আলোহারা বরেন্দ্র এলাকার বিস্তীর্ণ ফসলের একটি মাঠ। মাঠটির এক প্রান্তে একটি সাঁওতাল গ্রাম এবং শেষ প্রান্তে মুসলিম পাড়া। মাঠটা এতই বড় যে, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কি আছে তা ষ্পষ্ট করে বোঝা যায় না। সাঁওতালরা ভূমিহীন, এত বড় মাঠটি তাদের বাড়ির পাশে। তবে তাদের এক টুকরো জমি নেই। এই মাঠটির বেশিরভাগ বর্গাদার হলো আদিবাসী। আদিবাসীদের শ্রমে-ঘামে ফলে মাঠের সোনালি ফসল। মাঠটির বেশিরভাগ জমি মুসলিম পাড়ার রহমান প্রমাণিকের। সাঁওতাল পাড়ার জানুস কিস্কু রহমান প্রমাণিকের বিশ্বস্ত বর্গাদার। কিস্কু পরিবারটি বংশানুক্রমিক ধারায় প্রমাণিকদের জমির বর্গা করে আসছে। জানুস কিস্কুর কোনো ছেলে নাই। তিন মেয়ে। বড় মেয়ের নাম জুয়েনা কিস্কু, বয়স প্রায় ১৮ বছর। নোনাহার স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। মা প্রায় সময় নানা রোগে ভোগে। বাবার কাজে জুয়েনাকেই সহায়তা করতে হয়। তাই তার পড়াশোনা বাদ দিয়ে মাঠের কাজ করে। আজ তার জুয়েনা ও বাবার ক্ষেতের আগাছাগুলো তুলতে যাবে। যে জমির আগাছা তুলতে যাবে, তা তাদের বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলো দূরে। মাঠের আল পথটি ধরে যেতে হয়। শরতের শিশির ভেজা ঘাস ওপর দিয়ে খোলা পায়ে পিতা-পুত্রী চলল ধান ক্ষেতের দিকে। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা হাঁটার পর তার পৌঁছল ধানের জমিনে। মাঠের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধান ক্ষেত এটি। পুরো জমির ধানগাছগুলো গর্ভবতী। সবুজ ধান গাছের গর্ভে সাদা ধানের শিষ মোটা হয়ে আছে, আবার অল্প কিছু ধান গাছে বেরিয়ে পড়েছে সাদা ধানের শিষ। প্রতি ধানের গোছাই কলার মোচার মতো হয়ে আছে। বাপ-বেটি দুজনেই বাক্যহীনভাবে আগাছা তুলছে। সূর্যটার তেজ ক্রমেই বাড়ছে। সূর্যটা মধ্য আকাশে আসার পর জানুস বলল, 'জুয়েনা তুই জোহর আজানের পর চলে আসিস, আমি যাই গরুগুলোকে পানি খেতে দিতে হবে।' এই বলে জানুস কিস্কু চলে যায় বাড়ির দিকে। দ্বি-প্রহরের গনগনে রোদ ছিটিয়ে পড়েছে সবুজ মাঠের ওপর। শরতের রোদে হালকা উত্তরে বাতাসে সবুজের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে মাঠ বেয়ে। ছাতা মাথায়, লুঙ্গি মালকোচা দিয়ে, চপল পায়ে রায়হান বেরিয়েছে নিজেদের জমি দেখতে। রায়হান রহমান প্রমাণিকের ছেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বয়স আনুমানিক একুশ কি বাইশ হবে। হাঁটতে হাঁটতে এসে দেখে তাদের জমিনে উপুড় হয়ে অষ্টাদশী, সৌষ্ঠব দেহের অধিকারিণী এক নারী কাজ করছে। ধান গাছের দীর্ঘতায় তাকে সুষ্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটিকে প্রথম দেখল রায়হান, তাই জানতে চাইল, 'কে তুমি'
প্রতি উত্তরে জুয়েনা বলল, আমি জানুসের মেয়ে।
রায়হান-কি নাম তোমার?
জুয়েনা-জুয়েনা কিস্কু।
রায়হান-তোমার বাবা কই?
জুয়েনা-গরুকে পানি খাওয়াতে গেছে।
রায়হান-এত রোদে তুমি কাজ করছ, ঘা তো পুড়ে যাবে।
জুয়েনা স্বাভাবিকভাবে বলে, আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমার তো ভাই নাই তাই বাবার কাজে সাহায্য করি।
জুয়েনা-আপনি কে,
রায়হান-আমি রহমান প্রমাণিকের বেটা, ঢাকায় থাকি।
রহমান প্রমাণিকের বেটা এই কথাটা শোনামাত্র জুয়েনা দুহাত জোর করে বলে ওঠে-নমস্কার
জুয়েনা-ঢাকায় কি করেন।
রায়হান-আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি।
মেয়েটির কথা বলার সপ্রতিভ স্বাভাবিকতা দেখে রায়হান অবাক হয়ে যায়। রায়হান ভাবে সাঁওতালদের মধ্যে এমন সাহসী মেয়েও আছে। জুয়েনার গায়ের রং তামাটে কালো, তবে অঙ্গের সৌষ্ঠবতা খুবই আকর্ষণীয়। জুয়েনা তার পরনের শাড়িটি উঠিয়ে রেখেছে হাঁটুঅবধি। বুকের কাপড়টা আটসাঁট করে বেঁধেছে, তাতে তার বক্ষ যুগলের সৌষ্ঠবতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জুয়েনার দৈহিক সৌষ্ঠবতাটা এক নজরে দেখে নেয় রায়হান। জুয়েনার বক্ষ যুগল পোয়াতি ধান গাছের মতো বেড়ে উঠেছে। হাত-পা কোমরসহ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গে পূর্ণ যৌবনের পরশ লেগে আছে।
রায়হান-এই রোদে কাজ করছ, তোমার তো অুসখ হয়ে যাবে।
মৃদু হেসে জুয়েনা বলল-এসব আমার সহ্য হয়ে গেছে।
-প্রতিদিন তুমি কি জমিতে কাজ কর
-হঁ্যা,
-পড়াশোনা করনি,
-নোনাহার স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি।
-আর পড়লে না কেন।
-বাবার কাজে সাহায্য করার কেউ তো নেই তাই।
-তোমার ভাই নেই?
-না
-তোমার বাবা কখন আসবেন?
-বাবা আজান দিলে চলে যায়, তারপর তার ইচ্ছা হলে আসে না হলে নাই, আমি এখন চলে যাব।
আচ্ছা আসি, বলে রায়হান চলে যায়, রায়হানের চলে যাওয়ার পথে জুয়েনা চেয়ে থাকে। অসম্ভব সুন্দর ছেলে, কথাবার্তা ব্যবহারটাও অমায়িক, সাঁওতাল বলে তার সঙ্গে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেনি। মৃদু হেসে হেসে কথা বলেছে। রায়হান চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর জুয়েনাও জমি থেকে উঠে খাড়ির পানিতে হাত-পা ধুয়ে বাড়ি চলে যায়।
রাতে শুয়ে শুয়ে জুয়েনার রায়হানের হাস্যোজ্জল মুখটা মনে পড়ে। এদিকে রায়হান রাতে শোয়ার পর ভাবতে থাকে সাঁওতালদের মেয়ে এতটা সপ্রতিভ। দেহে অবয়বটি তার অসাধারণ। শুধু গায়ের রংটা কালো, এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে রায়হান ঘুমিয়ে যায়।
পরের দিন জোহরের পর রায়হান আবার ক্ষেত দেখতে যায়। আশা-নিরাশায় ভুগছিল জুয়েনাকে পাবে কিনা। জুয়েনা নিচু হয়ে আগাছা তুলতে তুলতে রায়হানের কথা ভাবতে ছিল।
-কেমন আছ,
কথাটা শুনে জুয়েনা হতচকিয়ে যায়, হাত জোরে নমস্কার বলে, ভালো আছি।
-তুমি কি গল্প উপন্যাস পড়েছ।
-হুম, শরৎ চন্দ্রের লেখা দত্তা, দেবদাস, ও নজরুলের শিউলিমালা পড়েছি আরও কিছু বই।
কথা শুনে রায়হান একটু অবাক হয়ে বলে-বইগুলো কিনেছ?
-না।
-পেলে কোথায়।
-স্কুলের লাইব্রেরিতে।
মেয়েটার পড়ার আগ্রহ দেখে রায়হান ভাবে সুযোগ পেলে এই মেয়েটা অনেক বড় কিছু হতে পাড়ত। জুয়েনার জন্য রায়হানের একটা টান অনুভব করে। গত রাতের লেখা চিঠিটা, জমির আইলের ঘাসের ওপর রেখে, মাটির টুকরো দিয়ে চাপা দিয়ে বলে, এ কাগজটা তোমার জন্য। জুয়েনা আড়চোখে দেখে নেয়। চিঠিটা রেখেই রায়হান দ্রম্নত চলে যায়। প্রতিদিনের মতো কাজ শেষ করে জুয়েনা কাগজটা কোমরের কুচে ভরে নিয়ে বাড়ি যায়।
রাতে বাড়িতে কাগজের লেখাগুলো পড়ে অবাক হয়ে যায়, তাতে লেখা আছে- 'জুয়েনা, তোমাকে কি বলতে গিয়ে, কি ভুল করে ফেলি তা বুঝতে পারছি না। তুমি আমার কাছে শরতের শিউলির মতো স্পর্শকাতর, তবে তুমি আমার অনুভূতিতে অনুমেয়। মনে হয় ধরতে গেলে হয়তো কর্পূরের মতো উবে যাবে, এ রকমটা হলে হয়তো তোমাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলব। আমার প্রত্যাশার বাতিটা নিভে যাবে, তাই হারানোর ভয়ে মনে মনে একধাপ এগুলে দুধাপ পিছিয়ে যাই। আমাদের জীবনে শুরু হলো বসন্ত। প্রথম বসন্তে তোমাকে দেখার পর প্রত্যাশ্যার আকুলতা এতটা বাড়ল কেন? তা বুঝতে পারছি না? হৃদয়ে অদ্ভুত একটা টান অনুভব করছি। এ টানের পরিসমাপ্তি জটিল তবে অসম্ভব নয়? বাকি ভাবনাটা তোমার। ইতি-রায়হান।
জীবনের প্রথম প্রেম নিবেদন, জুয়েনা ভাবনার জালে সারারাত ঘুমাতে পারেনি। এদিকে রায়হানের ভয়ে রাতে ঘুম আসেনি। যদি জুয়েনা চিঠিটা তার বাবাকে দেখায় আর তার বাবা যদি এটা রহমান প্রমাণিককে দেয়, তা হলো তো রক্ষে নেই।
পরের দিন জুয়েনা জমিতে যায়, বেলা গড়ার পরও রায়হানের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু রায়হান আসে নাই। রায়হান ভয়ে আসে নাই।
প্রতিদিন জুয়েনা জমিতে গিয়ে অপেক্ষা করে রায়হানের। অপরদিকে ভার্সিটি খুলে যাওয়ায় রায়হান ঢাকা চলে যায়। রায়হান প্রতি বিকালে জুহুরুল হক হলের শান বাঁধানো ঘাটে বসে, পানিতে দেখতে পায় জুয়েনার মুখ আর জুয়েনা অধীর প্রতীক্ষায় প্রহর গোনে রায়হানের। রায়হান জমিতে এসে ভরাট কণ্ঠে বলে উঠবে, 'কেমন আছ।'