বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

শতবর্ষে বোরহানউদ্দিন কামিল মাদ্রাসা

বোরহানউদ্দিন (ভোলা) প্রতিনিধি
  ০৫ জানুয়ারি ২০২২, ১৪:০৬
শতবর্ষে বোরহানউদ্দিন কামিল মাদ্রাসা

‘শতবর্ষের আহ্বানে, এসো মিলি শিকড় পানে’ এ শ্লোগানে শনিবার (৮ জানুয়ারি) দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে বোরহানউদ্দিন কামিল মাদ্রাসার শতবর্ষ পূর্তি উদ্যাপন অনুষ্ঠান। ইতিমধ্যেই মঞ্চ,সাজ-সজ্জার কাজ শেষ। চারিদিকে উৎসবের আমেজ। সেই ১৯৬৯ সাল থেকে সাবেক শিক্ষার্থীরা রেজিস্ট্রেশন করেছেন। দীর্ঘ সময় পর তারা মাদ্রাসা জীবনের বন্ধুদের সাথে আবার দেখা হবার প্রহর গুনছেন। পিছিয়ে নেই বর্তমান শিক্ষার্থীরাও। বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা রোড শো, ‌র‌্যালি, আলোকসজ্জা করে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনেকে আবার ব্যাচ ওয়ারী নিজেদের মত করে আলাদা টি’ শার্ট স্ক্রীন প্রিন্ট করে ফটোসেশনে ব্যস্ত।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকছেন সাবেক বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকছেন ভোলা-২ আসনের সাংসদ আলী আজম মুকুল। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬-৭ জন অধ্যাপক, জেলা প্রশাসক সহ স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গগণও অনুষ্ঠানে আসছেন।

বর্তমানের বোরহানউদ্দিন কামিল মাদ্রাসা এক সময় ভোলা সদরের বাপ্তা ইউনিয়নে ছিল। ভোলা সদর উপজেলার বাপ্তা ইউনিয়নের টবগী গ্রামের বিদ্যোৎসায়ী দানবীর মরহুম মৌলভী কেরামত আলী ও মরহুম দলিল উদ্দিন নামের আপন দু’ভাই এর ওয়াকফকৃত ৯ দশমিক ৬০ একর জমিতে ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে টবগী মাদ্রাসা নামে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। পর্যায়ক্রমে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে দাখিল, ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে আলিম ও ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ফাযিল স্তর স্বীকৃতি পায়। তখন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয় টবগী সিনিয়র মাদ্রাসা। ১৯৫৭ সালে প্রমত্তা মেঘনার কড়াল গ্রাসে মাদ্রাসাটি প্রথম নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়। নদী ভাঙ্গনের পর ১৯৫৭ সালে ভোলা সদরের নাছির মাঝি এলাকায় মাদ্রাসাটি স্থানান্তরিত হয়। মরহুম মৌলভী গোলাম রহমান পন্ডিতের ওয়াকফকৃত জমিতে মাদ্রাসা স্থানান্তরিত হলে টবগী-নাছির মাঝি সিনিয়র মাদরাসা নামকরণ করা হয়। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে কামিল হাদিস বিষয়ে পাঠদান শুরুর মাধ্যমে মাদ্রাসাটি আলীয়া মাদ্রাসায় উন্নীত হয়ে নাছির মাঝি আলীয়া মাদরাসা নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে কামিল (আলীয়া) মাদরাসা হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে।

১৯৬৬ সালে নাছির মাঝি এলাকা মেঘনার কড়াল থাবায় মাদ্রাসাটি দ্বিতীয়বার একেবারে নদী গর্ভে প্রায় বিলীন হয়ে যায়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ মাদরাসাটি দ্বিতীয় বারের মত স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু মাদ্রাসা স্থানান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় জমি ও দাতা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ওই অবস্থায় মাদ্রাসার তৎকালীন মুহাদ্দিস মরহুম মাও: নুরুল হক সাহেব (ইদারার হুজুর) বোরহানউদ্দিন উপজেলার দানবীর মরহুম মৌলভী আ: জলিলের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি স্থানান্তরের বিষয়ে সম্মাতি জানান। মরহুম মাও: নুরুল হক সাহেব এ ব্যাপারে নাছির মাঝি আলীয়া মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে জানালে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ নোয়াখালীর মরহুম মাও: আজিজুল্যাহ’র নেতৃত্বে মাদরাসার জন্য প্রস্তাবিত স্থান সরেজমিনে পরিদর্শনের জন্য এক প্রতিনিধিদল বর্তমান মাদরাসা স্থানে আসেন। ওই সময় তারা রাণীগঞ্জ বাজার হাফেজিয়া মাদ্রাসা মসজিদে বসে স্থানীয় জনগণের সাথে মতবিনিময় করেন। জণগণের আগ্রহে মাদ্রাসাটি আজকের স্থানে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়।

সরকারি বিধি অনুযায়ী মাদ্রাসা স্থানান্তরের জন্য মরহুম মৌলভী আ: জলিল নিজ মালিকানধীন জমি হতে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান ক্যাম্পাসের ২.৬০ একর জমি মাদ্রাসার নামে ওয়াকফ করেন। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষসহ মাদ্রাসাটি স্থানান্তরের অনুমতি চেয়ে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বরাবর আবেদন করেন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে মরহুম মৌলভী আ: জলিলের নেতৃত্বে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ মাদ্রাসার যাবতীয় নথি ও আসবাবপত্র নাছির মাঝি থেকে বোরহানউদ্দিনে নিয়ে আসেন। এলাকার জণগণের সাথে পরামর্শ করে বর্তমান স্থানে মাদ্রাসার ঘর নির্মাণ শুরু করেন। মৌলভী আ: জলিল মাঠ ভরাটসহ নির্মান কাজের জন্য নিজ মালিকানার জমি বিক্রি করে অর্থায়নের ব্যবস্থা করেন। তখন মাদ্রাসার নামকরণ করা হয় টবগী-রাণীগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসা।

প্রাথমিক পর্যায় অধ্যক্ষ কোয়াটারসহ প্রথম শ্রেণি থেকে কামিল শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাশ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মোট ১৬টি কক্ষ ও অফিস কক্ষসমূহ নির্মাণ করেন। পাঠদান কার্যক্রম সূচনা লগ্নে মাদ্রাসার নাছির মাঝির শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়ে আসেন। তাদের মরহুম মৌলভী আ: জলিল নিজ বাড়িতে ও এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে লজিং পদ্ধতিতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। নাছির মাঝি থেকে আগত সকল ছাত্রদের লজিংয়ের ব্যবস্থা করা হয় তার নিজ বাড়িতে ও রাণীগঞ্জ এলাকায়। মাদ্রাসা বোরহানউদ্দিনে স্থানান্তরিত হওয়ার পরেও দীর্ঘদিন ভোলার নাছির মাঝির কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে।

ওই কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তৎকালিন ভোলার মহকুমা প্রশাসক। পরবর্তী সময় ওই কমিটি মাদ্রাসার রিজার্ভ ফান্ডের টাকা উত্তোলনের উদ্যোগ নিলে মরহুম মৌলভী আ: জলিল জানতে পেরে টাকা উত্তোলন করতে দেননি বরং নিজ থেকে রিজার্ভ ফান্ডে রক্ষিত সমপরিমান টাকা তাদের পরিশোধ করে দিয়ে মাদ্রাসার রিজার্ভ ফান্ড বহাল রাখেন। মাদ্রাসা স্থানান্তরকালিন সময় থেকেই এলাকার শিক্ষানুরাগী ধর্মপ্রাণ অসংখ্য দানবীর ও শুভাকাঙ্খী ব্যক্তিগণ জমিদান করে ও কায়িক শ্রম এবং সমর্থন দিয়ে মাদ্রাসার উন্নয়নে সহযোগিতা করেছেন। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে কুতুবা আ: জব্বার মিয়া বাড়ির ওয়াকফ স্টেট থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক সাংসদ(এমএলএ) মরহুম মো: রেজা-এ-করিম চৌধুরী (চুন্নু মিয়া) কাচিয়া মৌজায় ১.৬০ একর জমি দান করেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রাসা পার্শ্ববর্তী আরব আরব আলী হাওলাদার বাড়ির মরহুম আলহাজ্ব বাদশা মিয়া হাওলাদারের নেতৃত্বে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি থেকে মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে ৫৪ শতাংশ জমি দান করেন। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বড় মানিকা ইউনিয়নের মরহুম মৌলভী আব্দুস শহীদ (মশু মৌলভী) তাঁর পারিবারিক সম্পত্তি থেকে কুড়ালিয়া মৌজায় ১.২০ শতাং জমি মাদ্রাসা নামে ওয়াক্ফ করেন। এ ছাড়া আরো অনেকেই মাদ্রাসায় কম- বেশি জমিদান করেন।

বর্তমানস্থানে প্রথম পরিচালনা কমিটি গঠনকালে ভোলার মহকুমা প্রশাসক সভাপতি ও পক্ষিয়া ইউপির তৎকালিন চেয়ারম্যান মরহুম ইয়াছিন ভুঁইয়াকে (বলু ভুঁইয়া) সহসভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মৌলভী আ: জলিলকে সেক্রেটারী করে কমিটি গঠন করা হয়। তখন থেকে প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মৌলভী আ: জলিল আমৃত: কমিটির সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মৌলভী আ: জলিলকে ইন্তেকালপূর্ব ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর ইন্তেকালের পরে মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে মসজিদের পশ্চিম পাশে সমাহিত করা হয়।

১ জানুয়ারি ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রাসাটি ইবতেদায়ী প্রথম থেকে কামিল শ্রেণি পর্যন্ত সরকারিভাবে এমপিওভুক্ত হয়। পদাধিকার বলে মাদরাসার অধ্যক্ষ সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করবেন সরকারীভাবে এ বিধান হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রাণীগঞ্জ বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ্ব মো: আবুল কাশেম মিয়াজি দীর্ঘ ১৭ বৎসর সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান স্থানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বড় মানিকা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জিয়াউল হক পঞ্চায়েত মাদ্রাসার সার্বিক কাজে সহযোগিতা করতেন। মাদ্রাসা উন্নয়নে আরো যারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে মরহুম বশির আহমদ মিয়া (সাবেক পৌর চেয়ারম্যান), মাও: মো: বশির উল্যাহ (মরহুম পীর সাহেব বাটামারা দরবার শরীফ), মরহুম আলহাজ্ব মাষ্টার জহুরুল হক পাটওয়ারী, মরহুম শাহজাহান খান ভাষানী (সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান) মরহুম আলহাজ্ব মাও: সৈয়দ আহমদ পঞ্চায়েত, মরহুম সিরাজুল হক মিয়া, আলহাজ্ব মো: ছানা উল্যাহ মিয়া (দাতা অত্র মাদ্রাসা), প্রয়াত প্রাণ কুমার দাস (রাণীগঞ্জ বাজার), নুরু মিয়া হাওলাদার প্রমুখ।

মরহুম আলহাজ্ব মাও: মফিজুল হক সাহেব ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম মাদরাসায় পাবলিক পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হয়। প্রথমে দাখিল পর্যায়ক্রমে আলিম, ফাজিল ও কামিল শ্রেণির পরীক্ষা কেন্দ্রে উন্নীত হয়।

আর তখন পরীক্ষা কেন্দ্রের জন্য আবেদনের সুবিধার্থে মাদরাসার ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে মাদ্রাসার নাম পরিবর্তন করে বোরহানউদ্দিন আলীয়া মাদ্রাসা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।

১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে এ মাদ্রাসায় যথাক্রমে দাখিল ও আলিম শ্রেনিতে বিজ্ঞান শাখা সরকারি অনুমোদন সাপেক্ষে চালু করা হয়। ১৯৯৬ সালে কামিল শ্রেণিতে ফিকহ বিভাগ খোলা হয়। ২০০৩ সালে দাখিল শ্রেণিতে কম্পিউটার বিষয় খোলা হয় । ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে মাদরাসা শিক্ষাকে জেনারেল শিক্ষার সাথে সমমানে সমন্বিত করায় দাখিলকে মাধ্যমিকের মান দেয়া হয়। তখন মাদ্রাসার নাম করণে চারটি ধাপ বা স্তর সৃষ্টি করা হয়। দাখিল সমমান মাধ্যমিক, আলিম সমমান উচ্চ মাধ্যমিক,ফাজিল সমমান স্নাতক ও কামিল সমমান স্নাতকোত্তর। ফলে মাদরাসাটির নাম আবার বোরহানউদ্দিন কামিল মাদ্রাসা নামে রূপান্তর হয়। ২০২১ শিক্ষা বর্ষে ইবতেদায়ী প্রথম শ্রেণি থেকে কামিল স্নাতকোত্তর শ্রেণি পর্যন্ত মাদরাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৬৭৭ জন।

স্বনামধন্য অনেক গুণি শিক্ষাবিদ ও ইসলামী পন্ডিত এ মাদ্রাসায় প্রশাসনিক ও একাডেমিক দায়িত্ব পালন করে ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভুমিকা রেখেছেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৪২ খ্রি: পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী সুপার ও অধ্যক্ষগণের নাম ও তথ্য পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ের সুপার ও অধ্যক্ষগণের নাম ধারাবাহিক পাওয়া গেছে। মরহুম আলহাজ্ব মাও: মুফতি মো: সিরাজুল হক শরীফ (সুপার) মরহুম মাও: মো: আজিজুল্যাহ (সুপার ও অধ্যক্ষ) মরহুম মাও: মো: মোখলেছুর রহমান (অধ্যক্ষ) মরহুম মাও: মো: ফজলুল করিম (নোয়াখালী) (অধ্যক্ষ) মরহুম মাও: মো: আমিনুল্যাহ (মোহাদ্দিস ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ) মরহুম মাও: মো: আ: রহমান খাঁন (অধ্যক্ষ) মরহুম মাও: মো: মোস্তাফিজুর রহমান (অধ্যক্ষ) জনাব মাও: মো: ফখরুল আলম হাতিয়া (মুহাদ্দিস ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ), মরহুম মাও: মো: মফিজুল হক (অধ্যক্ষ)।

যাযাদি/এমডি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে