মাদারীপুরের খেঁজুরের গুড় এক সময় ছিল খুবই ঐতিহ্যবাহী। ২০ থেকে ২৫ বছর পূর্বে জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই প্রচুর খেজুর গাছ ছিল। সেই খেঁজুর গাছ থেকে শীত আসলেই গ্রামের গাছিরা খেঁজুর রস সংগ্রহ করে সু-স্বাদু গুড় উৎপাদন করতেন। শহর, গ্রাম সর্বত্রই ছিল পিঠা, পায়েস তৈরীর ধুম। ঐতিহ্যবাহী সেই খেঁজুরের গাছকে জেলা প্রশাসন জেলার ব্রান্ডিং হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অথচ এক শ্রেণির অসাধু গুড় ব্যবসায়ীরা জেলার সেই বিখ্যাত গুড়ে রং, চিনি আর বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে প্রকাশ্যেই তৈরী হচ্ছে খেঁজুর গুড়। যা খাঁটি বলে বিক্রি হচ্ছে মাদারীপুরের বিভিন্ন হাটবাজারে। প্রতি কেজি গুড় বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে আড়াইশো’ থেকে পাঁচশত টাকায়। প্রতি বছর শীত মৌসুম আসলেই অধিক লাভের আশায় অসাধু গুড় ব্যবসায়ীরা এই অসৎ কাজ করছে।
জানা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা, কালিকাপুর, ছিলাচর, জাফরাবাদ, তাল্লুক, খোয়াজপুর, ঝাউদি, ঘটমাঝি, কেন্দুয়া, বাজিতপুর, কলাগাছিয়া, পেয়ারপুর, মোস্তফাপুর শিবচরের বিভিন্ন গ্রামে, কালকিনি, ডাসারসহ জেলার বিভিন্ন গ্রামে শতশত গুড় ব্যবসায়ীরা সামান্য খেঁজুর রসের সাথে পানি, চিনি, আঁখের গুড়, বিষাক্ত হাইড্রোজ, সালফার আর রংয়ের মিশ্রণে তৈরী করছে গুড়। যা দেখে বোঝার উপায় নেই কোনটি আসল, আর কোনটি নকল।
এসব গুড় কিনে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে ক্রেতারা। বিক্রেতারা বলছেন, খাঁটি গুড় তৈরী হলে নায্য দাম পাওয়া যায়না। তাই বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে ভেজাল গুড়।
জানা যায়, ইটভাটায় খেঁজুর গাছ ব্যবহার করায় কমেছে গাছের সংখ্যা। দেখা দিয়েছে রসের সংকট। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তৈরী হচ্ছে ভেজাল গুড়। স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কায় এসব গুড় তৈরী বন্ধে জোড় দাবি জানিয়েছেন ক্রেতারা। কিন্তু এসব প্রতি কেজি ভেজাল গুড় বিক্রি হচ্ছে আড়াইশো থেকে পাঁচশত টাকা কেজি দরে। অথচ, এক কেজি খাঁটি গুড়ের দাম ৮০০-৯০০ টাকা।
খোয়াজপুর এলাকার ক্রেতা হানিফ মিয়া বলেন, ‘আগে খেজুর গুড় থেকে আলাদা একটা গন্ধ ও স্বাদ পাওয়া যেতো। ভেজালের পরিমান বেড়ে যাওয়ায় গন্ধ আর স্বাদ কোনটাই পাওয়া যায়না। প্রশাসন স্বোচ্চার থাকলে অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব করার সাহস পাবে না।
রহিম নামে এক গুড় প্রস্তুতকারী ও ব্যবসায়ী বলেন, আমি প্রায় ৪০ বছর ধরে গুড়ের ব্যবসায় করি। ২০ থেকে ২৫ বছর পূর্বেও খুব ভালো মানের খেজুরের গুড় বিক্রি করতাম। এখন ভালো-মন্দ দুটাই বিক্রি করি। আমরা গ্রাম থেকে যে দাম গুড় কিনে আনি তার থেকে সামান্য লাভে বিক্রি করি। আমার কাছে আড়াইশ টাকা থেকে আটশ টাকা পর্যন্ত গুড় আছে। ‘খাঁটি গুড় তৈরী করলে কেউ সঠিক দাম দেয় না। হালকা চিনি মিশিয়ে তৈরী করলে বাজারে বেশি বেশি বিক্রি হয়, ক্রেতারাও অল্পদাম দিয়ে গুড় কিনে নেয়।’ বেশি দামের গুড় মানুষ কেনে না।
মান্নান নামে আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগে খাঁটি গুড় তৈরী করতাম খেজুর রস দিয়ে। এখন রস কমে গেছে, তাই শতভাগ খাঁটি গুড় পাওয়া সম্ভব না। আমি নিন্ম মানের গুড় বিক্রি করি না। পাঁচশত টাকা থেকে আটশত টাকায় আমি উন্নতমানের ভালো গুড় বিক্রি করি।
মাদারীপুর জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মো. জুয়েল মিয়া জানান, কয়েকদিন পূর্বে আমরা জেলার গুড় ব্যবসায়ীদের নিয়ে মিটিং করে তাদের সতর্ক করেছি যাতে তারা গুড়ে ভেজাল কোন কিছু মিশ্রণ না করে। তারপরেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় হাট-বাজরে ভেজাল গুড় বিক্রি করছে। এই গুড় খেলেই বিভিন্ন রোগ হতে পারে। তাই ক্রেতাদের সতর্ক হতে হবে। জেলার কয়েকটি জায়গায় আমরা অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা করেছি।
এছাড়া আর্থিক জরিমানাও করা হয়েছে। ভোক্তার স্বার্থে এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
যাযাদি/ এম