শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ভোমরা কাস্টমস শুল্ক স্টেশনের ডেপুটি কমিশনারের সীমাহীন দূর্নীতি

এক মাসে ফলের ট্রাক থেকে আয় প্রায় ২ কোটি টাকা
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি
  ০৪ মে ২০২৪, ১৬:৩৫
ছবি-যায়যায়দিন

দূর্নীতির কারণে পদোন্নতি আটকে গেছে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই দূর্নীতি। বেড়ে গেছে দূর্নীতির মাত্রাও। বিভিন্ন অযুহাত সৃষ্টি করে আমদানিকারকদের কাছ থেকে প্রতিদিন হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। ভোমরা কাস্টমস শুল্ক স্টেশনের ডেপুটি কমিশনার এনামুল হকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে আমদানি ও রপ্তানীকারকরা। তার এই সীমাহীন দূর্নীতির কারনে অতিষ্ট হয়ে পড়েছে ভোমরা স্থল বন্দর ব্যবহারকারীরা। এই দূর্নীতির একটি হিস্যা চলে যাচ্ছে সিএন্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের এক নেতার পকেটে। যার কারনে ভোমরা স্থলবন্দর ব্যবহারকারী আমদানি ও রপ্তানীকারকদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একাধিক আমাদনিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টের সাথে কথা বলে দূর্নীতির এই চিত্র পাওয়া গেছে।

সূত্র মতে, আমদানিজাত ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশের পর ভোমরা শুল্ক স্টেশনে নগদ ২ হাজার টাকা না দেওয়া পর্যন্ত বি/ই এন্টি নং ফেলতে দেওয়া হয় না। তবে, আমদানিজাত পণ্যের প্রকারভেদে প্রতিটি বি/ই এন্ট্রিতে আমদানিকারকদের অতিরিক্ত ঘুষ দিতে হয়। তা না হলে আমদানিকারকের মনোনীত সিএন্ডএফ এজেন্ট এর কর্মচারীকে প্রতিনিয়ত নাজেহাল করা হয়। ভারতীয় প্রতি ট্রাক ফলের বি/ই এন্ট্রি নং ফেলার সময় ২ হাজার টাকা ছাড়া ও আরো অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা ঘুষ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এছাড়াও ফলের ট্রাক পরীক্ষণের সময় আরো ৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়। বেনাপোল বন্দরের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোলে যানজটের কারনে গত মার্চ মাসে ভোমরা বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ৪০-৫০ ট্রাক ফল আমদানি হতো। প্রতিটি ফলের ট্রাক থেকে ১৭ হাজার টাকা হারে প্রতিদিন প্রায় ৭ লক্ষ টাকা ঘুষ আদায় করা হতো। বেনাপোল বন্দরের বিপরীতে যানজট কমে যাওয়ায় ভোমরা বন্দরে ফল আমদানি হ্রাস পেয়েছে। তারপরও প্রতিদিন ফলের ট্রাক থেকে নির্ধারিত হারে ঘুষ আদায় অব্যাহত রয়েছে।

ভারতীয় প্রতিটি হলুদের ট্রাকের বি/ই এন্ট্রিতে ৪ হাজার টাকা, শুকনা মরিচের ট্রাকে ৫ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। সাপটার আওতায় ১০০মে. টন ভারতীয় সরিষার খৈল আমদানি করতে হলে কাস্টমস শুল্ক স্টেশনে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ নির্ধারিত ছিলো। কিন্তু ঈদের ছুটির পর থেকে আরো ৭ হাজার টাকা বৃদ্ধি করে ২২ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ভারতীয় গমের ভুষির বি/ই এন্ট্রি ৫ হাজার টাকা ও সাপটার ক্ষেত্রে প্রতি ১০০মে. টনের জন্য ৩০ হাজার টাকা ঘুষ নির্ধারিত হয়েছে। সিরামিক পণ্যের ক্ষেত্রে প্রতিটি বি/ই এন্ট্রি পরীক্ষণের নামে ভয়ভীতি দেখিয়ে ১০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। অর্থাৎ ভোমরা বন্দর দিয়ে যেকোনো পণ্য আমদানি-রপ্তানী করলে ঘুষ বাধ্যতামূলক। শুল্ক মুক্ত ভারতীয় মুসরীর ডাল আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ১০০মে. টনে ১ লক্ষ টাকা ঘুষ নির্ধারন করা হয়েছে।

ভারতীয় ট্রাক স্থলবন্দর থেকে বের করে আমদানিকারকদের নিজস্ব গোডাউনে আনতে হলে ৩০০ টাকার স্টাম্পে অঙ্গীকারনামা জমা দিতে হয়। সেক্ষেত্রে প্রতিটি অঙ্গীকারনামায় ডেপুটি কমিশনারের নামে ২ হাজার টাকা আদায় করা হয়। প্রতিদিন প্রায় ৪০টি স্ট্যান্ড থেকে প্রায় ৮০ হাজার টাকা ঘুষ আদায় অব্যাহত রয়েছে। এই ঘুষের টাকা আদায়ের জন্য ডেপুটি কমিশনার এনামুল হক তার বিশ্বস্ত একজন এ.আর.ও (সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা) কে দায়িত্ব দিয়েছেন। তার হাত দিয়ে এই টাকা সিএন্ডএফ এজেন্ট এর কর্মচারীদের কাছ থেকে আদায় করা হয়।

এঘটনায় কাস্টমস শুল্ক স্টেশনের ডেপুটি কমিশনার এনামুল হকের বিরুদ্ধে ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েসনের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক স্বাক্ষরিত একটি আবেদন গত বছরের শেষের দিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর প্রেরণ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গনমাধ্যামে সংবাদ প্রকাশিত হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান তদন্তের জন্য খুলনা কাস্টমস হাউজের অতিরিক্ত কমিশনারকে দায়িত্ব দেন। কিন্তু ডেপুটি কমিশনার এনামুল হক সিএন্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েসনের এক নেতাকে ম্যানেজ করে তার বিরুদ্ধে আনীত দূর্নীতির ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে সামর্থ্য হন। এরপর থেকে তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

সাতক্ষীরা চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি নাসিম ফারুক খান মিঠু জানিয়েছেন, ভোমরা কাস্টমস শুল্ক স্টেশনের ডেপুটি কমিশনারের কারণে ব্যবসায়ীরা জিম্মি হয়ে পড়েছে । টাকা ছাড়া এখানে কোন কাজ হয় না ।

ভোমরা স্থলবন্দর আমদানি ও রপ্তানি কারক এশোসিয়েশনের সভাপতি রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী জানিয়েছন, কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার এনামুল হকের বিরুদ্ধে সিএন্ড এফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন যে অভিযোগ করেছিল তার সুষ্ঠু তদন্ত হলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। সাধারণ ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু হয়রানীর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।

আমদানি ও রপ্তানি কারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনারের দুর্নীতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়েছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে ভোমরা বন্দরে অচিরেই অচল অবস্থা সৃষ্টি হবে ।

সরকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে রপ্তানী বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করে আসছে। কিন্তু ভোমরা স্থল বন্দর দিয়ে যেকোনো পন্য রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিটি বিল অব ইক্সপোর্টে ১০০০ টাকা ঘুষ বাধ্যতামূলক। গত সপ্তাহে পাটের আঁশ দিয়ে তৈরী সুতুলী রপ্তানীর ক্ষেত্রে ঘুষ ২৫০০ টাকা নির্ধারন করা হয়েছে। কেউ যদি ঘুষ দিতে অস্বীকার করে তাহলে ল্যাবোরেটরী পরীক্ষার নামে আমদানিকারকদের প্রতিনিয়তি হয়রানি করা হয়।

ব্যবসায়ীদের হয়রানি, ঘুষ বানিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে ভোমরা কাস্টমস এর ডেপুটি কমিশনার এনামুল হক সাংবাদিকদের জানান, একটি ব্যবসায়ী মহল আমার বিরুদ্ধে সড়যন্ত্র করছে। চলতি অর্থ বছরে রাজস্ব প্রবৃদ্বি হয়েছে ৪৩%। কিন্তু পন্য আমদানি কম হয়েছে ২ লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন। যদি আমি অনিয়মের সাথে জড়িত থাকতাম তাহলে ১৯৩ কোটি টাকা রেভিনিউ লিকেজ হত।

যাযাদি/ এম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে