মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২
বিপর্যয়ের মুখে পরিবেশ

শিল্পবর্জ্যে দূষণের শিকার লৌহজং নদী ও খাল

মারা যাচ্ছে জলজপ্রাণী, পানি ব্যবহারে শরীরে হচ্ছে ক্ষত
জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শিল্পবর্জ্যে দূষণের শিকার লৌহজং নদী ও খাল
শিল্পবর্জ্যে দূষণের শিকার লৌহজং নদী ও খাল

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের রাসায়নিক শিল্পবর্জ্যে দূষিত হচ্ছে লৌহজং নদী ও পাকুল্যা খালের পানি। কারখানা নিঃসৃত কেমিক্যালের দুর্গন্ধে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পরিবেশ-প্রতিবেশ। নদী ও খালের পানি দূষিত হয়ে কালো বর্ণ ধারণ করেছে। মারা যাচ্ছে নদী ও খালের মাছ। পানি ব্যবহারে মানুষ ও প্রাণির শরীরে দেখা দিচ্ছে ক্ষত। এ বিষয়ে এলাকাবাসী লিখিত অভিযোগ দিলেও নমুনা সংগ্রহের মধ্যেই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

মির্জাপুর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত পাকুল্যা খালের পানি লৌহজং নদীতে গিয়ে পড়ে। ওই খাল ও নদী মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কী, ভাতগ্রাম ও বানাইল ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মানুষের গুরুত্বপূর্ণ খোলা পানির উৎস। খাল ও নদীতে স্থানীয় বাসিন্দারা মাছ ধরা, গোসল, গৃহস্থালির কাজ, অজু, আবাদি জমি এবং গরু-মহিষ-ছাগলসহ গৃহপালিত অন্য প্রাণিকে গোসল করানোর জন্য ব্যবহার করে থাকেন। সাদিয়া টেক্সটাইল মিলসের রাসায়নিক বর্জ্যে খাল ও নদীর পানি ইতোমধ্যে কালো বর্ণ ধারণ করে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানিতে হচ্ছে পোকার উৎপত্তি। এ কারণে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে খাল ও নদীর পানি।

সরেজমিনে জানা যায়, যমুনা সেতু-ঢাকা মহাসড়ক সংলগ্ন মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কী ইউনিয়নের বানিয়ারা মৌজায় কয়েক বছর আগে সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। কারখানার দূষিত বর্জ্য খালে ফেলতে গত দুই বছর আগে যমুনা সেতু-ঢাকা মহাসড়কের পাশ দিয়ে মহাসড়কের জমিতে কংক্রিটের পাইপ স্থাপন করা হয়। ওই পাইপের ড্রেন কয়েকটি বাড়ির ভেতর দিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে পাকুল্যা খালে নিয়ে সংযুক্ত করা হয়। এরপর থেকে নিয়মিত কারখানার দূষিত বর্জ্য খালে নিষ্কাশিত হচ্ছে। ফলে ক্রমাগত কেমিক্যালের দূষণে খাল ও নদীর পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা নদী ও খাল থেকে মাছ ধরলেও সেই মাছ রান্নার পর দুর্গন্ধে খাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যেই নদীর মাছ মরে ভেসে উঠছে। কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ চর্মরোগ, পানিবাহিত রোগ এবং উলেস্নখযোগ্য পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবজীবন এবং জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে।

পাকুল্যা খালের পাশে বাঁশের চাটাই তৈরির কাজে নিয়েজিত ওই গ্রামের রফিক মিয়া জানান, তিনি ১৫ বছর ধরে চাটাই তৈরির কাজ করছেন। চাটাই তৈরির জন্য আনা বাঁশ পাকুল্যা খালের পানিতে ভিজিয়ে রেখে তারা কাজ করেন। গত দুই বছর ধরে সাদিয়া কারখানার বর্জ্য খালে ফেলায় পানি দূষিত, দুর্গন্ধ ও কালো কুচকুচে হয়ে পড়েছে। পানিতে নামলে শরীরে চর্মরোগ দেখা দেয় এবং চুলকানীতে দগদগে ঘা হয়।

স্থানীয় শ্রমিক আরশাদ মিয়া, ফরমান আলী, রশিদসহ অনেকেই জানান, বিষাক্ত কেমিক্যালের কারণে খালের পানি কালো হয়ে গেছে। নদীর বড় বড় মাছ মাঝে মধ্যেই মরে ভেসে ওঠে। খাল ও নদীর পাশে দুর্গন্ধে বেশি সময় থাকা যায় না। ওই খালের পানি লৌহজং নদীতে পড়ছে। লৌহজং নদীর মাছও মরে ভেসে উঠছে। রাসায়নিক মিশ্রিত বিষাক্ত পানি নদীতে মিশে যাওয়ায় এখন কেউ নদীতে গোসল করতে পারেন না- নদীর পানি দিয়ে জমিতে সেচ দিতেও পারেন না।

ওই গ্রামের বাসিন্দা রমজান আলী জানান, তাদের দেখার মতো কেউ নেই। তারা আগে নদীর পানি পান করতেন- মাছ ধরতেন। এখন পানি পান করা মাছ ধরা তো দূরের কথা-

দুর্গন্ধে আশপাশের বাড়িতেও বসবাস করা দায় হয়ে ওঠেছে। সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত পানি বেশি ছেড়ে থাকে।

কলেজছাত্র কহিনুর ইসলাম, শাকিল ইসলাম, ইমরান খান রাজাসহ অনেকেই জানান, সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের রাসায়নিক বর্জ্য খালের পানিতে ফেলায় জনজীবন, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ-প্রতিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। মঙ্গলবার পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন এসে পানির নমুনা সংগ্রহের মধ্যেই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ রেখেছে। অথচ খালিচোখেই পানি ও কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য দেখা যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এমন গা-ছাড়া উদ্যোগের নিন্দা জানান তারা।

তারা বর্তমান সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টার কাছে কারখানার দূষিত বর্জ্য খালে ফেলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানান।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন ফাউন্ডেশনের (বিএমবিএফ) পর্যবেক্ষণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আকিব আকবর খান চৌধুরী জানান, সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের শিল্পবর্জ্যের দূষণ চরম আকার ধারণ করেছে। যা স্থানীয় পর্যায়ে ফসলের ক্ষতি-নিরাপদ পানির অভাবসহ চরম পরিবেশ-প্রতিবেশ ও মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো চলমান বেপরোয়া ও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ ও মানবিক বিপর্যয়ের কথা অনেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে পরিকল্পিত ও উৎসে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু কেউই এ বিষয়ে কর্ণপাত করছেন না।'

তিনি সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের বর্জ্য ফেলা বন্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন বলেও জানান।

জামুর্কী ইউপি চেয়ারম্যান ডিএ মতিন জানান, এলাকাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পাকুল্যা খালের সাটিয়াচড়া এলাকা পরিদর্শন করে তিনি বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানি দেখতে পান। পরে কয়েকটি গ্রামের ২০-২৫ জন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সাদিয়া কারখানায় গিয়ে মালিকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। টেক্সটাইলের মালিক কারখানার ইটিপিতে সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে প্রকৌশলী এনে সমাধান করা হবে জানালেও এখনো সমাধান করা হয়নি।

সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক আব্দুর রহমান মোবাইল ফোনে জানান, কারখানার পানি ইটিপি করে রেঞ্জের মধ্যে রেখে পাইপের পর ড্রেনের মাধ্যমে খালে ফেলা হচ্ছে। এই পানিতে দুর্গন্ধ ও পোকার উৎপত্তি হওয়ার কথা নয়।

টাঙ্গাইল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (স্বাস্থ্য) দীপঙ্কর দাস জানান, প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরের। কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের বিষয়গুলো তাদের দেখার বিধান রয়েছে। তারা এ পর্যন্ত লিখিত অভিযোগের কোন কপি পান নি। লিখিত অভিযোগের কপি হাতে পেলে আইনগত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক জানান, মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছ থেকে অভিযোগের কপি পেয়ে মঙ্গলবার সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। নদী ও খালের পানির স্যাম্পল (নমুনা) সংগ্রহ করে ঢাকায় ল্যাবে পাঠানো হবে। ল্যাব থেকে রিপোর্ট পেলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমান জানান, বিষয়টি আগে জানা ছিল না। তিনি খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে