রূপসী বাংলার যশোর জেলার ঝিকরগাছার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের চিরসবুজে ঘেরা গাঁ নারাংগালী। সে গাঁয়েরই এক বর্গাচাষি নাম ধনী। তারই উঠতি বয়সি বারো-তেরো বছরের কৃষ্ণ বরণ কিশোরী এক মেয়ে চৈতী। যার দেহের রংটা কালো। কিন্তু দেহের রং কালো হলে কি হবে। বেশ হৃষ্টপুষ্ট বেলুনে বলা দেহের গড়ন তার। মুখশ্রীও বেশ গোলগাল আকর্ষণীয়। আর মুক্তার মতো গালে ঝকঝকে সারি বাঁধানো দাঁত। হাস্যোজ্জ্বল, চঞ্চলা, দুরন্তমনার এক বালিকা। সারাদিন যার এ গাছে ও গাছে চড়ে বেড়ানো আর গায়ের সারা পাড়া ঘুরে দাপিয়ে বেড়ানো অভ্যাস। সে গুনগুন করে গান গায়। আর তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে-নেচে এ গাছের ফল ও গাছের ফল পেড়ে খায় আর মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। গাঁয়ে চলার মেঠো পথে যখন যার সঙ্গে দেখা হয় সে হেসে বলে কি দাদু ভালো তো? কি দাদি ভালো আছ? চাচা কেমন আছ? চাচি তোমার শরীর কেমন আছে? কিরে ছোট? কিরে পিচ্চি ভালো আছিস? এভাবে হেসে হেসে সবার সঙ্গে সে কথা বলে। কখনো কেউ তার মুখে দুঃখের কালো মেঘ দেখতে পাই না। গাঁয়ের লোকজন কম-বেশি সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। তবে কোনো কোনো হিংসুটে পুরুষ মহিলারা আবার হিংসাও করে।
সত্যি বলতে...
'এই সমাজে ভালো মানুষের বড় অভাব...
আর কুচক্রী নিন্দে ভর্ৎসনা করাটাই যেন স্বভাব।
এমন বহু মানুষ আছে...
যারা অপরের হাসিমুখ, সুখ সহ্য করতে পারে না।
কিন্তু কারোর চোখে জল দুঃখ-কষ্ট দেখলে তাদের মনে যেন আর আনন্দ ধরে না।
তেমনি চৈতীকে দেখে গাঁয়ের কোন কোন মহিলা মুখ ভ্যাংচি কেটে বলে হুম...ধনীর একটা মেয়ে হয়েছে বটে।
ধুমড়ি মেয়ে একটা। মেয়ে তো নয়, যেন একটা গ্যাঁচো ইঁদুর। আবার কেউ কেউ বলে গাছ বাওয়া একটা কাঠবিড়ালি।
সারাদিন কাঠবিড়ালির মতো শুধু পরের গাছ বেয়ে বেড়ায়। বলি, ধনী কেন যে অমন ধুমড়ি মেয়েটাকে বিয়ে দেয় না, কে জানে? চৈতী কারোর কোনো কথা কানে করে না। শুনে হেসে উড়িয়ে দেয়।
এ বছর সে তার নারাংগালী গাঁয়ের পাশের গ্রাম পানিসারার সুরুজজান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। কিন্তু বয়সের তুলনায় চৈতী বেশ দাওড়া-চাওড়া আর উঁচু লম্বা হয়ে উঠেছে। একদিন গাঁয়ের একটা মধ্যবয়সি লোক, নাম কালু সে ধনীর বাড়িতে এসে বলে...
'বাপু, তোমার জন্য যে আমাদের গাঁয়ের
গেল সব কুল, মান, জাত'
বুঝিনে বাপু, ধাঙ্গড় মেয়ে ঘরে রেখে তুমি
কি করে যে মুখে তোলো ভাত?
এভাবে আরও নানা লোকে নানা কথা বলতে থাকে। আরেকদিন একটা কুটনি বুড়ি, যার গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে মানুষের খোঁচা মারা আর এর বাড়ির কথা ও বাড়ি বলে বেড়ানো স্বভাব। সেও মুখ ঝামটি কেটে চৈতীর মাকে বলল....বাপু মেয়েটাকে বিয়ে দিতে পার না শুনি? নাকি ঘরের খুঁটি করে বাড়িতেই রেখে দেবে হুম...? চৈতীর মা শুনে কোনো কথা বলে না। এভাবে ধনীর স্ত্রী পূর্ণবতী গাঁয়ের পাঁচজনার পাঁচ কথা শুনতে শুনতে এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
সে রাতে শোয়ার সময় চৈতীর বাবা ধনীকে বলে। ওগো, এভাবে তো গাঁয়ের মানুষের কথা শুনে আর পারা যায় না। তার চেয়ে একটা ছেলে দেখে মেয়ে চৈতীকে বিয়ে দিয়ে দাও। শুনে ধনী বলল, বিয়ে বললেই তো আর বিয়ে দেওয়া যায় না তাই না? বিয়েতে তো একটা মোটা অংকের খরচ-খরচারও ব্যাপার-স্যাপার আছে।
আসলে...
'চৈতীর বাবা নামেই যা- শুধু ধনী,
অথচ ধনদৌলত বলতে কোনো কিছুই তার নেই।
'পরের জমি বর্গা চাষ করে আর গাঁয়ের মানুষের ক্ষেতখামারে জনমজুরি খেটে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে কোনো রকম তার টানাপড়েনের সংসারটা চলে।
তবু, রাতে যখন তার স্ত্রী পুণ্যবতী মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কথা বলল। ধনী বলল, চৈতীর মা, তুমি যে চৈতীকে বিয়ে দিতে বলছ...। কতই-বা বয়স হয়েছে মেয়েটার বল? আর তাছাড়া ওর এখন কিশোরী মন। এখনো ওর ছেলেমানুষি যায়নি। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি সংসার বোঝার মতো বয়স কি এখনো ওর হয়েছে বল? এ বয়সে বিয়ে দেওয়াটাকে যে বাল্যবিবাহ বলে। পুণ্যবতী বলল, সে তো ঠিক আছে, কিন্তু গাঁয়ের মানুষের পাঁচজনের পাঁচ কথা শুনে তো আর পারা যাচ্ছে না। আর তাছাড়া বিয়ে দিলে দেখবে আস্তে আস্তে সব বুঝে যাবে। আমিও তো কোন ছোট্টকালে এ ঘরে এসেছি তোমার বউ হয়ে। কই! আমি কি সংসার করছি না?
ধনী বলল, ঠিক আছে তুমি যখন বলছ। কাল ঘটককে একটা ভালো সম্বন্ধ আনতে বলে দেব।
পরদিন সকালে ঘটক কুতুবউদ্দিনকে বলল। সে
যেন একটা ভালো ছেলে দ্যাখে তার মেয়ের জন্য। এরপর থেকে মাঝেমধ্যে ঘটক কুতুবউদ্দিন এক একটা সম্বন্ধ নিয়ে ছেলে পক্ষের লোকজন নিয়ে হাজির হয় ধনীর বাড়ি। দেখা, মতামত নাস্তা পর্ব শেষ হলে দেনা-পাওনা, মানে যৌতুক নিয়ে দরকষাকষি চলে। কিন্তু সব ধনীর সাধ্য-সামর্থ্যের বাইরে হওয়ায় বিয়ে আর হয়ে ওঠে না। সর্বশেষে চৈতীর মা-বাপ দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিল। মেয়ে তাদের কালো। মোটা যৌতুক ছাড়া কেউ মেয়েকে বিয়ে করবে না। তাই তার নিজের যে দশ কাঠা জমি আছে। সেটুকুই সে বন্ধক রেখে মেয়ে চৈতীর বিয়ে দেবে। ধনীর যে কথা সেই কাজ। তারপরদিন ঘটককে বলল...শেষে যে পাত্র নিয়ে এসেছিল তাদের গার্জেন পক্ষদের নিয়ে আসতে। সে তাদের দেনা-পাওনার বিষয় কথা বলবে। ঘটক দুদিন পরই ছেলের গার্জেন পক্ষকে নিয়ে এল ধনীর কাছে। দেনা-পাওনার কথা উঠতেই ছেলের বাপ হেসে বলল...খুব বেশি কিছু দিতে হবে না বুঝলেন বেয়াই মশাই?
এই ধরুন সাংসারিক টুকিটাকি যেসব লাগে আর কি...যেমন থালাবাসন, হাঁড়িকুঁড়ি, কাঁথা বালিশ, আর আমার ছেলের বহু দিনের শখ একটা নতুন মোটর সাইকেল চড়ার। আর পঞ্চাশ হাজার মতো টাকা দিলেই হবে বুঝলেন? চৈতীর বাবা ধনী বলল জ্বি বুঝেছি। চৈতীর বাবা ধনী রাজি হয়ে গেল দিতে। তবে সে পঞ্চাশ হাজার টাকা বিয়ের কিছুদিন পর দেবে বলে সময় নিল ছেলের বাপের কাছে। দুদিন পর শুক্রবার চৈতীর বিয়ে।
বিয়ের কথা শুনে চৈতী কান্না শুরু করেছে। এতোদিন গাঁয়ের লোকজন যারা চৈতীর মুখে হাসি দেখত। এই প্রথম তারা চৈতীকে কান্না করতে দেখল। এদিকে চৈতীর বাবা ধনী তার দশ কাঠা জমি গাঁয়ের টাকা-ওয়ালা একজনের কাছে বন্দক থুয়ে বিয়ের আয়োজন শুরু করে দিল। দু-চারটি আত্মীয় ঘরের লোকজন। আর গাঁয়ের কিছু গণ্যমান্য লোকজনকে দাওয়াত দিল ধনী।
শুক্রবার বিয়ের দিন সকালে চৈতীকে বেনারসি শাড়ি পরিয়ে খুব সুন্দর করে বউ সাজানো হয়েছে। বাড়িভর্তি লোকজন। চৈতীর বয়সি তার গাঁয়ের সখিরাও এসেছে। দুপুরের আগেই বরযাত্রী চলে এলো সব। বর এসেছে বর এসেছে বলে হই-হুলেস্নাড় করে চেঁচামেচি করতে লাগল। জুমার নামাজের পর কাজী সাহেব চলে এলো বিয়ে পড়াতে। তারপর বিয়ে হয়ে গেল চৈতীর। বিয়ের পর বরপক্ষের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো।
খাওয়া শেষ হলে তারা সব গাড়িতে গিয়ে বসল। চৈতী বিদায়কালে মা-বাবাকে ধরে অনেক কান্নাকাটি করতে লাগল। তারপর একসময় বরের হাত ধরে বউ সাজে নতুন এক সংসারের উদ্দেশ্যে রওনা দিল গাড়িতে। বিয়ের ফুলশয্যা থেকে শুরু করে কয়েকটি মাস বেশ সুখেই কাটতে লাগল চৈতীর সংসার জীবন। তারপরই চৈতীর জীবনে কাল হলো যৌতুকের বাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা। উঠতে, বসতে ও খেতে চৈতীর শ্বশুর-শাশুড়ি কমবেশ ছোট-বড় কটু কথা বলতে থাকে। চৈতীর স্বামী স্বজলও আগের মতো এখন আর চৈতীকে ভালোবাসে না। মাঝেমধ্যে মারধর করে চৈতীকে।
চৈতী কিছু না বললেও, ধনী মেয়ের বাড়ি বেড়াতে এসে মেয়ে চৈতীর মুখ দেখে যা- বোঝার বুঝতে পারে যে, মেয়ে তার সুখি নেই। কি করবে ধনী বাড়ি ফিরে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু কোথাও সে টাকা জোগাড় করতে পারে না। এদিকে চৈতী দিনের পর দিন শ্বশুর-শাশুড়ির পচা কথা আর স্বামীর হাতে মার খেতে খেতে অতিষ্ট হয়ে ওঠে।
দিনকে দিন দেহের হাড় বেরিয়ে জীর্ণশীর্ণ হয়ে যায়। কথায় আছে...
শ্বশুর-শাশুড়ি ননদ দেবর-রা যদিও খারাপ হয়,
স্বামী ভালো হলে মেয়েরা বেঁচে থাকার অন্তত অবলম্বন খুঁজে পায়। কেননা সারাদিন সংসারের
ঝামেলা শেষে নারীরা স্বামীর বুকে মাথা রেখে
সব দুঃখগুলো ভুলে যায়।
কিন্তু, কপালপোড়া হতভাগি চৈতীর সেই আশ্রয়টুকুও নেই। একদিন ওর শ্বশুর-শাশুড়ি চৈতীকে মা-বাবা তুলে ছোটলোকের জাত, ফকির নানান
কথা বলে গালমন্দ করে। চৈতী সহ্য না করতে
পেরে দু-একটি কথা বলে প্রতিবাদ করে। রেগে
স্বজল বেদম মারধর করে চৈতীকে। ধৈর্যহারা হয়ে চৈতী ঘরে গিয়ে নিজের গলায় ফাঁস নেয়। তাৎক্ষণিক মারা যায় চৈতী। এ সংবাদ ধনীর কাছে পৌঁছালে পাগলের মতো কান্নাকাটি করতে থাকে চৈতীর মা-পুণ্যবতী আর বাবা ধনী। আর আহাজারি করে বলতে থাকে, ও আলস্নাহ আমাদের একি হলো? আমরা মেয়েটা অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে মেরে ফেললাম। কেনো যে, যৌতুকের শর্তে রাজি হয়ে বিয়ে দিলাম আমাদের মেয়েকে? একসময় থানা থেকে পুলিশ এলো। চৈতীর লাশ নিয়ে গেল পুলিশ কভার ভানে। তারপর লাশ পোস্টমর্টেম করার পর চৈতীকে দাফন করা হলো। এভাবে অকাল বাল্যবিবাহ আর যৌতুকের লোভের বশবর্তীর শিকার হয়ে অকালে হারিয়ে গেল নিষ্পাপ হাসিখুশি ভরা ফুলের মতো চৈতী নামে একটা মেয়ের জীবন।