শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শীতের শুরুতে খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন দেবিদ্বারের গাছিরা

দেবিদ্বার (কুমিল্লা) প্রতিনিধি
  ০৭ নভেম্বর ২০২১, ১৯:৩৩

শীত কেন্দ্র করে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম অঞ্চলের গাছিরা। গ্রামের পরিত্যক্ত জায়গা ও আঁকাবাঁকা পথের পাশে, ডোবা-পুকুর পাড়ে সারি সারি অপরিচ্ছিন্ন খেজুর গাছগুলোর পুরানো ডালপালা কেটে পরিষ্কারের কাজ সম্পন্ন করে এবং অনেক গাছের পরিচর্যা চলছে।

শীতের শুরুতেই উপজেলার কয়েকটি এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে শীতের তীব্রতা দেখা না দিলেও এরই মধ্যে অনেক গাছি খেজুর রস সংগ্রহের কাজ শুরু করে দিয়েছেন।

গ্রামীণ জীবনে শীত এ অঞ্চলের গাছিদের কাছে বিভিন্ন মাত্রায় রূপ নিয়ে আসে। নানা স্বপ্ন আর প্রত্যাশায় তাদের অনেকটা সময় কেটে যায় এই খেজুর গাছের সঙ্গে। সারাদিন এক গাছ থেকে অন্য গাছ এভাবেই তাদের দিন কেটে যায়। গাছির জীবন সংগ্রামে বহু কষ্টের মাঝে অনেক প্রাপ্তিই মিটে যায় গ্রামবাংলার এই জনপ্রিয় বৃক্ষ খেজুর রস আহরণের সঙ্গে। গাছিদের কাছে এই সময়টা হয় অনেক আনন্দের।

গাছ কাটার জন্য গাছের মাথার এক দিকের ডাল কেটে পরিষ্কার করা হয়। আর কাটা অংশের ঠিক মাঝ বরাবর নিচে দুটি ভাঁজ কাটা হয়। সে ভাঁজ থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে একটি সরু পথ বের করা হয়। এই সরু পথের নিচে বাঁশের তৈরি নালা বসানো হয়। নালা বেয়ে চুয়ে চুয়ে পাত্রে রস পড়ে। সাধারণত দুপুরে গাছে ভাঁড় বেঁধে রাখা হয়, সারারাত রস পাত্রে পড়তে থাকে।

এ সময়টাতে শালিক, দোয়েলসহ বিভিন্ন ধরনের পাখিরা গাছে ভিড় করে রস খাওয়ার জন্য। গাছ কাটার পর দুই দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রস পাটালি গুড় তৈরি হয়, আর দ্বিতীয় দিনের রসে ঝোলা গুড় তৈরি হয়। রসের জন্য খেজুর গাছ একবার কাটার পর পাঁচ-ছয় দিন পর কাটা হয়। গাছের কাটা অংশ শুকানোর জন্য এ সময় দেওয়া প্রয়োজন। খেজুর গাছ কাটা অংশ শুকানোর সুবিধার জন্যই সাধারণত পূর্ব ও পশ্চিম দিকে গাছ কাটা হয়। যাতে সূর্যের আলো সরাসরি কাটা অংশে পড়ে।

ভোরের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় গাছ থেকে রসের পাত্র নামিয়ে হিমশীতল খেজুর রস খাওয়ার স্বাদটাই মধুর। ভোর বেলায় রস খেলে শীত মনে হয় আরও বেশি জেঁকে বসে। শীত লাগে লাগুক তবুও রস খাওয়া চাই। যতই শীত লাগুক না কেন রস খেতেই হবে। তারপর রোদ পোহানো আনন্দের অনুভূতি অন্যরকম। ভোরে গ্রামের ছেলেমেয়েরা রোদ পোহানোর সঙ্গে অপেক্ষায় থাকে কখন গাছ থেকে নামানো হবে খেজুরের সুমিষ্টি রস।

উপজেলার ছোটনা গ্রামের গাছি আবুল কাশেম ও মোহনপুর গ্রামের সফিক মিয়া জানান, খেজুর গাছ থেকে প্রায় ৮-৯ বছর বয়স থেকে রস সংগ্রহ করা যায়, আর পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত গাছ থেকে রস পাওয়া যায়। তবে গাছ যতই পুরানো হয় রস দেওয়া ততই কমে যায়। পুরানো গাছ রস কম দিলেও পুরানো গাছের রস খুবই মিষ্টি ও সুস্বাদু হয়। মাঝ বয়সের গাছ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রস পাওয়া যায়। বেশি রস সংগ্রহ করায় গাছের জন্য অনেক ক্ষতিকর।

গাছিরা আরও জানান, নতুন করে তেমন কেউ গাছির কাজ করতে আগ্রহী না হওয়ায় অনেক খেজুর গাছ পরিত্যক্ত থেকে যাচ্ছে। সেজন্য সব গাছ থেকে রস বের করা সম্ভব হচ্ছে না। গাছিরা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান খেজুর গাছে। যেন মাটিতে পা ফেলার সময় নেই তাদের। শীত আসামাত্রই খেজুর গাছ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তোলার জন্য অনেক আগে থেকেই সকাল-সন্ধ্যায় যেন লেগে থাকে গাছিরা।

খেজুর গাছ বিশেষ কায়দায় কাটতে হয়। গাছিরা বিভিন্ন উপকরণের সমন্বয়ে খেজুর গাছ পরিচ্ছন্নভাবে কাটার জন্য ব্যস্ত থাকেন। তারা গাছ কাটতে ব্যবহার করেন লোহার তৈরি ধারালো দা, মোটা দড়ি, দা রাখার জন্য বাঁশ বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি থলি। যা গাছির কোমরে রশি দিয়ে বেঁধে গাছে উঠানামা করে। গাছ কাটার জন্য গাছি শরীরের ভারসাম্য রক্ষার জন্য কোমর বরাবর গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে নেয়। দড়িটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। এই দড়ির দুই মাথায় বিশেষ কায়দায় গিঁট দেওয়া থাকে। গাছে ওঠার পর অতি সহজে গিঁট দুটি জুড়ে দিতে হয়। অনেকে আবার গাছের মাথায় দাঁড়ানোর জন্য শক্ত কাঠ বা বাঁশ রশি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে দেয়। এতে গাছি নিরাপদে গাছ কাটাতে পারে।

রস নামানোর পর জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। যা পাটালি গুড় ও ঝোলা গুড় বলা হয়। এসব গুড় বিভিন্ন ভাবে খাওয়া হয়। শীতে খেজুর গাছের রস হতে যে গুড় তৈরি করা হয় তা দিয়ে দুধের পিঠা, পায়েস পুলিপিঠা তৈরি করে খাওয়া হয়। তবে খেজুরের রস দিয়ে তৈরি রসের পিঠা খুবই সুস্বাদু হয়ে থাকে। আর খেজুর গুড়ের সন্দেশের স্বাদ হয় অপূর্ব। বলতে গেলে একবার খেলে স্বাদ সারাজীবন যেন মুখে লেগে থাকে।

গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য সাধারণত মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করা হয়। খুব সকালে রস নিচে নামিয়ে এনেই জ্বালানো হয়। জ্বাল দিতে দিতে একসময় রস ঘন হয়ে গুড়ে পরিণত হয়। শীতের সময়ে গ্রামের বাজারগুলোতেও জমজমাট হয়ে ওঠে খেজুর রস এবং গুড়ের হাট। খেজুর গুড় কমবেশি বাংলাদেশের সব জায়গায় পাওয়া যায়। বর্তমানে খেজুরের রস প্রতি লিটার ৯০ টাকা থেকে ১১০ টাকা করে বিক্রি চলে। কোথাও কোথাও খেজুরের রস ও গুড় ঘটি হিসেব করে বিক্রি করা হয়।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে