শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নজরুল ও বায়রন মুক্তিপ্রত্যাশী এবং বিপস্নবী কবি

আবু আফজাল সালেহ
  ২০ মে ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ২০ মে ২০২২, ১০:২০

বায়রন (১৭৮৮-১৮২৪) এবং নজরুল (১৮৯৯-১৯৭৬) ভিন্ন শতাব্দীর কবি; ভিন্ন ভাষার কবি। কিন্তু উভয়েরই প্রথম পরিচয় বিদ্রোহী কবি, বিপস্নবী কবি। উভয়েই আবার রোমান্টিক কবি, প্রেমের কবি। তাদের লেখায় প্রচুর রোমান্টিক উপাদান বর্তমান। বায়রনের প্রেমের কবিতার মধ্যে রয়েছে 'ঝড় ডব ঝযধষষ এড় হড় গড়ৎব ভড়ৎ জড়ারহম', 'ঝঃধহুধং ভড়ৎ গঁংরপ', 'ঝযব ডধষশং রহ ইবধঁঃু' ইত্যাদি বিখ্যাত। এই সব কবিতায় তার ভালোবাসার মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। একইভাবে নজরুলের দোলনদচাঁপা, সিন্ধু-হিন্দোল, শিউলিমালা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা প্রেমের প্রতিপাদ্যে পরিপূর্ণ। নজরুল মানবতাবাদী কবি এবং সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাই তো পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তির জন্য কলম ধরেছেন, অস্ত্র ধরেছেন। বড় দুটি ধর্মীয় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সাহস জুগিয়েছেন। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক অনুপ্রেরণা- ' মাভৈঃ মাভৈঃ এতদিনে বুঝি জাগিল ভারত প্রাণ, সজীব হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান গোরস্থান। ...খালেদ আবার ধরিয়াছে অসি, অর্জ্জুন ছোড়ে বাণ। জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান।' (হিন্দু-মুসলমান যুদ্ধ/ ফণি-মনসা) নজরুল যে নতুন ধরনের কবিতা লিখেছিলেন তা তিরিশের আগে বাংলা কবিতায় রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত আধুনিকতার আবির্ভাব করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার কবিতা, গান, উপন্যাস, ছোটগল্প, কিংবা নাটকে দাসপ্রথা, সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। নজরুলের দূপ্ত ও সাহসী উচ্চারণ- 'হিন্দু না ওরা মুসলিম?' ওই জিজ্ঞাসে কোন জন কান্ডারি। বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।' (কান্ডারি হুঁশিয়ার/ সর্বহারা) 'আমি চির উন্নত শির', 'মম ললাটে রুদ্র ভগমান জ্বলে', 'আমরা শক্তি আমরা বল/ আমরা ছাত্র দল', 'লাথি মেরে সব ভাঙরে তালা, যত সব বন্দিশালা, আগুন জ্বালা' ইত্যাদির আমি অন্যরকম মাত্রা দিয়েছে, বিপস্নবী যোজনা সৃষ্টি করেছে। প্রতিবাদী কাফেলায় নেতৃত্ব দিতে চেয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। কখন থামবেন তিনি? যখন 'অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না', তখন থামবে কবির বিদ্রোহ, বিপস্নবী মনোভাব। নজরুল শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক- উভয় দিকেই যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে যান। ব্রিটিশরা যুদ্ধে জয়লাভ করলে তাকে চলে আসতে হয়। ১৯২০ সালে নজরুল সালে করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। একই বছর তিনি সাংবাদিক হিসেবে নবযুগে যোগ দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বকে টালমাটাল করেছিল। যার ফল ভারতেও ছাপ ফেলেছিল। যুদ্ধের দুঃখ-বেদনা বিদ্রোহী কবি নজরুলের মানসিকতাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। তিনি এটাকে ভারতীয়দের জন্য তাদের মাতৃভূমি, ব্রিটিশ উপনিবেশের ভারত মুক্তির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেন; বিশেষত সাহিত্য ও পত্রিকায়। নজরুল পশ্চিমা লর্ড বায়রন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারেন। বায়রনের রাজনীতি, নৈতিকতা এবং কবিতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তিনি বিদ্রোহী হিসাবে অনেক বেশি কার্যকর। গ্রিক স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য তিনি মিসোলংঘিতে মারা যান। 'বিরোধিতার জন্য জন্ম (ইড়ৎহ ভড়ৎ ড়ঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ)' মূলমন্ত্র ছিল বায়রনের। বায়রনের জীবন অস্থির ও টালমাটাল ছিল এবং তিনি একটি নির্দিষ্ট ধরনের রোমান্টিক লেখকের চিত্র হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে নজরুল নিপীড়িত ও বঞ্চিত শ্রেণির মানুষের কবি। শ্রেণিবৈষম্যের শিকার মানুষই হয়ে ওঠে তার কবিতার বিষয়বস্তু। জীবিকার জন্য শ্রমজীবী মানুষ নজরুলের কবিতায় স্থান পেয়েছে। তিনি তার কবিতায় গণমানুষের ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করেছেন। 'স্বাধীনতা' শব্দটা তার কাছে একটু অন্যরকম ছিল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রতি নিবেদিত ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামীদের অশান্তির কারণ। নজরুল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ঘৃণা করতেন। রোমান্টিক কবি বায়রনের মতো নজরুলও কুসংস্কারমুক্ত সমাজ বা ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বায়রন স্বপ্ন দেখতেন গ্রিস স্বাধীন হবে। তেমনই নজরুল আশা করতেন ভারতবর্ষ বৈষম্যমুক্ত ও পরিপূর্ণ স্বাধীন হবে। বায়নের উচ্চারণ- 'ঞযব সড়ঁহঃধরহং ষড়ড়শ ড়হ গধৎধঃযড়হ্ত অহফ গধৎধঃযড়হ ষড়ড়শং ড়হ :যব ংবধ; অহফ সঁংরহম :যবৎব ধহ যড়ঁৎ ধষড়হব, ও ফৎবধস'ফ :যধঃ এৎববপব সরমযঃ ংঃরষষ নব ভৎবব;' ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার সক্রিয়-অংশগ্রহণ তাকে একাধিকবার কারাবরণ করতে বাধ্য করে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও অবিভক্ত বাংলার সংগ্রামে নজরুল সবসময় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি ছিলেন একজন গণমুখী সাহিত্যিক; ধর্মান্ধতা, অন্যায়-অবিচার, চরমপন্থা, শোষণ-তোষণ, নিপীড়ন ও সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে সর্বদা প্রতিবাদী। তার একটি অদম্য মানবিক-চেতনা ছিল। তিনি প্রেম, সৃজনশীলতা, মানবতা এবং রোমান্টিকতায় পরিপূর্ণ ছিলেন। একজন বিপস্নবী কবি হিসেবে নজরুলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছিলেন, 'সত্যিই সে (নজরুল) একজন বিদ্রোহী, তার লেখার প্রভাব ছিল অপরিসীম। কারাগারে আমরা তার গান আমাদের ঠোঁটে বহন করব। যখন আমরা যুদ্ধে নামব, আমরা তার গান গাইব।' একজন সংস্কারক, সাহসী, আপসহীন সাংবাদিক হিসেবে নজরুলের ভূমিকা উলেস্নখযোগ্য ছিল। লাঙ্গল, ধূমকেতু, সেবক এবং নবযুগের সম্পাদক হিসেবে তিনি জ্বলন্ত সম্পাদকীয় ও মন্তব্য লিখেছেন এবং জনগণকে পরাধীন ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে আহ্বান জানিয়েছেন। বায়রন নজরুলের চেয়ে বেশি ব্যঙ্গাত্মক। নজরুলের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ মৃদু ও কোথাও কোমল। বায়রনের বিধ্বংসী ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ দেখা যায় তার ঞযব ঠরংরড়হ ড়ভ ঔঁফমসবহঃ, ঊহমষরংয ইধৎফং ধহফ ঝপড়ঃপয জবারববিৎং ব্যঙ্গকাব্যগ্রন্থে। নজরুলের বিপস্নবী বা বিদ্রোহী উচ্চারণ করেছেন অগ্নিবীণা, সাম্যবাদী প্রভৃতি কাব্যে। 'ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর'-এর মতো শেকল ভাঙার গান গেয়েছেন। 'প্রলয়োলস্নাস' কবিতায় ভাঙা-গড়ার খেলা দেখিয়েছেন। আবার 'রক্তাম্বর-ধারিণী মা' কবিতায় বলেন, 'রক্তাম্বরধারিণী মা,/ ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর/সৃষ্টি নব পূর্ণিমা।' সাম্যবাদীর মূলসূত্র ছিল এমন 'নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই' অথবা 'পীড়িতের নাই জাতি ও ধর্ম, অধীন ভারতময়, তারা পরাধীন, তারা নিপীড়িত, এই এক পরিচয়'। তার অসাম্প্রদায়িকতার মূল সুর বা চেতনা হচ্ছে 'মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান'। নজরুল তার চারটি সন্তানের নাম রেখেছিলেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য ও পুরাণের আলোকে। তার সন্তানদের নাম যথাক্রমে কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। শোষণ-পীড়িতের অবসান চেয়েছেন। 'একতাই বল' হিসাবে অগ্রসর হতে বলেছেন। ধর্মকে কেন্দ্র করে কোনো বিভাজন চাননি তিনি। বিভাজন থাকলে স্বাধীনতা বা অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়। কৃষকের চোখে নজরুল বলেছেন, 'আজ জাগরে কৃষাণ সব তো গেছে, কিসের বা আর ভয়,/ এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয় (কৃষাণের গান)'। প্রথম স্ত্রী নার্গিসের কাছ থেকে বিচ্ছেদের আবেগ: 'যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,/ অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে (অভিশাপ)' যেন বায়রনের- 'ওহ ঝরষবহপব ধহফ :বধৎং/ ঐধষভ নৎড়শবহ যবধৎঃবফ,/ ঞড় ংবাবৎব ভড়ৎ ুবধৎং' (ডযবহ ডব ঞড়ি চধৎঃবফ/খড়ৎফ ইুৎড়হ) নজরুল লিখেছেন নিম্নবিত্তের মানুষ এবং ধনীদের হাতে তাদের কষ্টের কথা, বায়রন লিখেছেন সমাজের উচ্চবিত্তের কথা। তারা অত্যাচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। বায়রন সমাজের সাথে যুদ্ধরত ব্যক্তি সম্পর্কে নতুন বোধ সৃষ্টি করেছিলেন। কখনো কখনো বায়রন রাগান্বিত এবং ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে লিখতেন। নজরুলের ভাষায় ঝাঁজ ছিল; তবে ভঙ্গি বায়রনের মতো অত নগ্ন ছিল না কিন্তু প্রচন্ড ঝাঁজালো। নজরুলের কালবৈশাখী, টর্পেডো, সাইক্লোন, অর্ফিয়াসের বাঁশি, কিন্তু কম জোরালো নয়। প্রকৃতিকে বেশি ভালোবাসতেন বায়রন। 'মানুষ' ছিল নজরুলের মূল উপজীব্য। বায়রন নিজেকে প্রকৃতির বন্য এবং উত্তাল দিকগুলোর সাথে চিহ্নিত করেছিলেন। 'ঈযরষফব ঐবৎড়ষফ'ং চরষমৎরসধমব' 'ঞযবৎব রং ধ ঢ়ষবধংঁৎব রহ :যব ঢ়ধঃযষবংং ড়িড়ফং, ঞযবৎব রং ধ ৎধঢ়ঃঁৎব ড়হ :যব ষড়হবষু ংযড়ৎব, ঞযবৎব রং ংড়পরবঃু যিবৎব হড়হব রহঃৎঁফবং, ইু :যব ফববঢ় ঝবধ, ধহফ সঁংরপ রহ রঃং ৎড়ধৎ: ও ষড়াব হড়ঃ গধহ :যব ষবংং, নঁঃ ঘধঃঁৎব সড়ৎব' বায়রন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিপস্নবী ছিলেন। যদিও তার বিপস্নবী প্রকৃতির জন্য, নজরুলের হৃদয়ের বিপস্নবীর চেয়ে বেশি রোমান্টিক। উভয় কবিই বিভিন্ন শতাব্দীর হলেও তাদের কবিতায় আধুনিকতা রয়েছে। বায়রন ও নজরুলের ছিলেন স্বাধীনতা ও স্বাধীনের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও অকুণ্ঠ সমর্থন। বায়রন যখন গ্রিকদের তুর্কিদের কাছ থেকে তাদের স্বাধীনতার জন্য সাহায্য করার জন্য একটি অভিযানের আয়োজন করেন তখন সাহিত্য বন্ধ করে দেন। তার নিজের লেখা গ্রিক কারণের জন্য ইউরোপীয় উৎসাহ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। এই দিনে বায়রনকে গ্রিক জনগণ জাতীয় বীর হিসেবে সম্মান করে। বায়রন তার ংড়হহবঃ ড়হ ঈযরষষড়হ-এ স্বাধীনতা সম্পর্কে বলেছেন : 'ঊঃবৎহধষ ংঢ়রৎরঃ ড়ভ :যব পযধরহষবংং সরহফ! ইৎরমযঃবংঃ রহ ফঁহমবড়হং, খরনবৎঃু! :যড়ঁ ধৎঃ,' ডবিস্নউসিসির (এৎধপব ঈড়সসঁহরঃু ঈযঁৎপয) শিক্ষক ও যাজক রেভারেন্ড ম্যাকআর্থার (জবা গধপঅৎঃযঁৎ) নজরুলের মধ্যে সার্বজনীনতা দেখতে পেয়ে প্রভূত প্রশংসা করেন। নজরুলের সাহসিকতা ও দৃঢ় অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাকে মুগ্ধ করে। নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তার সর্বজনীনতা এবং মানবতার সাথে তার বন্ধন আমাদের জাতীয় মানসিকতা, নীতি ও সংস্কৃতিতে এখনো প্রতিফলিত হয়নি। আগামী দিনে তার বীরত্ব ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাস্তবায়ন হোক, এ আশা করি। কবির গ্রহণযোগ্যতা বাংলাদেশসহ বিশ্বময় সর্বজনীনতা পাক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে