রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাংলা ভাষা বাঙালির আত্মপরিচয়

জহিরুল ইসলাম
  ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বাংলা ভাষা বাঙালির আত্মপরিচয়
বাংলা ভাষা বাঙালির আত্মপরিচয়

দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান। পড়েন ঢাকার এক নামকরা ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে। দেশের ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা আর বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ বাবা-মায়ের মতো নুসরাতের বাবা-মা ইংরেজির গুরুত্ব অনুধাবন করে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়ালেও পরবর্তী সময়ে ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করান। এরপর থেকে তার বাবা-মা তাকে ইংরেজি শেখাতে ব্যস্ত ছিলেন। নুসরাতকে বাসায় বাংলা বলার সুযোগ কমিয়ে দিয়ে, টিভি-সিনেমাও ইংরেজিতে দেখতে অভ্যস্ত করেন। বাংলা বই পড়ার চেয়ে ইংরেজি রম্যচিত্র গল্প, উপন্যাস, ওয়েব ধারাবাহিক সে বেশি দেখত।

তবে, নুসরাতের ছোটভাই রাজীব খুব ভালো বাংলা পারত। নুসরাতের দুই বছরের ছোট হলেও নুসরাত রাজীবের অনেক কিছু অনুসরণ করত। শুধু রাজীবের বাংলা পান্ডিত্যই অনুসরণ করত না। রাজীবের বাংলা ভাষার প্রতি আলাদা টান থাকায়, বাংলা ভাষার ইতিহাস জানার পাশাপাশি বাংলা পড়া এবং লেখাতে সমান পারদর্শী ছিল। সে নিজের ইচ্ছায় বাংলা মাধ্যমেই পড়াশোনা করছিলেন।

1

নুসরাতের বিদ্যালয়ের বন্ধুরাও সবাই প্রায় একই রকম, ইংরেজিতেই কথা বলে। বাংলা বলার চেষ্টা করলে যেন লোকাল লোকাল মনে হয়। আধুনিক কিশোর-কিশোরীদের ভাষায় যাকে বলা হয়, 'মেয়াদউত্তীর্ণ'! বাংলা পড়া তার কাছে বিরক্তিকর মনে হতে শুরু করল। শিক্ষকরা কিছু জোর করলেও, নুসরাতের মনে হতো, বাংলা দিয়ে কি হবে? এই বাংলা পড়া আমার কোনো কাজে লাগবে? পাস করতে পারলেই হয়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি শিখতে শিখতে আর এর কত শত ভবিষ্যতের গল্প আর বাস্তবতার আয়নায় বাংলার স্পষ্টতা হারায় নুসরাতের। এর মধ্যে চলে আসে ভাষার মাস ফেব্রম্নয়ারি। ভাষার মাসে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো তাদের বিদ্যালয়েও নানা আয়োজন করা হয়। একুশে ফেব্রম্নয়ারিতে দিনব্যাপী আয়োজন করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠান। নুসরাত এসব একদম পছন্দ করত না। সে অন্য বন্ধুদের বলতে লাগল এসবতো শুধু বাংলা মাধ্যমে যারা পড়ে তাদের জন্য। আমি এসব দিয়ে কি করব।

কিন্তু সমস্যায় পড়েন অন্য জায়গায়। আয়োজনে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল। তাই নুসরাতকে কোনো না কোনো একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেই হবে এবং সেখানে সবাইকে বাংলা ভাষায় কথা বলতে হবে। এই দেশে জন্ম নিলেও তার মা-বাবা বাংলাদেশি হলেও এটা ছিল তার জন্য কঠিন।

নুসরাত মনে মনে ভাবতে লাগল, ঠিকঠাক বাংলা বলতে পারাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ঠিকমতো উচ্চারণও করতে পারি না! ইংরেজির টান চলে আসে আর মুখেও জড়তা, অস্পষ্টতা। লিখতে গেলেও বানান থাকে ভুলে ভরা। মনে মনে পড়তেও কষ্ট। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার কারণে বন্ধুদের মধ্যেও কেউ বাংলা ভালো বলতে পারে না। কার কাছ থেকে সাহায্য নেবেন!

সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে অংশ নেওয়ার জন্য নাম নিবন্ধন শুরু করলেন। কে কোন বিষয়ে অংশগ্রহণ করবেন, তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য সময় দেওয়া হলো। নুসরাত কোনো কিছুতেই নাম দিচ্ছিলেন না। পরে তার শিক্ষকরা তাকে বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত করলেন। বিষয়টি জেনে কিছুটা চিন্তায় পড়লেন নুসরাত।

এসব চিন্তায় কয়েকদিন কেটে গেল শুরু হয়ে গেল প্রতিযোগিতা। দুই দিনের অনুষ্ঠান শেষে এবার তৃতীয় দিনে মিলনায়তনে বড় আয়োজন। ছোট বড় বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছে। কেউ বাংলা লোকগীতি গাইছেন, কেউ আধুনিক গান। কেউ করছেন সুন্দর প্রমিত বাংলা কবিতা আবৃত্তি। এদিকে নুসরাতের কপালে চিন্তার রেখা দেখা গেল। অনুষ্ঠানের পরিবেশের সঙ্গে একদমই মানিয়ে নিতে পারছে না।

এমন সময় ডাক পড়ল তার। মঞ্চে উঠে সে খুব চিন্তিত অবস্থায় কথা বলতে পারছিল না। যদি ইংরেজিতে কথা বলতে হতো তবে সে ভালোভাবেই হয়তো পারত। বাংলা ভাষা সম্পর্কে তার অনেক কিছু জানা থাকলেও সে তো বাংলা বলতেই পারছিল না। কথা বলতে শুরু করলেও তার গলা কাঁপছিল। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে সে অনেকটা ঘামিয়ে গেল। এমন অবস্থায় তাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এমন ঘটনায় নুসরাত অনেকটা অপমানবোধ করে।

কারণ, এ সময় দর্শকরা সবাই খুব হাসাহাসি করছিল। পরিবেশটা এমন- তার কাছের বন্ধুরাও চুপিসারে হাসছিল। বিচারকরা বিচারকার্য বাদ দিয়ে তার অবস্থা দেখছিল। সেদিন নুসরাত অপমানে নিজের মনে ক্ষোভ নিয়ে বাসায় ফিরলেও লজ্জায় ভেঙে পড়ল। তবে, তার মাথায় এলো সে বাংলায় পারদর্শী যেভাবেই হোক হবে। আর এতে ছোট ভাই রাজীবের সহায়তা নেবে।

সেই দিন বিকালে বাসায় এসেই সে বাংলা শিখতে সময় দেওয়া শুরু করল। প্রথমে বাংলা বই খোলার চেষ্টা করল। তার ছোট ভাই রাজীব, যে বাংলা মাধ্যমে পড়ে তার বই পড়তে থাকে।

নিজের বই পড়তে দেখে রাজীব বলল, কিরে আপু আজ হঠাৎ কি হয়েছে। তুই বাংলা পড়তে চেষ্টা করছিস।

- আরে- না, তেমন কিছু না। এমনিতেই পড়ছি আরকি। তুই তোর কাজ করে যা।

- ও আচ্ছা বুঝলাম। আপু সত্যি করে বলত কি হয়েছে? আর তুই কি চাচ্ছিস?

অনেকটা রাগ আর ক্ষোভে নুসরাত কেদে ফেললেন! তার মুখ দিয়ে আর কথা বের হচ্ছিল না। চোখ, কপাল লাল হয়ে গেছে। অবস্থা দেখে রাজীব বুঝতে পারল, কিছু একটা হয়েছে। যাতে বোন অনেক কষ্ট পেয়েছেন। তাই দৌড় দিয়ে গিয়ে মাকে ডেকে নিয়ে এলো। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হলো না। পরে বিষয়গুলো রাজীবকে খুলে বলে নুসরাত। জানার পর ছোট ভাইয়ের ভরসা পেল নুসরাত।

রাজীব বলল- আপু তুই চিন্তা করিস না। আমি তোকে বাংলার সব ঠিক করে দেব। নুসরাত তখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলল- বাংলা জানলে কী হবে? আমিতো ইংরেজি মাধ্যমে পড়ি। আমিতো জানি আমার ভবিষ্যতের সবকিছু ইংরেজির ওপর নির্ভর করছে। সবাইতো খালি ইংরেজি শেখ, ইংরেজি শেখ- বলতে থাকে। আজকের অপমান আমি মেনে নিতে পারছি না-রে। এত সময় দুই ভাইবোনের কথা শুনছিলেন তাদের মা আলিফা রহমান। সব শুনে বুঝে তিনিও নুসরাতকে বুঝাতে শুরু করলেন।

- আচ্ছা মা- যা হয়েছে, তাতো হয়েছেই। এসব নিয়ে তুমি আর ভেবো না। ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেও নিজের দেশের ভাষা জানতে হয়। তা না হলে নিজের শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না। মায়া থাকে না। তাই তোমাকে বাংলা শিখতে হবে। ভাষাকে ভালো না বাসলে দেশকে কি করে ভালোবাসবে? বাংলা শিখতে তোমাকে রাজীব এবং আমরা সহায়তা করব। মায়ের মুখের এমন কথা নুসরাতের হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি করল। বিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার ক্ষোভ আর রাগ গলতে শুরু করে। অপমানের জন্য শুধু বাংলা শেখা নয়! সে ভাবলো সত্যিই তো, সে কি তবে নিজের ভাষাকে অবহেলা করছে?

সেদিন থেকে নুসরাত ঠিক করল, বাংলা শিখতে হবে। সে রাজীবের বাংলা বইগুলো পড়তে শুরু করল। প্রথমে কঠিন লাগলেও ধীরে ধীরে তার আগ্রহ বাড়ল। বাংলা কবিতা, গল্প, ইতিহাস- সবকিছুই যেন নতুনভাবে ধরা দিল। একদিন তার বাংলা শিক্ষকের কাছে গিয়ে তাকে একরকম অবাক করে দিল নুসরাত। এমনিতে সে সব সময় বাংলা শিক্ষকের সঙ্গেও ইংরেজিতে কথা বলতো। সেদিন সে বলল- স্যার আমি কি আসতে পারি? আপনার সঙ্গে কথা ছিল।

তার শিক্ষক হেসে ওঠলেন।

- আরে নুসরাত তুমি দেখি বাংলায় কথা বলছো!

- জ্বী স্যার আমি বাংলা শিখেছি। এখন বলতেও পারি।

- খুব ভালো খবর। এটা আনন্দের। একটা কথা মনে রেখো- ভাষা শেখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভালোবাসা। তুমি যদি বাংলা ভালোবাসতে পারো, তবে বাংলা তোমার কাছে সহজ হয়ে যাবে। শিক্ষককে জানানোর পরও থেমে থাকলেন না নুসরাত। সে প্রতিদিন বাংলা চর্চা করতে লাগল। বাংলা পত্রিকা পড়া, নতুন শব্দ শেখা, এমনকি সবাইকে অবাক করে দিয়ে দিল- বন্ধুরা মিলে একটা বাংলা বিতর্ক সংগঠনও চালু করল। বছরব্যাপী তারা বিভিন্ন আয়োজন করতে থাকলো বাংলা নিয়ে। এসব করতে করতে বছর শেষ হলো।

এক বছর পর, ভাষার মাসে আবারও বাংলা নিয়ে নুসরাতের বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করল। এবার স্বেচ্ছায় বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে মাতৃভাষা নিয়ে মঞ্চে আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বক্তব্য দিয়ে সবার প্রসংশা পেলেন। সে বলল- ভাষা শুধু কথা বলার মাধ্যম নয়, এটা আত্মপরিচয়ের প্রতীক। মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে, নিজের শেকড় থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে