বছরের শেষ রাত উদযাপনে নানা বিপত্তি এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষশেষের রাতে ফানুস না ওড়াতে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) অনুরোধ কানে তোলেনি ঢাকাবাসী। বর্ষবরণের রাতে ঢাকার মেট্রোরেলের লাইনে এসে পড়েছে নয়টি ফানুস, যা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারত। এছাড়া এই রাতে বর্ষবরণের আনন্দ উদযাপনে পটকা ও আতশবাজি পোড়ানোর সময় দগ্ধ হয়েছেন পাঁচ জন; তাদের মধ্যে তিনজন শিশু।
বুধবার ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ জানায়, মঙ্গলবার রাতে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ছিল। বুধবার মেট্রোরেল চলাচল শুরুর আগেই এসব ফানুস লাইন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। তাই সকাল থেকে চলাচলে কোনো সমস্যা হয়নি।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, 'ফানুস এসে যে পড়তে পারে, সেজন্য আমরা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। আমাদের চারটি টিম এমআরটি লাইন এলাকায় ভোর থেকে কাজ করেছে। লাইনে নয়টি ফানুস পাওয়া গেছে। এগুলো তারা সরিয়ে দিয়েছে। ফলে সকাল থেকে ট্রেন চলাচলে কোনো সমস্যা হয়নি।'
এর আগে সোমবার মেট্রোরেল লাইন ও আশপাশের এলাকায় ফানুস না ওড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছিল ডিএমটিসিএল। কোম্পানির উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) নাজমুল ইসলাম ভূইয়া সেদিন এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদু্যতিক লাইন ব্যবহার করে মেট্রো ট্রেন চলাচল করে।
থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে ফানুস বা অনুরূপ কোনো বস্তু ওড়ানো হলে সেগুলো বৈদু্যতিক লাইনে জড়িয়ে যে কোনো মুহূর্তে মারাত্মক দুর্ঘটনা, প্রাণ ও সম্পদহানির আশঙ্কা রয়েছে। নির্দেশনা না মেনে ফানুস ওড়ানোর ফলে দুর্ঘটনা হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সেখানে সতর্ক করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরও বর্ষবরণের রাতে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ওড়ানো ফানুস গিয়ে পড়ে মেট্রোরেলের তারের ওপর। এতে বিপত্তিতে পড়ে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। তারা সেসময় ৩৮টি ফানুস অপসারণ করে মেট্রোরেলের তার থেকে।
এদিকে, বর্ষবরণের আনন্দ উদযাপনে পটকা ও আতশবাজি পোড়ানোর সময় দগ্ধ হয়েছেন পাঁচ জন; তাদের মধ্যে তিনজন শিশু। মঙ্গলবার মধ্যরাতের পর বিভিন্ন সময়ে তারা ঢাকার জাতীয় বার্ন ও পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিতে যায়। একটি শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
জাতীয় বার্ন ও পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাওন বিন রহমান বুধবার সকালে বলেন, 'আগুনে ফারহান নামে ৮ বছর বয়সী একটি শিশুর শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। এছাড়া শিফান মলিস্নকের (১২) শরীরের ১ শতাংশ, সম্রাটের (২০) শরীরের ১ শতাংশ, শান্তর (৪৩) শরীরের ২ শতাংশ এবং তাফসির (৩) নামে এক শিশুর শরীরের ২ শতাংশ পুড়ে গেছে।'
ডা. শাওন বলেন, 'দগ্ধরা ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে হাসপাতালে আসেন। থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ও পটকা পোড়ানোর সময় তারা আগুনে দগ্ধ হয়েছে। তাদের একজন শরীরের ১৫ শতাংশ বার্ন নিয়ে এসেছে। বয়স্ক হলে তেমন আশঙ্কা ছিল না, শিশু তাই তার অবস্থা কিছুটা আশঙ্কাজনক। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।'
পটকা-আতশবাজির বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কয়েকদিন আগেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকেও বারবার অনুরোধ করা হয়েছে, পটকা ফাটিয়ে যেন শব্দ ও বায়ুদূষণ করা না হয়। তবে ঢাকাবাসী তা কানে তোলেনি। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকেই পাড়া মহলস্নার চারপাশে শুরু হয়ে যায় হৈ চৈ, থেমে থেমে ভেসে আসতে থাকল পটকার শব্দ। ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছুঁলে তা চরমে ওঠে। রাতের আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে আতশবাজির রঙিন আলোয়। গত কয়েক বছরে এরকম উদযাপনের রাতে জ্বলন্ত ফানুস থেকে অগ্নিকান্ডও ঘটেছে অনেক জায়গায়।
২০২২ সালে পটকা ও আতশবাজির বিকট শব্দে অসুস্থ হয়ে পড়ে তানজীম উমায়ের নামের ৪ মাস বয়সী এক শিশু। পরে হাসপাতালে তার মৃতু্য হয়।
সচিবালয়ে বর্ষবরণের আমেজ, প্রবেশে ছিল কড়াকড়ি
এদিকে, ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর বুধবারও সচিবালয়ে প্রবেশে কড়াকড়ি বহাল ছিল। তবে প্রবেশে কঠোরতা থাকলেও সচিবালয়ে ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিনে ছিল বর্ষবরণের আমেজ।
গত বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) দিনগত গভীর রাতে ৭ নম্বর ভবনের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর সচিবালয়ে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। সাংবাদিকদেরও সচিবালয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সোমবার দুপুর থেকে সাংবাদিকরা প্রবেশ করছেন।
তবে অগ্নিকান্ডের পর উপদেষ্টা ও সচিবদের গাড়ি ছাড়া আরও কারো গাড়ি সচিবালয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। বুধবারও সচিবালয়ে গাড়ি প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সচিবালয়ে ৫ নম্বর গেট দিয়ে পায়ে হেঁটে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। সীমিত সংখ্যক সাংবাদিক ১ ও ২ নম্বর ভবনের মাঝখানের দর্শনার্থী কক্ষ দিয়ে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন।
এদিকে, গাড়ি ও দর্শনার্থী প্রবেশ করতে না দেওয়ায় সচিবালয়ের ভেতরের চত্বর ফাঁকা পড়ে আছে। এছাড়া আগুন লাগা ৭ নম্বর ভবন এখনও বন্ধ রয়েছে। এ ভবনে থাকা মন্ত্রণালয়গুলোর উপদেষ্টা-সচিবসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সচিবালয়ের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় অফিস করছেন।
তবে যারা সচিবালয়ে এসেছেন তারা সহকর্মীদের সঙ্গে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বছর উপলক্ষে মিষ্টিমুখ করতে দেখা গেছে। কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একই রকম শাড়ি পড়ে অফিসে আসতে দেখা গেছে।
বেলা সোয়া ১১টার দিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক ঝাঁক নারী কর্মকর্তাকে একই রকম শাড়ি পড়ে সচিবালয়ে আসতে দেখা যায়। তারা বলেন, 'নতুন বছর উপলক্ষে আমরা সবাই একই রকম শাড়ি পড়েছি।'