টে পোনায় রূপান্তরের পর সদ্য পোনা পানিসহ বিক্রি করে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত কেজিতে।

অভিযোগ রয়েছে, নগর ও হাটহাজারীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য এই মৎস্য ক্ষেত্রে এসে পড়ে নদীর পানিকে দূষিত করছে। বিগত প্রায় দেড় দশক থেকে নদীতে নেমে আসা এসব শিল্পবর্জ্য হালদার জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। পানিতে বিষক্রিয়ায় মা ডলফিন মরে এসব প্রাণির সংখ্যা কমে গেছে। এখন মৎস্যজীবীরা নদীতে ডিম সংগ্রহ করতে নেমে কাঙ্ক্ষিত ডিম পাচ্ছেন না।

নদী পাড়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই বিশেষায়িত নদীটিকে গত মুজিব বর্ষে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছিল। এই নদীর জীববৈচিত্র্য ধরে রাখতে সরকারিভাবে নানা পরিকল্পনা নেওয়ার কথা তারা শুনে আসছেন। তবে এই নিয়ে কোনো বাস্তবতা তারা দেখছেন না। নদীর এমন পরিবেশের মধ্যে গত আট দিনে চার মা মাছ ও এক ডলফিনের মৃতু্য হালদা পাড়ের মৎস্যজীবীদের ভাবাচ্ছে। বর্তমান অবস্থায় হালদার জীববৈচিত্র্যে ভবিষৎ নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন পরিবেশবাদী ও হালদা বিশেষজ্ঞরা।

হালদা বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া হালদায় মাছ ও ডলফিন মৃতু্যর এই ঘটনায় ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'হালদা নদীর জলজপ্রাণী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি বহু বছর ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। নদীর জীববৈচিত্র্যের প্রতি হুমকি হয়ে থাকা নানা দূষণসহ অন্যান্য কারণ তুলে ধরে এগুলো বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে আসছি। কিন্তু এসব দাবি, অনুরোধ কর্তৃপক্ষ আমলে না নেওয়ায় আজ হালদা পাড়ের মানুষকে মা মাছের মৃতু্য দেখতে হচ্ছে। বিপন্ন প্রাণীর তালিকাভুক্ত এই নদীর আশ্রয়ে থাকা এই পর্যন্ত ৪১টি ডলফিনের মৃতু্য হয়েছে।'

তিনি ডলফিন রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য বন্য ও জলজ প্রাণী সংরক্ষণ বিভাগকে দায়ী করে বলেন, 'হালদা নিয়ে যাদের ধারণা নেই তাদের বিশেষজ্ঞ সাজিয়ে কাজ করতে গিয়ে হালদায় আশ্রয়ে থাকা ডলফিনগুলোকে মৃতু্যর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।' একই সঙ্গে তিনি নদীর মা মাছ রক্ষায় নদীর পানিকে দূষণমুক্ত করতে না পারায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য বিভাগের ব্যর্থতাকেও দায়ী করেছেন।

চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, 'কয়েক বছর থেকে পরিবেশবাদী, বিশেষজ্ঞদল হালদায় বিষাক্ত বর্জ্য নিয়ে বার বার সতর্ক করে বর্জ্যের উৎস চিহ্নিত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। সংশ্লিষ্টরা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো প্রতিদিন টনে টনে বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে এসে পড়ার ফলশ্রম্নতি জলজ প্রাণীগুলো বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার দৃশ্য আমরা দেখে যাচ্ছি।'

তিনি বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ নামকরণ করা এই বিশেষায়িত নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর দ্রম্নত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে