বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
ফিরে দেখা ২০২৪

বছরজুড়েই প্রকৃতির বৈরী আচরণ

বীরেন মুখার্জী
  ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বছরজুড়েই প্রকৃতির বৈরী আচরণ
বছরজুড়েই প্রকৃতির বৈরী আচরণ

বিদায় নিতে যাওয়া বছরটি নানা কারণেই ঘটনাবহুল। এর মধ্যে ভয়াবহতা নিয়ে হাজির ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বছরের শুরুতে রেকর্ডমাত্রার তাপপ্রবাহে জনজীবন ছিল ওষ্ঠাগত। এছাড়া অতিবৃষ্টি, ভারী বৃষ্টি, কয়েকদফা উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যা, ভূমিধস, বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড়, ঘন ঘন ভূমিকম্পসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েছেন দেশের মানুষ। মারাও গেছেন অনেকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, রাস্তাঘাট, ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব কারণে কমে যাচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বছরের পর বছর এই দেশ যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে, তা ঠেকানোর উপায় নেই।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মোট দেশজ উৎপাদন কমে যাওয়া নিয়ে বলা হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষিখাত যতটা অবদান রাখছে তার এক-তৃতীয়াংশই হারিয়ে যাবে। কৃষিখাতের অবদান ১২ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে অবস্থান করছে, যেটি কমে ৮ থেকে ১০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া ২০৫০ সাল অব্দি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কার কথাও জানিয়েছে সংস্থাটি।

1

অন্যদিকে, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইইডি) নামে একটি থিঙ্ক ট্যাংক এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয় কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর মেরামত করতে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে মাথাপিছু ৬ হাজার ৬৮০ টাকা প্রতি বছর একটি পরিবারকে শুধু তাদের বাসস্থান মেরামতের জন্য ব্যয় করতে হয়।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে, এটা ঠেকানোর উপায় নেই। এটা হবেই। কারণ বিষয়টা হচ্ছে বৈশ্বিক পর্যায়ে। চলতি বছরের আশ্বিন মাসেও যে তাপমাত্রা দেখা গেছে, তাতে নতুন করে মাস্টারপস্ন্যান করে চলা ছাড়া উপায় নেই। আমরা কম কার্বন নিঃসরণ করেও ক্ষতিগ্রস্ত। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আমাদের অ্যাডাপটেশন পস্ন্যান করতে হবে।'

বছরের শুরুতে ছিল অস্বাভাবিক শীত

চলতি বছরের জানুয়ারিতে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও অস্বাভাবিক শীতের অনুভূতির কথা জানিয়েছিলেন বিভিন্ন স্তরের মানুষ। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এ বছর জানুয়ারিতে বেশি শীতের অন্যতম কারণ ছিল দীর্ঘ সময় ধরে কুয়াশা পড়া। অন্য বছরের তুলনায় এবার দীর্ঘ সময় ধরে ঘন কুয়াশা পড়তে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কুয়াশা ছিল। এই দীর্ঘ সময়ের কুয়াশার কারণে সূর্যের কিরণকাল কমে এসেছে। স্বাভাবিক সময়ে সূর্যের কিরণকাল ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা হলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে তিন-চার ঘণ্টায়। এতে ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হতে না পারায় দিনের ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য অনেকটাই কমে গেছে। ফলে শীতও বেশি অনুভূত হয়।'

এপ্রিলে ছিল ৭৬ বছরের রেকর্ড তাপপ্রবাহ

২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে স্মরণকালের ভয়াবহ তাপপ্রবাহ ভুগিয়েছে দেশের মানুষকে। তাপমাত্রা ওঠে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ৩০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, যা গত ২৯ বছর সর্বোচ্চ। এর আগে ১৯৯৫ সালের ১ মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ৪৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া এপ্রিল মাসে টানা ২৬ দিন যে তাপপ্রবাহ হয়েছে, তা গত ৭৬ বছরে হয়নি। তীব্র তাপদাহে এ বছর মৃতু্যর সংখ্যাও বেড়েছে। শুধু এপ্রিলেই মারা গেছে প্রায় ১৫ জন মানুষ।

শুধু তাপপ্রবাহ নয়, চলকি বছর সাগরে হয়েছে কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়। 'রিমাল' নামের ঘূর্ণিঝড়টি দীর্ঘক্ষণ দেশে অবস্থান করে ক্ষতির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ২৬ সন্ধ্যা থেকে ২৭ মে সকাল নাগাদ স্থলভাগ অতিক্রম করে এই ঝড়। ঘূর্ণিঝড় রিমাল উপকূলে আঘাত হানার পর থেকে প্রায় ৫০ ঘণ্টা পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে। রিমাল বিপজ্জনক সাইক্লোন ছিল না। কিন্তু তারপরও এর এত দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে দেশের সাত জেলায় ১৬ জন মানুষ মারা যায়। রিমালের তান্ডবে উপকূলের ছয় জেলার ১৫টি উপজেলায় ৬৯ হাজার ৭৮৮ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। এছাড়া অতিবৃষ্টিতে ১ লাখ ৭১ হাজার ১০৯ হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে।

রিমালের তান্ডবে উপকূলীয় ১৯টি জেলার প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পৌনে দুই লাখ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।

রেকর্ড বৃষ্টিতে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা

চলতি বছর স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়তে হয় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষকে। এর আগে ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন ফেনীর মানুষ। গত ৩৬ বছরে অনেকবার বন্যা হলেও এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি তাদের। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এবারের ভয়াবহ বন্যায় ১৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা জিডিপির দশমিক ২৬ শতাংশ। এরমধ্যে কৃষি ও বন খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। জেলা হিসাবে নোয়াখালীতে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ১৯১ কোটি টাকা।

২ মাস স্থায়ী ছিল নোয়াখালী-লক্ষ্ণীপুরের বন্যা

চলতি বছরে টানা দুই মাসের বেশি সময় ধরে আকস্মিক বন্যার পানিতে সীমাহীন কষ্টে জর্জরিত ছিল নোয়াখালী-লক্ষ্ণীপুরের ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা। আগস্ট মাস থেকে কিছুদিন পরপর সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টি 'মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা' ছিল বাসিন্দাদের জন্য। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, নোয়াখালী ও লক্ষ্ণীপুর অঞ্চলের রেকর্ড বৃষ্টি এই অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইনটেনসিটি, ফ্রিকোয়েন্সি, টাইমিং, ন্যাচার সবই এখন বদলাচ্ছে। এটা পৃথিবীজুড়েই হচ্ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রিতে যখন উঠবে, তখন সবকিছু আন প্রেডিকটেবল হয়ে যাবে। ফলে পূর্বাভাস দেওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এবারের দুর্যোগে তীব্র খাদ্য সংকটে পড়েন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলার মানুষ। এছাড়া বছরজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্যনিরাপত্তার শঙ্কাও বাড়িয়ে তোলে। বন্যার সময় আমন ধান লাগাতে পারেননি লাখ লাখ কৃষক। নোয়াখালী, কুমিলস্না অঞ্চলের বন্যার পর কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাজ ছিল রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চল থেকে ধানের চারা এনে এই অঞ্চলের জন্য প্রস্তুত রাখা যেন পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে চারা রোপণ করতে পারে। কিন্তু দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা সেটি করতে পারেনি।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, 'বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন বিশ্বজুড়ে। ফলে একের পর এক হিটওয়েভ (তাপপ্রবাহ), কোল্ডওয়েভ (শৈত্যপ্রবাহ), ভারী বৃষ্টিপাত, সাগরে ঘূর্ণিঝড়, আকস্মিক বন্যা হচ্ছে। এগুলো সব আবার কাঙ্‌িক্ষত। কোনোটি খুব বেশি অনাকাঙ্‌িক্ষত নয়। এসব আভাস আগে থেকে জানা ছিল।

অন্যদিকে, জলবায়ুর যে পরিবর্তন, সেটির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় পরিবেশ বিধ্বংসী যে কার্যকলাপ সেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও বিরূপ পরিস্থিতির দিকে নিচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায়।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে