শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ার আলুর সেকাল-একাল; কৃষকদের অজানা স্বপ্ন

ইমরান হোসাইন লিখন, বগুড়া
  ১৪ মার্চ ২০২৩, ১২:১৬

বগুড়ার দইয়ের মতো যুগযুগ ধরে আলুও ঐতিহ্য বহন করে আসছে। শুধু তাই নয় বগুড়ার অর্থকরি ফসলগুলোর মধ্যে আলু অন্যতম। জেলার বেশিরভাগ কৃষকরাই কম বেশি আলু চাষ করে থাকেন। কারন নিজেদের চাহিদা পুরনের পাশাপাশি মোটা অংকের অর্থের যোগান দেয় আলু। এক সময় আঞ্চলিক ভাষায় বিলাতি নামের আলুই এই অঞ্চলে চাষ হচ্ছিল এর পর পাকরি, লাল পাকরি, হলান্ডার, এষ্টারিক্স, কার্ডিনাল, ডায়মন্ট, গ্রানুলার, রোমানা ও ক্যারেজসহ পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জাতের আলুর সমারোহ এখন বগুড়ায়।

তবে আলুতে আশানুরুপ মূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা সরিষাসহ অন্যান্য ফসলের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন। আলু চাষ একটি ব্যায়বহুল চাষ, চরা দামে বীজ ও সার কিনে জমিতে লাগানো পর থেকে আলু উঠানোর পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত এক ধরনের চিন্তা বহন করতে হয় কৃষকদের। কারন শীত কালীন এই ফসলের সবথেকে বড় শত্রু হলো কুয়াশা। বিগত দিনে কুয়াশার কারনে হাজার হাজার হেক্টর আলুর গাছ একেবারেই নষ্ট হয়ে যাওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে। এছাড়া পোকা-মাকড়ের কবল থেকে রক্ষা করতে নানা ধরনের কিটনাশক ব্যবহারের পরেও শেষ রক্ষা হয়নি বিভিন্ন সময়। আবার শেষ পর্যায়ে আলু সংগ্রহের সময়ে বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে যায়। এসব নানা সমস্যার মুখোমুখি সময় অতিক্রম করে ঘরে তুলতে হয় এই ফসল। এর পরেও যদি আশানুরুপ দাম না পাওয়ায় কৃষকরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। গত বছরের চেয়ে এবার আলুর আবাদ কম হয়েছে আবার ফলনও হয়েছে কম। তাই আগামিতে আলু চাষে জমির পরিমান আরো কমবে বলে ধারনা কৃষকদের। কৃষকরা বলছেন এক বিঘা জমিতে আলু লাগানো থেকে শুরু করে উত্তলন পর্যন্ত খরচ হয় ৩০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আর বিক্রয় হয় ৩৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এর পরেও নানা ধরনের ভয় নিয়ে কৃষকদের এই ফসল ফলাতে হয়। কিন্তু এক বিঘা জমিতে সরিষা করতে খরচ হয় মাত্র ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা। সরিষার ফসলে তেমন কোন বিপর্যয় নেই। তাই অশঙ্কামুক্তভাবে এই ফসলে এক বিঘা জমিতে সরিষা হয় ৭ থেকে ১৪ মন পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকার সরিষা বিক্রয় হয়ে থাকে। তাই আলুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে অন্যান্য ফসলের প্রতি ঝুকছেন বগুড়া কৃষকরা।

জেলায় এবার আলুর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৫,৬৯০ হেক্টর জমিতে ১২,২৫,১৮০ মেট্রিকটন কিন্তু চাষ হয়েছে ৫৩,২১৫ হেক্টর জমিতে ১১,৯৯,৯৯১ মেট্রিকটন অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনা এবার জমির পরিমান কমেছে ২৪৭৫ হেক্টর ও ফলন কমেছে ২৫,১৪৯ মেট্রিকটন।

আলু চাষিরা প্রতিবছর অক্টোবর মাস থেকেই প্রস্ততি গ্রহন করেন। এসময়ে কোন বর্ষা-বাদল না থাকায় জমিতে একের পর এক চাষ দিয়ে মাটি ঝুড়ঝুরে করে নেয়। এর পর জৈব সার, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যাবহার করে জমি তৈরি করে নেয়। ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত জমি প্রস্তুত করতেই সময় কেটে যায়। এরপর নভেম্বরের প্রথম থেকেই আলু লাগাতে শুরু করেন চাষিরা। জমি পস্তুতের এই সময় হিমাগার থেকে নিজেদের রাখা আলু অথবা বাজার থেকে কেনা আলু এনে ঘরের মেঝে কিংবা গ্রামের ধানের মাচালের নিচে রেখে তার উপর কলাপাতা ও চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখে। প্রায় ৭-১২ দিনের মধ্যেই এসব আলু থেকে সাদা রঙ্গের অঙ্কুর বের হলে কৃষরা বুঝে নেয় আলু লাগানোর উপযোগি হয়েছে। তখন এসব আলু এলাকা ভেদে ছোট ও বড় মাপের বিভিন্নভাবে কেটে নেয় কৃষানীরা। আলু কাটা শুরু হয় সূর্য ওঠার আগে থেকেই। আলুগুলো কেটে ছোট ছোট পাতিল অথবা বাশের তৈরি ঝাকাতে রেখে পরিবারের ছেলে-মেয়ে, কৃষক-কৃষানী ও কাজের লোক নিয়ে মাঠে চলে যায় কৃষকেরা। জমিতে পৌছে বাঁশ অথবা কলাগাছের একটি খন্ডে ১৮-২২ ইঞ্চি দুরত্বে দু-পাশে দের ফিট ফলা আকৃতির লম্বা দুটি বাশের কাঠি লাগিয়ে নেয়। এর পর এই যন্ত্র দিয়ে লম্বা অথবা বক্স আকৃতির দাগ কাটতে শুরু করে। দাগ কাটার এই প্রান্ত থেকে একদিকে ৩ ইঞ্চি পর পর আলু রাখতে শুরু করা হয় অন্যদিকে কোদাল দিয়ে বিশেষ কায়দায় মাটি তুলে আলুগুলো ঢেকে দেয়া হয়। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আলু লাগানো শেষে বাড়ি ফেরে তারা। ১৫ থেকে প্রায় ২৫ দিন পর্যন্ত চলে আলু লাগানোর কর্মজজ্ঞ।

এর পর ১০ দিন পর্যন্ত কৃষদের তেমন কোন কাজ নেই জমিতে। তবে কৃষকরা প্রতিদিন মাঠে আলুর জমি পরিদর্শন করতে ভুল করেনা। ১২-১৫ দিনের মধ্যেই মাটি ফেটে সবুজ রঙ্গের ছোট ছোট চাড়া গজাতে শুরু করে। এসময় জমিতে আগাছা দেখা দিলে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে অথবা দু-পাশের চারার মাঝে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে অথবা নিরানি দিয়ে আগাছা পরিস্কার করে দেয়া হয়। এসময় শীতের কুয়াশার বিপর্যয় ও বিভিন্ন পোকা মাকড় থেকে রক্ষা পেতে নানা ধরনের কিটনাশক ছিটাতে হয়। ৩০ থেকে ৪০ দিন বয়স হলে বেলা ১০টার দিকে ইউরিয়া ছিটিয়ে দেয়া হয়। এর ছোট-ছোট কোদাল দিয়ে মাঝের মাটি তুলে দু-পাশের চাড়ার গোড়া বেধেঁ দেয়া হয়। তারপর এক সপ্তাহ পরে পরিমান মতো পানি দেয়া হয়। এবাবে ৫০ থেকে ৬০ দিন বয়সে আবারো পরিমান মতো পানি দেয়া হয় আলুর জমিতে। তবে সময় মতো ঔষধ ছিটানো ও কিটনাশক ছিটানো চালিয়ে যেতে হয়। ৮০ দিন বয়স হলে আলুর গাছের সবুজ রং পরিবর্তন হতে শুরু করে। এসব গাছ হলুদ রঙ্গের এক পর্যায়ে পাতা ঝরে পরে গাছ শুকিয়ে যায়। তখন কৃষকরা জমি থেকে আলু সংগ্রহ করতে শুরু করে।

জমি থেকে আলু তুলতেও মাঠে যায় কৃষক-কৃষানী, ছেলে-মেয়ে ও শ্রমীকরা আলু তোলার কাজও শুরু হয় ভোড় থেকেই। কারন সকালের ঠান্ডা আবহাওয়ায় কাজের পরিমানটা একটু বেশিই হয়। আবার স্বাচ্ছন্দে কাজও করা যায়।

আলু সংগ্রহের সময় এসব মাঠে গেলেই দেখা মিলবে শত-শত নারী পুরুষের। এই অঞ্চলের শ্রমিকরা ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত দিন হাজিরায় কাজ করে থাকে। সাধারণত নারীরা ৩০০-৪০০ ও পুরুষরা ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমমিকে কাজ করে। তবে শ্রমীকরা বিকেলে যাবার সময় তাদেরকে ৫-৮ কেজি পর্যন্ত আলু হাতে ধরে দেয় মালিকরা। এসব শ্রমীকদের জন্য দুপুরে থাকে খাবারের ব্যবস্থা, সাদা ভাত ও সাথে রয়েছে মাছ অথবা মাংস দিয়ে রান্না করা আলু ঘাটি।

রাস্তা দিয়ে যাবার সময় ফসলের মাঠের পাশে দেখা মিলবে বিশাল বিশাল আলুর স্তুপ। মাঠ থেকে ঘোড়ার গাড়ি, ভ্যান, কিংবা বস্তা ও খাচিতে তুলে কাধেঁ করে আলু এনে রাস্তার পাশে স্তুপ আকারে জমা করতে থাকে কৃষকরা। আবার কিছু কিছু এলাকায় রয়েছে মোকাম, এখানে বিভিন্ন জেলা ও এলাকার ব্যাপরিরা আলু কিনে জমা করে ট্রাক যোগে দেশের বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করে থাকে। আবার কিছু কৃষক এসব আলু রেখে দেয় হিমাগারে। সেখানে থেকে ডাল সিজেনে অথবা আলু লাগানো সময় বিক্রয় করে থাকে।

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের দেয়া তথ্যানুযায়ী এবার আলুর ফলন ভালো হয়েছে। এবার ৫৫৬৯০ হেক্টর জমিতে ১২২৫১৮০ মেট্রিকটন আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে ৫৩২১৫ হেক্টর জমিতে ১১,৯৯,৯৯১ মেট্রিকটন। কৃষি বিভাগ সূত্র বলছে, এর বাইরে আরও প্রায় ৭শত হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। সব মিলিয়ে বগুড়ায় আলুর আবাদ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে। আর ফলন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ মেট্রিক টন। প্রথমের দিকে আগাম জাতের আলু তোলা হলেও বর্তমানে উপশি চাতের আলু তোলা হচ্ছে।

চলতি মাসেই আলু উত্তলোনের কাজ শেষ হবে। কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্যানুযায়ী গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলুর আবাদ হয়েছিল ২০১৫ সালে। ওই সময় প্রায় সাড়ে ৬১ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছিল। সূত্র বলছে, গত বছর আলু দাম বেশি থাকায় এবার কৃষকরা আলুর আবাদে কোনো জমি ফেলে রাখেনি। এছাড়া অনুকূল আবহাওয়া থাকায় আবাদও ভালো হয়েছে। অন্যদিকে কৃষকরা এখন বেশি ফলনের জন্য উচ্চ ফলনশীল জাতের আলু আবাদেরর দিকে ঝুঁকছেন। উচ্চ ফলনশীল বা উফশি জাতের আলুর মধ্যে রয়েছে- এস্টারিক্স, ডায়মন্ড, গস্নানোলা, কার্ডিনালসহ বিভিন্ন জাত। কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দুই বছরে জেলায় মোট আবাদের মধ্যে ১৪ থেকে ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের পাকড়ি ও হাগড়াই জাতের আলুর চাষ হতো। সেখানে এবার স্থানীয় জাতের আলুর আবাদ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে।

বগুড়ার ১২টি উপজেলার সবথেকে বেশি আলু চাষ হয় শিবগঞ্জে এই উপজেলায় এবার ১৮ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে আলু লাগানো হয়েছিল। এছাড়া শেরপুর, গাবতলী, সোনাতলা, নন্দীগ্রাম, কাহালু, সদর ও সাজাহানপুর উপজেলায় উল্ল্যেখযোগ্য আলু চাষ হয়ে থাকে।

এসব এলাকায় উল্লেখযোগ্য হারে চাষ হয়েছে এষ্টারিস্ক। এছাড়া কার্ডিনাল, ডায়মন্ট, গ্রানুলার, রোমানা, পাকড়ি, ক্যারেজ, মিউজিকাসহ নানা জাতের আলু চাষ হয়েছে। তবে এবার সবথেকে বেশি লাগানো হয়েছে এষ্টারিস্ক। কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এষ্টারিক লাগানো হয়েছে ১৪,৬৫০ হেক্টর, ডায়মন্ড ৭,৭৬৫ হেক্টর, কার্ডিনাল ৭,৫৫০ হেক্টর গ্র্যানুলার ৬২৫০ হেক্টর, রোমানা ৩,৮৫০ হেক্টর, পাকড়ি ৭৫০ হেক্টর, ক্যারেজ ৭৯২ হেক্টর, মিউজিকা ১১৩৫ হেক্টর। এছাড়া অন্যান্য জাত লাগানো হয়েছে ১০,৪৭৩ হেক্টর জমিতে।

উপজেলা গুলোর মধ্যে শিবগঞ্জে চাষ হয়েছে ১৮,৪০০ হেক্টর, শেরপুরে ২৬৮০, সদরে ৬৭০০, শাজাহানপুরে ৫,৫০০, গাবতলীতে ১৩৫০, সারিয়াকান্দিতে ৮৬৫, কাহালুতে ৬,৫০০ দুপচাঁচিয়ায় ৪১৫০, আদমগিঘীতে ৩,৪০০ নন্দীগ্রামে ৭,২৪৫ ধুনুটে ৩৫০ হেক্টর ও আদম দিঘীতে ৩,৪০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে।

নন্দীগ্রাম উপজেলার কৃষক ছমেদআলী বলেন এবার আলু করেছি ৭ বিঘা প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা কিন্তু এক বিঘাতে আলু হয়েছে ১০০ থেকে ১২০ মন যার বাজার মূল্য ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। একই ধরনের কথা বলেন ঐ এলাকার গফুর ও ছাত্তার। এছাড়া সোনাতলা উপজেলার নিত্যানন্দনপুর গ্রামের মোঃ জহুরুল ইসলাম, জাহিদুল ইসলামসহ বিভিন্ন কৃষকরা বলেন অন্যান্য ফসলের চেয়ে আলু চাষ একটি ব্যায়বহুল ও আশঙ্কাযুক্ত।

কৃষি বিভাগ সূত্র বলছে শতাংশের হিসাবে এবার মোট আলু আবাদের মধ্যে ১৬ শতাংশ জমিতে স্থানীয় জাতের আলু এবং ৮৪ শতাংশ জমিতে উফশি জাতের আলুর আবাদ হয়েছে। বেশি লাভ ও বেশি উৎপাদনের জন্যই কৃষকরা উফশি জাতের আলু আবাদের দিকে ঝুঁকছেন। কৃষি বিভাগ বগুড়া সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাতলুবর রহমান বলেন আলুতে বেশি খরচ ও আশানুরুপ দাম না পাওয়ায় কৃষকরা আলু চাষে কিছুটা অনাগ্রহী হয়ে পরেছে। তবে আমরা তাদের বিভিন্নভাবে দিক নির্দেশান, পরামর্শসহ নানা ভাবে সহযোগীতা করে যাচ্ছি আগামিতে আলু চাষে কৃষকরা যেনো ভালো কিছু পায় সেদিকে আমাদের যথাষ্ট খেয়াল রয়েছে।

তিনি আরো বলেন বগুড়ার আলু এখন দেশের বাহিরেও রপ্তানি হচ্ছে। তাই এই ফসল আগামিতে কৃষকদের জন্য আরো খুশির সংবাদ বয়ে নিয়ে আসবে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে