বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বেক্সিমকোর চাকরিহারা ৫০ হাজার শ্রমিক এখন কী করবেন?

মন্তোষ চক্রবর্তী
  ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বেক্সিমকোর চাকরিহারা ৫০ হাজার শ্রমিক এখন কী করবেন?
বেক্সিমকোর চাকরিহারা ৫০ হাজার শ্রমিক এখন কী করবেন?

বেক্সিমকোর ৪নং গেইটের সামনে মামুন নগর একটি চা-দোকানে বসে আছেন ৫-৭ জন নানা বয়সি লোকজন। কেউ চা খাচ্ছে, কেউ সিগারেট টানছে, কেউ আবার বিষণ্ন হয়ে বসে আছেন। এদের মধ্যে কথা হয় মনির মিয়া নামের একজনের সঙ্গে। মনির মিয়া বগুড়ার ধনুট উপজেলার বাসিন্দা। গত চার বছর আগে স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে একটু ভালো থাকার আশায় আশুলিয়াতে চাকরি নেন বেক্সিমকোর নিউ ঢাকা-টু (গার্মেন্টস) সেকশনে। তিনি জানান, চাকরি করার সুবাদে এক ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে এখানেই একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। বেতন পেতেন ১৫ হাজার ৩৫ টাকা। এতে কোনোভাবে চলত তার সংসার। কিন্তু চলতি মাসের ১৫ তারিখ হঠাৎ করে কোম্পানি থেকে তাকে জানানো হয় ৪৫ দিনের লে-অফের কথা। এই ৪৫ দিন নাকি কোম্পানি থেকে অর্ধেক বেতন দেওয়া হবে, আর এই বেতন দিয়ে কেমনে সংসার চলবে, কেমনে বাসায় ভাড়া হবে এই চিন্তায় দিনরাত পার করছেন।

সাংবাদিক এসেছে শুনে কাছে আসেন এক তরুণী কোলে ছোট এক শিশু, করুণ সুরে সোনিয়া আক্তার নামের এই তরুণী জানান, বরিশালের বাবুগঞ্জ তাদের বাড়ি। ঢাকায় চলে আসেন সোনিয়া। কাজ নেন পতিত সরকারের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের কারখানায়। বেক্সিমকোর শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়ায় তিনি এখন বেকার। মাত্র দেড় মাসের এই শিশুকে নিয়ে কীভাবে সংসার সামলাবেন, কীভাবে তার বাসা ভাড়া দেবেন, এই দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম আসছে না। স্বামীর আয় না থাকায় এখন জীবনযুদ্ধে দেড় মাসের সন্তানকে নিয়ে তার টিকে থাকাই দায়। কথা হয় পারুল আক্তার নামের আরেকজনের সঙ্গে, তিনি অনেকটা কান্নাজড়িত সুরে বলেন, এই কোম্পানির গার্মেন্টস সেকশনে কাজ করে কোনোরকমে সংসারটা চালাতো। এখন এই চাকরিটা চলে যাওয়ার কারণে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে করতে শেষ। একদিকে সংসারের ভরণপোষণ, অন্যদিকে ৬ হাজার টাকা প্রতিমাসে বাসা ভাড়া কীভাবে দেবেন তিনি।

1

টাঙ্গাইলে নাগরপুর উপজেলার সাজ্জাদ হোসেন নামে আরেক ব্যক্তি জানান, তারা স্বামী-স্ত্রী বেক্সিমকোতে একইভবনে চাকরি করতেন, সেই সুবাদে এই এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে ২ মেয়ে ও ১ ছেলে নিয়ে থাকতেন তারা। এখন চাকরি না থাকায় সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে।

শুধু মনির, সোনিয়া, পারুল কিংবা সাজ্জাদের ঘরেই নয়, আশপাশের ৪০ থেকে ৪৫ হাজার মানুষের বাড়িতেও কান্নার এই করুণ সুর। কাজ হারিয়ে সবাই এখন বেকার। নতুন কাজের চেষ্টা করে কোনো সুফল মিলছে না তাদের। একাধিক লোকজনের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানিয়েছেন, বেক্সিমকোতে যারা চাকরি করেছেন, তাদের হাজিরা অনলাইনে হওয়ার কারণে অন্য কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে চাকরি হচ্ছে না বলে জানান তারা। এজন্য ইতিমধ্যে অনেকে এরই মধ্যে ফিরে গেছেন নিজ নিজ ঠিকানায়। ৪নং গেইটের কাছে একটি বিল্ডিং রয়েছে ৫-৬ তলার, স্থানীয় লোকজন জানান এই বিল্ডিংয়ে যারা ভাড়া থাকতেন তাদের প্রায় সবাই বেক্সিমকো কারখানায় চাকরি করতেন। এখন অনেকে তাদের নিজস্ব ঠিকানায় পাড়ি দিয়েছেন, আবার কেউ কেউ বাসায় ছেড়ে দেবেন বলছেন।

শুধু বেক্সিমকো কারখানায় চাকরি করা লোকজন বিপাকে নয় সেই সঙ্গে এলাকার অনেক মুদি দোকানি এসব শ্রমিক পরিবার থেকে পাওনা টাকা আদায় করতে পারছেন না। কাজ নেই, টাকা দেবেন কীভাবে? বাড়িওয়ালা, মেসের রান্নাবান্নার খালা- তারাও একই সমস্যায়।

শামীম স্টোরের মুদি দোকানি মো. শামীম মিয়া বলেন, 'বেক্সিমকো বন্ধ হওয়ায় আমরাও বিপাকে পড়েছি। অনেকেই বাড়ি চইলা গেছে। যারা আছে, টাকা না থাকায় পাওনা দিতে পারতাছে না। আমিও দোকানে মাল তুলতে পারতাছি না। ইতিমধ্যে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার বাকি নিয়ে লোকজন চলে গেছে।'

জানা গেছে,সরকার পরিবর্তনের পর গত কয়েক মাসের মধ্যে বড় ধরনের আঘাত এসেছে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ওপর। বেক্সিমকো শিল্পগোষ্ঠী তাদের ১৫টি পোশাক কারখানার প্রায় ৪০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। এ জন্য গাজীপুরে রপ্তানিমুখী পোশাক ও বস্ত্র কারখানাগুলো কার্যাদেশ পায়নি- এমন কারণ দেখিয়েছে। শ্রমিকদের ভাষ্য, অর্ডার এলে মালিকপক্ষ নিজেরাই তা ফেরত দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। গত ১৫ ডিসেম্বর জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে শিল্পগোষ্ঠীটির সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিককে ১৬ ডিসেম্বর থেকে ছাঁটাই কার্যকরের কথা জানানো হয়।

বেক্সিমকো কারখানায় কর্মরত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এখানে কর্মরত ছিলেন প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক।

এ বিষয়ে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, এই বিষয় নিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে সময় কথা বলেছি। আমরা মনে করি, সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরি করা, তা তো পারছে না, তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গার্মেন্টস সেকশনে বিভিন্ন মিল কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তৎকালীন সরকারি দলের যে মালিকরা ছিল, তারা অনেকেই ম্যানেজমেন্ট ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার কারণে ঝামেলা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের দিক থেকে বাস্তবায়নের যথাযথ কোনো অগ্রগতি দেখছি না। এই খাতকে আরও গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত এবং মানুষের যদি কর্মসংস্থানের সমস্যা হয়, রপ্তানির সমস্যা হয়, তাহলে দেশ যেই পরিবর্তনের দিকে যাওয়ার কথা সেটি বাধাগ্রস্ত হবে এবং যতদ্রম্নত সম্ভব এ বিষয়ে নজর দিয়ে মিল কলকারখানা খুলে দিয়ে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া ব্যবস্থা করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে