বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
সারাদেশে সংখ্যালঘুদের মন্দির ও সম্পদ দখলে চলছে লুটপাট

এক রাতেই পাল্টে গেছে চাঁদাবাজি-দখলবাজি

যাযাদি রিপোর্ট
  ০৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
এক রাতেই পাল্টে গেছে চাঁদাবাজি-দখলবাজি

সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর এক রাতেই পাল্টে গেছে সারাদেশের ফুটপাতের ব্যবসার চিত্র। এছাড়া মাদক বাণিজ্য, চোরাচালান, ইন্টারনেট-ডিস ব্যবসা, ঝুট ব্যবসা, পরিবহণে চাঁদাবাজির মতো ব্যবসা দখলে নিয়েছে বিএনপি-জামায়াতপন্থিরা।

অভিযোগ আছে, দীর্ঘদিন এসব ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্তরালে ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা। সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে শুধু এসব ব্যবসা-বাণিজ্যই নয়, এরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুরসহ লুটপাট চালাচ্ছে। এমনকি জমিজমা দখলের জন্য নানাভাবে চাঁদা দাবিসহ হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

1

তেজগাঁও এলাকার তিব্বত মোড় এলাকার কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানির সামনের রাস্তায় প্রায় তিন বছর ধরে বাদাম বিক্রি করেন আব্দুল হাই। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরব এলাকায়। প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার বাদামের ডালা নিয়ে আসেন সেই জায়গায়। এসেই তিনি দেখেন তার দোকান বসার স্থানে আরেকজন বাদাম-ট্টা ও শিমের বীচি বিক্রি করছেন। এমন দৃশ্যে তার মাথায় হাত পড়ে। আব্দুল হাই ওই বিক্রেতাকে বলেন, ভাই এখানে বাদাম বেচি তিন বছর ধরে। আমিও প্রতিদিন ২০ টাকা করে দিছি নেতাদের। পুলিশ ৫ থেকে ১০ টাকার বাদাম নিছে। আপনি অন্য জায়গায় যান। নতুন বাদাম বিক্রেতা তাকে বলে, 'দেশ বিজয় হইছে। আমি কলোনিবাজারের বিএনপির ওয়ার্ড কমিটির নেতা। এখন থেকে এখানে আমি ব্যবসা করবো। আমাদের পোলাপাইন চাঁদা নিবো। দৌড়া, নইলে পোলাপাইনরে মোবাইল করবো।' অনেক দুশ্চিন্তা নিয়ে এখান থেকে চলে যান বাদাম বিক্রেতা আব্দুল হাই।

শুধু আব্দুল হাই নয়, সারা দেশেই এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। এতদিন ক্ষমতাসীন নেতাদের হাতে থাকা ডিস ব্যবসা রাতারাতি যুবদল-ছাত্রদল দখল নিয়েছে। সকালে দেখা গেছে পাড়ায় পাড়ায় ডিশ লাইনের তার খুলে নতুন ডিশ লাইন লাগানো হচ্ছে। রাজধানীর মিরপুরের ১২ নম্বরের বি বস্নকে দীর্ঘদিন ধরে ডিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা। সোমবার রাত থেকে সেই ডিশ লাইন বন্ধ। এরপর সকাল ১১টার নতুন এক কোম্পানির ক্যাবলস থেকে ডিশ লাইনে সংযোগ দেওয়া হয়। বাসায় বাসায় নতুন ডিস লাইনের ভিজিটিং কার্ড দেওয়া হয়েছে।

ময়মনসিংহের ট্রাক চালক জসিম জানান, ময়মনসিংহ নেত্রকোনা সড়কের গাছতলা নামক স্থানে মঙ্গলবার সকাল থেকে গাড়ি থামিয়ে চাঁদা নিচ্ছে বিএনপিপন্থি পরিবহণ শ্রমিকরা। এমন দৃশ্য সারা দেশেই। আগে যারা চাঁদা নিত তারা পালিয়ে গেছে। নতুন করে দখল নিয়েছে বিএনপি-জামাতের তৃণমূল কর্মীরা।

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে সীমান্ত এলাকায় মাদক, চিনি, পোশাক ও কসমেটিকস চোরাচালানের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তারা রাতারাতি এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে আছেন। সেখানে বিএনপির স্থানীয় নেতারা মিছিল করে দখল নিয়েছেন। রাতারাতি বদলে গেছে পাথর, কয়লা ও বালু ব্যবসার দলখদারিত্ব। সব ব্যবসা দখল নিয়েছে বিএনপিপন্থিরা। স্থানীয় বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, ১৬ বছর ধরে ব্যবসা করতে পারিনি। দেশ স্বাধীন হইছে, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হবে- তাই আমরা আমাদের পুরনো ব্যবসা বুঝে নিছি।

গাজীপুরের শ্রীপুরে দীর্ঘদিন ধরে জমিজমা নিয়ে বিরোধ ছিল ভাইদের মধ্যে। এত দিন আওয়ামী লীগ নেতা বড় ভাইয়ের হাতে ছিল পুরো জমি। সরকারের পতনের পর একরাতেই দখল নিয়েছেন ছোট তিন ভাই। রাতারাতি তারা টিনের চালা তুলে জমি দখল নেন।

মঙ্গলবার সকালে সবজির ট্রাক নিয়ে ঢাকা কাওরান বাজারে আসেন বগুড়ার কাঁচামাল ব্যবসায়ী সফিকুল। তিনি বলেন, ঢাকায় আসতে আগে যেসব এলাকায় চাঁদা দিতে হতো, আজও সেখানে সেখানে চাঁদা দিয়ে আসতে হয়েছে। আগে যেখানে ৫০ টাকা দিলে হতো। আজ সেখানে ১০০ টাকা চাওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে অনেক জায়গায় কথা হয়েছে। চাঁদাবাজরা তাকে বলেন, আমরা ১৬ বছর ধরে না খেয়ে আছি, সরকার পালাইছে, তাই আমাদের বেশি করে দিতে হবে।

রাজধানীর নিউ মার্কেট, মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর, মিরপুর দুই নম্বর, গুলিস্তান, দৈনিক বাংলা এলাকার ফুটপাতের ব্যবসার চাঁদা নিচ্ছে বিএনপি-জামায়াতপন্থিরা। মিরপুর ১০ গোলচত্বরের ফুটপাতের পোশাক বিক্রেতা ছমির শেখ জানান, আগে যারা চাঁদা নিতো তারা আজ আসেনি। নতুন নেতার পরিচয় দিয়ে নতুন লোকেরা চাঁদা লইছে। তবে আজ পুলিশ চাঁদা নিতে আইনাই।

এই মোড়ে কথা হয় মিরপুর-সদরঘাট রুটে চলাচলকারী বিহঙ্গ বাসের ড্রাইভার মতিনের সঙ্গে। তিনি জানান, ১০ নম্বর গোলচত্বরে ২০ টাকা চাঁদা দিয়ে একজন লোক তুলছি। এখানে বিএনপি নেতা কাদির ভাইয়ের নামে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার যুবলীগের সাবেক নেতা সফিকুল বলেন, আমার চিংড়ি মাছের একটি ঘের আছে। এ নিয়ে থানায় গিয়েছিলাম মঙ্গলবার সকালে। যাবার পর দেখলাম আগে যারা আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দিয়ে দেন দরবার করতেন তারা নেই। সেখানে জামায়াতের লোকজনের আড্ডা দেখলাম। মনে হয় এখন থেকে তারা থানার দালালির কাজ শুরু করেছে।

শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি, মন্দির, জমিজমা, সম্পদ দখল নিয়েছে বিএনপি-জামায়াতপন্থি নেতাকর্মীরা। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

সোমবার রাতে দেশের ৩০ জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, মন্দিরসহ বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুরসহ অগ্নিসংযোগ ঘটায় বিএনপি-জামায়াত ও অন্যান্য সম্প্রদায়িক গোষ্ঠী।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, শেরপুরে শ্রীবর্দী উপজেলা যুব ঐক্য পরিষদের সভাপতির বাসায় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। খুলনায় রূপসা থানার হাইসগাতী গ্রামের শ্যামল কুমার দাস ও স্বজন কুমার দাসের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। একই জেলার ঐক্য পরিষদের সভাপতি বিমান বিহারী অমিত, যুব ঐক্য পরিষদের সভাপতি অনিমেষ সরকার রিন্টুর বাড়ি, দাকোপের বানিসান্তার আমতলীতে ইউপি সদস্য জয়ন্ত গাইনের বাড়ি, কয়রার দাসপাড়ায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

ফেনী শহরের দুর্গামন্দিরে হামলা হয়েছে ও দিনাজপুরের ফুলতলা শ্মশানঘাট জোরপূর্বক দখলে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এই জেলার পার্বতীপুর কালীমন্দিরসহ ৫টি মন্দির এবং বোচাগঞ্জে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়েছে। নরসিংদী পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা ব্যবসায়ী দিপক সাহার বাড়ি ও অফিসে হামলা হয়েছে। লক্ষ্ণীপুরের চন্দ্রগঞ্জে গৌতম মজুমদারের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে আগরপুর গ্রামে নকুল কুমার ও সুশান্তের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, চট্টগ্রামের রাউজানে উজ্জ্বল চক্রবর্তীর বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়, যশোরের অভয়নগরে ধোপাদি পালপাড়া গ্রামে তিনটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, বাঘারপাড়া নারিকেলবাড়িয়ায় চেয়ারম্যান বাবুল সাহার গোডাউনসহ ২২টি দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। সদর, বর্মণপাড়াসহ কেশবপুরে সংখ্যালঘুদের বাড়ি, সাতক্ষীরার কলারোয়ায় সংখ্যালঘুদের দোকানপাটে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে। জেলার ঐক্য পরিষদের সভাপতি বিশ্বজিৎ সাধুর বাড়ি এবং কেন্দ্রীয় নেতা ডা. সুব্রত ঘোষের বাড়িতে হামলা হয়েছে। হবিগঞ্জের শায়েস্তাগজ্ঞ বাজারে উপজেলা ঐক্য পরিষদের সভাপতি অসিত বরণ দাসের দোকান, লোহাগড়ায় সংখ্যালঘুর বাড়ি, বগুড়ায় বড়গোলা তিলপট্টিতে সংখ্যালঘুদের ৭টি দোকান, দুপচাঁচিয়ার সাহাপুকুর গ্রামের গৌতম মন্ডলের বাড়িতে হামলা হয়েছে। পটুয়াখালীর কুয়াকাটার রাধাগবিন্দ মন্দির ও অনন্ত মুখার্জির বাড়ি, পঞ্চগড়ের ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন বাড়িতে হামলা হয়েছে। হামলা, মারধর, ভাঙচুর, লুটপাটের পাশাপাশি শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে হাতিয়ার সোনাদিয়ায় সহদেব রায়ের বাড়িতে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে