শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিতে বিষাক্ত কীটনাশক ও হরমোনের ব্যবহার বাড়ছে

আলতাব হোসেন
  ০৭ মার্চ ২০২১, ০০:০০

মৌসুমি ফল, সবজি ও ফসলে ফরমালিন ব্যবহারের অভিযোগ পুরানো। এবার কৃষিতে ফরমালিনের আড়ালে হাজার কোটি টাকার কীটনাশক ও বিষাক্ত হরমোনের রমরমা বাণিজ্য চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কীটনাশক, হরমোন ও ছত্রাকের বিষ আড়াল করতেই ফরমালিন ইসু্যকে সামনে নিয়ে আসা হয়। অথচ কীটনাশক বিক্রি ও ব্যবহারে কোনো তদারকি নেই। বছরে বৈধ পথেই প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার কীটনাশক আমদানি হচ্ছে। হরমোন ও ছত্রাকনাশক বিক্রি হচ্ছে আড়াই হাজার কোটি টাকার। বালাইনাশকের নিয়ন্ত্রণের কোনো বালাই নেই। শাস্তির বিধান থাকলেও তা প্রয়োগের কোনো নজির নেই। মাঠপর্যায়ে বাড়ছে ছত্রাকনাশকের ব্যবহার। অথচ সরকারের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার বেশির ভাগ উদ্যোগ ফরমালিনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। আর আড়ালে থেকে যাচ্ছে খাদ্যে ব্যবহূত বিষাক্ত রাসায়নিকের ক্ষতিকর দিক।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণা পরিষদের (এনএফএসএল) গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছর দেশে ৬৫ হাজার ১৪২ টন কীটনাশক সবজি ও ফসলে ব্যবহার হয়েছে। এর পরিমাণ গত ১০ বছরের চারগুণ। এর বাইরে বছরে প্রায় পাচ হাজার টন কীটনাশক চোরাইপথে বাংলাদেশে আসে। কীটনাশক নির্দিষ্ট মাত্রায় ফল, সবজি ও ফসলে দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, প্রতি বছর দেশে ৩০ হাজার টনেরও বেশি কীটনাশক আমদানি করা হয়। ডিডিটি ও ক্লোরিন গ্রম্নপের কীটনাশক দেশে নিষিদ্ধ হলেও চোরাই পথে এসব আসে অবাধে এবং ব্যবহার করা হয় বিপদের কথা না জেনে, না মেনে। জনবহুল দেশের চাহিদা মেটাতে শস্য নিবিড়তা ক্রমেই বাড়ছে। এর সঙ্গে পালা দিয়ে বাড়ছে কীটনাশকের ব্যবহার। কৃষকদের প্রশিক্ষণের অপর্যাপ্ততা এবং অদক্ষতার কারণে ফসলে ব্যবহৃত কীটনাশকের বিষ মানবদেহে ঢোকে রক্তে মিশছে। কৃষি ফসল ও খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কীটনাশকের অপব্যবহার কমানো জরুরি-এজন্য প্রয়োজন আইনের শাসন, কঠোর নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু তদারকি।

বিশিষ্ট পুষ্টি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. আব্দুল বারী যায়যায়দিনকে বলেন, ফল, সবজি ও শস্য উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায়ে ক্ষতিকারক মাত্রায় কীটনাশক ও হরমোন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সরকারি অভিযানে বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেই। সবাই শুধু ফলমূলে ফরমালিন পরীক্ষা করে। ফরমালিন আছে, নেই এর আড়ালে মানুষ এক রকম বিষ খাচ্ছেন। যত্রতত্র মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে বিভিন্ন প্রকার কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। কীটনাশক বা বালাইনাশক হলো বিষাক্ত পদার্থ- যা মানুষ, পশুপাখি, কৃষি, পরিবেশ, বাতাস, পানি, মাটি, আবহাওয়াকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) করা কৃষি উপকরণ ব্যবহারে কৃষকের অভিজ্ঞতা শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের ৭৭ ভাগ কৃষক কৃষি উপকরণের (সার. বীজ, সেচ, কীটনাশক প্রভৃতি) সঠিক ব্যবহার জানেন না আর অধিকাংশ কৃষকই কীটনাশক প্রয়োগ সম্পর্কে অজ্ঞ। ওই গবেষণায় আরো বলা হয়, দেশের কৃষকরা সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত্রে ফসল সংগ্রহের মাত্র ২-৪ আগে এমনকি ফসল সংগ্রহের দিনও বালাইনাশক ও কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে ফলে ওইসব বালাইনাশকের রিসিডুয়াল ইফেক্ট মানবদেহে চলে আসে- যা মানবদেহে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে, জীবনীশক্তি হ্রাস করে, এমনকি ক্যানসারসহ নানাবিদ জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কৃষিবিদ ড. শহীদুল আলম বলেন, রাসায়নিক বালাইনাশকের

ব্যবহার দ্বারা ফসল রক্ষা এবং অতিরিক্ত উৎপাদন হলেও এর পেছনে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ায় যে স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং পরিবেশ দূষিত হয়, তাতে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই রাসায়নিক কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কৃষক সমাজ তথা সমগ্র জনগণকে অবহিত ও সচেতন করতে হবে। প্রচলিত হরমোন ও কীটনাশকের মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে ক্ষতিকর, সেগুলো চিহ্নিত করে উৎপাদন, আমদানি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। তাছাড়া কীটনাশক সংক্রান্ত আইনের সঠিক ও বাস্তব প্রয়োগের পাশাপাশি আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। তিনি আরো বলেন, রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে জৈব বালাইনাশক ও আইপিএম পদ্ধতির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বালাই দমন করা সর্বোত্তম এতে অর্থের সাশ্রয় হবে, ফসলের উৎপাদন খরচ কমবে এবং মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষিত হবে। মৌসুমি ফলে মাত্রারিক্ত কীটনাশ প্রয়োগের প্রমাণ মিলেছে গবেষণায়। নিরাপদ খাদ্য নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা দেখা গেছে, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক কীটনাশকের প্রয়োগ দিন দিন বাড়ছে। যা মানবদেহে ক্যানসারসহ নানা ধরনের রোগের জন্ম দিচ্ছে। কীটনাশক বিক্রয়কারী কোম্পনিগুলোর ডিলারদের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে এগুলো অবাধে বিক্রি হচ্ছে। গবেষণার তথ্যানুযায়ী ধান, আলু, বেগুন, বাঁধাকপি, আখ ও আমচাষিদের প্রায় ৪৭ শতাংশ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করে। মাত্র ৪ শতাংশ কৃষক বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহারের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পেলেও ৮৭ শতাংশ কৃষক কীটনাশক ছিটানোর সময় কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেন না। ফলে কৃষকের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বাড়তি ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে