বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

টিসিবির ট্রাক সেল বন্ধে বিপাকে লাখো পরিবার

যাযাদি ডেস্ক
  ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
টিসিবির ট্রাক সেল বন্ধে বিপাকে লাখো পরিবার
টিসিবির ট্রাক সেল বন্ধে বিপাকে লাখো পরিবার

দিনমজুর সোলায়মান হোসেন মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় এসে টিসিবির পণ্যবিক্রির ট্রাক খোঁজ করছিলেন। বেড়িবাঁধেই বাসা ভাড়া করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন তিনি। দৈনিক কাজ থাকে না। যেদিন কাজ পান, সেদিন তার দৈনিক আয় পাঁচশ থেকে ছয়শ' টাকা। আর যেদিন কাজ পান না, সেদিন কোনো আয় নেই। তার স্ত্রী জুলেখা বেগম গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন কয়েকটি বাসায়। সেখানে তার মাসিক আয় ৭ হাজার টাকা। দুই সন্তান স্কুলে পড়ে। বাসাভাড়া, দুই সন্তানের স্কুলের বেতন, বই-খাতা-কলম কেনা, খাবার খরচসহ তার পরিবারে মাসিক খরচ ১৬ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে টানাটানির সংসার। এতদিন সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বাজারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক দামে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির ট্রাক থেকে পাওয়া তেল, ডাল ও চাল। কিন্তু ৩১ ডিসেম্বরের পর সরকারের এই কর্মসূচি বন্ধ। এ কারণে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।

সোলায়মান হোসেনের মতো রাজধানীর মিরপুরে বসবাসকারী রমিসা বেগম, কল্যাণপুরের কোহিনুর এবং বসিলার খাদিজা বেগমেরও মাথায় হাত। এরা সবাই বাসাবাড়িতে কাজ করা মানুষ। টিসিবির ট্রাক থেকে প্রতি মাসে চাল, তেল ও ডাল কিনতে পেরে তারা চিন্তামুক্ত ছিলেন। কিন্তু এখন তাদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। কারণ খোলা ট্রাকের মাধ্যম এসব পণ্য বিক্রি কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে টিসিবি। বাজার থেকে দ্বিগুণ দামে চাল, তেল ও ডাল কেনা অনেকটাই কষ্টসাধ্য তাদের জন্য।

1

জানা গেছে, কয়েকমাস বন্ধ থাকার পর গত বছরের অক্টোবর মাসে ট্রাকে করে তেল, ডাল ও চাল বিক্রির কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল টিসিবি। এতে ফ্যামিলি কার্ড না থাকলেও প্রতিদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাড়ে ২৪ হাজার মানুষ ভর্তুকি মূল্যে এসব পণ্য কেনার সুযোগ পেতেন। মাত্র দুই মাস সাত দিন চলার পরে এ কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছে সংস্থাটি।

সরকারী সংস্থাটি জানায়, নিম্নআয়ের মানুষের জন্য টিসিবির ট্রাকে করে ভর্তুকি দেওয়া পণ্য বিক্রির নির্ধারিত শিডিউল শেষ হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতির এই বাজারে বাড়তি আর্থিক চাপ সামলাতে না পেরে অনেক সুবিধাভোগী আবারও টিসিবির ট্রাক সেল কর্মসূচি চালুর দাবি জানিয়েছেন।

এর আগে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিসিবি জানায়, জানুয়ারি মাসে কার্ডধারীরা দুই লিটার ভোজ্য তেল, দুই কেজি মসুর ডাল এবং এক কেজি চিনি কিনতে পারবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আপাতত এ কর্মসূচি চালুর কোনো পরিকল্পনা সরকারের নাই। বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে, তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা নেই। শুরুতে এ কার্যক্রম ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চালু থাকার কথা থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে হিসেবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলেছে, জানুয়ারি থেকে বন্ধ হয়ে গেছে টিসিবির ট্রাক সেল কার্যক্রম।

এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, খাদ্য অধিদপ্তর প্রতি মাসে টিসিবিকে ৫০ হাজার টন চাল সরবরাহ করে। তবে এ বরাদ্দের জন্য খাদ্য অধিদপ্তর বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেটে কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। ফলে খাদ্য অধিদপ্তর আর চাল সরবরাহ করতে পারছে না। চালের মূল্য পরিশোধ নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় সরবরাহ আপাতত বন্ধ রয়েছে।

বিদায়ী ২০২৪ সালের পুরো সময়জুড়ে দেশের মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত বছর টানা ৯ মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে। বিশেষ করে বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাজারে চাল, পেঁয়াজ, আলু, মুরগি, ডিমসহ নিত্যপণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ওই বছরের ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা মহানগরের ৫০টি ও চট্টগ্রাম মহানগরের ২০টি স্থানে ট্রাকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি শুরু করে টিসিবি। প্রতিটি ট্রাকে ৩৫০ জনের পণ্য থাকত। ট্রাক থেকে একজন ভোক্তা সর্বোচ্চ দুই লিটার ভোজ্যতেল, পাঁচ কেজি চাল ও দুই কেজি মসুর ডাল কিনতে পারতেন। এতে একজন গ্রাহকের অন্তত ৩৫০ টাকা বা তার বেশি অর্থ সাশ্রয় হয়। গত ৩১ ডিসেম্বরের পর থেকে এ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জানুয়ারি মাস থেকে শুধু স্মার্ট কার্ডধারী পরিবারকেই পণ্য দিচ্ছে টিসিবি। এক্ষেত্রে এক কোটি কার্ডধারী পরিবারের মধ্যে শুধু ৫৭ লাখ স্মার্ট কার্ডধারী এ সুবিধা পাচ্ছেন। বাকি ৪৩ লাখ পরিবারের কাছে স্মার্ট কার্ড না থাকায় তারা সরকারের এই সুবিধা আপাতত পাচ্ছেন না। টিসিবির পণ্য কেনার জন্য একটি পরিবারকে এতদিন একটি সাধারণ কাগুজে কার্ড দেওয়া হতো। পুরোনো এই কার্ড বাতিল করে এখন স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে পণ্য বিতরণ শুরু করেছে টিসিবি।

টিসিবির চেয়ারম্যানের মুখপাত্র হুমায়ুন কবির সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমকে জানান, ট্রাক সেল কার্যক্রম কিন্তু সারা বছর চালানো হয় না। যখন মূল্যস্ফীতি বেশি থাকে বা কোনো পণ্যের বিশেষ চাহিদা থাকে, তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় টিসিবি ট্রাক সেল কার্যক্রম পরিচালনা করে। তার অংশ হিসেবে গত বছরের অক্টোবরে ২৮ হাজার পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নভেম্বর পর্যন্ত এটা চলমান থাকার কথা থাকলেও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় তা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

তাহলে বন্ধের কারণ কী, মূল্যস্ফীতি কি কমে গেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'বিষয়টি টিসিবি জানে না। তা জানে মন্ত্রণালয়, অর্থাৎ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। টিসিবি নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। টিসিবি সংক্রান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত টিসিবি কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করে।'

তিনি আরো জানান, প্রয়োজন অনুসারে ট্রাক সেল পরিচালনা করা হয়। বাজারে চাহিদা বেশি থাকলে, তখন টিসিবি ট্রাক সেল পরিচালনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। যেমন রমজানে ছোলা ও খেজুর বিক্রি করা হয়। গত নভেম্বরে আলুর বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে আলু বিক্রি করেছিল টিসিবি।

জানা গেছে, টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের সংশোধন নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হচ্ছে না। এর ফলে ৪৩ লাখ কার্ডধারী পরিবার কবে নাগাদ স্বল্পমূল্যে টিসিবির পণ্য পাবেন, তা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। অথচ বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে এই টিসিবির পণ্যই হতে পারে গরীব পরিবারের জন্য বড় সহায়ক- এমনটাই মনে করেন কার্ডধারী সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে সরকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আশাহত হওয়ার কোনো কারণ নেই, মার্চের শুরুতে রমজান শুরুর আগেই দেশের পুরো ১ কোটি পরিবার টিসিবির পণ্য হাতে পাবেন।

জানা গেছে, এক পরিবার এক কার্ড- এই নিয়মেই হওয়ার কথা ছিল টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড। অথচ অভিযোগ আছে, দীর্ঘসময় রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকার এই কার্ডকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। আওয়ামী লীগের নেতারা কখনো তাদের দলীয় কর্মীদের পরিবারকে, আবার কখনো সুবিধা গ্রহণের মধ্য দিয়ে অন্য সব পরিবারে দিয়েছে একাধিক কার্ড। যে পরিবারে বাবার নামে কার্ড আছে, সেই একই পরিবারে মায়ের নামেও কার্ড আছে। আছে ওই পরিবারের ছেলের নামেও টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এতদিন এভাবেই চলছিল, অথচ এটি হওয়ার কথা নয়। এ কারণেই বর্তমান অন্তবর্তী সরকার টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড পুনরায় যাচাই-বাছাই করছে। যার পরিমাণ ৪৩ লাখেরও বেশি। যাচাই-বাছাই শেষ করে গত ১৫ নভেম্বরের মধ্যে একটি ফ্রেশ তালিকা তৈরি করে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিশেষ করে টিসিবিতে পাঠানোর জন্য দেশের সকল জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় সরকার কাঠামো সচল না থাকায় কাজটি জটিল হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমে জানান, চট্টগ্রামের টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে। একটি পরিবারে একটি কার্ড থাকার কথা থাকলেও দেওয়া হয়েছে একাধিক কার্ড। এ ছাড়া আরও অনিয়ম রয়েছে। যারা এই কার্ড পাওয়ার যোগ্য নন, তাদেরও দেওয়া হয়েছে টিসিবির কার্ড। এর মধ্য দিয়ে অনেকে দরিদ্র পরিবার সরকারের দেওয়া এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সবগুলো অনিয়ম দূর করে একটি সুন্দর নিরপেক্ষ তালিকা করার জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কাজ করছে। এ কাজের সঙ্গে এডিসি, ইউএনও, জনপ্রতিনিধি ও ছাত্র সমন্বয়কদেরও যুক্ত করা হয়েছে। কাজটি কঠিন বলেই সময় লাগছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দ্রম্নত কাজটি সম্পন্ন করার জন্য টিসিবির স্মার্ট কার্ড তৈরির ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) সহায়তা চেয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন। সম্প্রতি সহায়তা চেয়ে জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠিও পাঠানো হয়েছে।

ট্রাক সেল কার্যক্রম প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, পুরো এক কোটি পরিবারকেই স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে টিসিবির পণ্য দেবে সরকার। আপাতত ট্রাক সেল কার্যক্রম পরিচালনার কোনো পরিকল্পনা নাই। তবে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে বলে উলেস্নখ করেছেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে