শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্কুল-কলেজ খুলছে : আমরা কতটা সচেতন?

মনে রাখতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেমন আনন্দের তেমনি কারও অসচেতনতার কারণে কোনো শিক্ষার্থী যাতে বিপদগ্রস্ত না হয় সেদিকেও বিশেষ নজর রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের যেমন ভূমিকা রয়েছে, একইভাবে ভূমিকা রয়েছে শিক্ষকদেরও। সম্মিলিত সচেতনতা ও সতর্কতাই কেবল পারে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে এবং করোনাকালীন উদ্বেগ কমাতে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের দিকেও নজর দেওয়া জরুরি।
সালাম সালেহ উদদীন
  ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:০৩

করোনাকালে দেশের শিক্ষা পরিস্থিতি সুখকর নয়। করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে দেশে শিক্ষা সংকট চলছে। ফলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় দারুণভাবে ব্যাঘাত ঘটেছে। অনেক শিক্ষার্থী নানামুখী মানসিক সমস্যায় ভুগছে। অনেকেই আবার ভিডিও গেমসে আসক্ত হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্যসংকট। আশার কথা- ১২ সেপ্টেম্বর থেকে স্কুল-কলেজে সশরীরে ক্লাস শুরুর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে শুরুতে সব শ্রেণির ক্লাস প্রতিদিন হবে না। শুধু পঞ্চম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস প্রতিদিন হবে। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি এবং ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে সপ্তাহে একদিন করে ক্লাস হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ মাস্ক ছাড়া ঢুকতে পারবে না। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, অভিভাবকদের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে, তারা তাদের সন্তানদের মাস্ক দিয়ে দেবেন, যেন শিক্ষার্থীরা বাসা থেকেই মাস্ক পরে স্কুলে আসে। তারা বাসায় ফিরে যাওয়া পর্যন্ত যেন মাস্ক পরে থাকে। তিনি বলেন, খুব ছোট বা কম বয়সি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে শিক্ষকরা খেয়াল রাখবেন, যাতে কারও অসুবিধা হয় কিনা। মাস্কের কারণে কোনো শিক্ষার্থীর অসুবিধা হয় কিনা। সেই বিষয়গুলো শিক্ষকরা অবশ্যই দেখবেন। স্কুলে আপাতত কোনো অ্যাসেম্বলি হবে না। স্কুলে প্রবেশের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করাতে হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কারণ দীর্ঘ সময় বাসায় থেকে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। উলেস্নখ্য, করোনা মহামারির কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২৫ মার্চ থেকে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পর শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই নিজ বাড়িতে চলে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মনে করেছিল অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আবার হলগুলো খুলে দেওয়া হবে। তারা আবার স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ফিরে আসবে। এই আশায় অনেকে জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও হলে রেখে যায়। দেশে করোনা সংক্রমণ তীব্র হলে এবং মৃতু্যহার বাড়তে থাকলে দফায় দফায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে পড়ে। সময়মতো পরীক্ষা না হওয়ায় একদিকে সেশনজট, অন্যদিকে আর্থিক চাপেও পড়ে যায় বহু শিক্ষার্থী। এটা সত্য, টিউশনি, খন্ডকালীন চাকরিসহ নানা কাজ করে অনেকে পড়াশোনার ব্যয়ভার নির্বাহ করত। আবার কেউ কেউ নিজ পরিবারকেও আর্থিক সহায়তা প্রদান করত। এই শিক্ষার্থীদের বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে এসে মেস ভাড়া করে থাকতে শুরু করে। এতে তারা বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক নানা জটিলতাও বাড়তে থাকে। ফলে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আবাসিক হল খোলার দাবিতে রোববার রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। তারপরেও এর কোনো সুষ্ঠু সমাধান হয়নি। স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার পর এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে নজর দিতে হবে। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মতি রয়েছে। তার আগে টিকা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। দেশের করোনার সংক্রমণ ও মৃতু্যহার অনেক কমেছে, টিকাদান চলছে। তাই শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি কড়াভাবে মেনে চলার শর্ত দিয়ে যত দ্রম্নত সম্ভব হল খুলে দেওয়া হোক। দেশের উচ্চ শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য এর অন্য বিকল্প নেই। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের প্রায় ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন ও সমমান স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। প্রাথমিক শিক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর যে সাফল্য তার প্রায় অর্ধেক অবদান কিন্ডারগার্টেনগুলোর। করোনা মহামারির কারণে অনেক কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। করোনাকালে সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেলেও কিন্ডারগার্টেনের প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী বেতন ও অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত। পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সক্ষমতা বিবেচনা করে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, যাতে শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে না পড়ে। যে করেই হোক দেশের শিক্ষা সংকট দূর করতে হবে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধের ক্ষেত্রে নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা। কারণ করোনাকালে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। অবশ্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা একমুখি নয়। ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি ভার্সন, ইবতেদায়ী, মাদ্রাসা শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা। এর ফলে শিক্ষার সুষ্ঠু বিকাশ হচ্ছে না। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়। টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কাজটি চলছে ধীরগতিতে। এখন আবার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা আইন করার কাজ আরও দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়েছে। বিদায়ী সরকারের আমলে তৈরি শিক্ষা আইনের খসড়াটি আবার পর্যালোচনার জন্য সাবেক সচিব হাবিউল আওয়ালকে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ খসড়ায় কোচিং, প্রাইভেট ও সব ধরনের নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বই নিষিদ্ধ করা হয়। এজন্য কোচিং, গাইড ও প্রাইভেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একটি গোষ্ঠী আইনটি ঠেকাতে তৎপরতা শুরু করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্তমান নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ সব ধরনের কোচিং-প্রাইভেট বন্ধের বিপক্ষে। এ বিষয়ে একমুখী সিদ্ধান্ত নেওয়াই শ্রেয়। জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি) এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্ধিত জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে অভিহিত করেছিল। সংস্থাটির মতে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১২ কোটি ৯৮ লাখে পৌঁছাবে- যা হবে জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ। কিন্তু জনমিতির এই সুফল কাজে লাগাতে হলে প্রত্যেক নাগরিককে যেমন দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, তেমনি তাদের উপযুক্ত কাজের সংস্থানও করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত ও মান শক্ত না করেই একের পর এক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে- যা সনদ বিতরণ করলেও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আর এ কারণে বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেকার থাকা সত্ত্বেও অনেক খাতে উচ্চ বেতন দিয়ে বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তাদের যুক্তি, দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে না। ফলে এ অবস্থার অবসানের দিকেই সংশ্লিষ্টদের জোর দিতে হবে। বিআইডিএসের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানত শিক্ষার নিম্নমানই এর জন্য দায়ী। তারা বলছেন, উচ্চ শিক্ষার মান তলানিতে পৌঁছেছে। মানহীনতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের অভাব, দক্ষ জনবলের ঘাটতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত শিক্ষা দিতে না পারা ও শিক্ষায় কম বিনিয়োগ ইত্যাদির কারণ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বেকারত্ব কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের চিত্র অনেকটাই বিপরীত। এ দেশে শিক্ষিতের বেকার হওয়ার আশঙ্কা অশিক্ষিতদের তুলনায় বেশি। বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে, এটি আনন্দের খবর। কিন্তু সেই আনন্দ মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, যখন তাদের বড় একটি অংশই বেকার অবস্থায় থাকে। করোনাকালে এই বেকারত্ব আরও বেড়েছে। দেশের ভবিষ্যতের জন্য এ অবস্থা অত্যন্ত ভীতিকর। শিক্ষাপদ্ধতি এমন হওয়া জরুরি যেখানে, প্রযুক্তিগত জ্ঞান, কারিগরি দক্ষতা বা ভাষাগত যোগাযোগে পর্যাপ্ত দক্ষতা অর্জন সম্ভব হবে। মনে রাখা দরকার, দেশের মেরুদন্ড হলো শিক্ষা তথা শিক্ষিত জনশক্তি। এদের দমিয়ে রাখলে, কর্মহীন ও সুযোগবঞ্চিত রাখলে দেশের মেরুদন্ড দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই সময়োপযোগী শিক্ষা পদ্ধতির প্রসার ঘটিয়ে বেকারত্ব কমাতে সংশ্লিষ্টরা কার্যকর উদ্যোগ নেবে- এটাই প্রত্যাশা। মনে রাখতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেমন আনন্দের তেমনি কারও অসচেতনতার কারণে কোনো শিক্ষার্থী যাতে বিপদগ্রস্ত না হয় সেদিকেও বিশেষ নজর রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের যেমন ভূমিকা রয়েছে, একইভাবে ভূমিকা রয়েছে শিক্ষকদেরও। সম্মিলিত সচেতনতা ও সতর্কতাই কেবল পারে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে এবং করোনাকালীন উদ্বেগ কমাতে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের দিকেও নজর দেওয়া জরুরি। সালাম সালেহ উদদীন : কবি কথাসাহিত্যিক প্রাবন্ধিক কলাম লেখক ও সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে