অবহেলা, অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে অনেক উদ্ভিদ প্রজাতি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই উদ্ভিদকে টিকিয়ে রাখা একান্ত জরুরি। আজ থেকে ৩০ থেকে ৩৫ বছর আগে আমাদের গ্রামগঞ্জের প্রায় সব বাড়িতেই রিঠা গাছ ছিল। কিন্তু বর্তমানে পুরা এলাকা ঘুরেও একটা রিঠা গাছের সন্ধান পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এই প্রজন্মের কাছে রিঠা গাছ অজানাই রয়ে যাবে। কারণ এর ঘরোয়া ব্যবহার যেমন কমেছে তেমনি আজকাল আমাদের অবহেলার কারণে এই উদ্ভিদের দেখাই মিলে না।
আজকাল মানুষ রেডিমেট তৈরি জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয় বেশি। প্রাকৃতিক বিষয়গুলো কেন যেন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা হয়। এটা কি আধুনিকতার ছোঁয়া? যাই বলুন না কেন, প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে কখনোই আধুনিক হওয়া যায় না। আমরা উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম ধ্বংস করে কীভাবে নিজেদের আধুনিক হিসেবে দাবি করি এটা আমার বোধগম্য নয়। আজকালকার বাচ্চাদের কাছে রিঠা নিয়ে গল্প করলে অনেকেই মনে করবে সপ্তাশ্চর্যের কিছু একটা হবে। আমাদের উচিত এসব উদ্ভিদ টিকিয়ে রাখা। এদের খুঁজে বের করে বাচ্চাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া। এই প্রজন্মের কাছে উদ্ভিদের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টিকল্পে আমাদের কাজ করা একান্ত জরুরি।
রিঠার ইংরেজি নাম ঝড়ধঢ় নবৎৎু, ঝড়ধঢ় হঁঃ, ডধংযরহম হঁঃ, বৈজ্ঞানিক নাম ঝড়ঢ়রহফঁং :ৎরভড়ষরধঃঁং. ঢাকা ও ময়মনসিংহ মহাসড়কের রাজেন্দ্রপুরে কিছু রিঠা গাছের দেখা মিলতো। কিন্তু রাস্তা উন্নয়নের ফলে সেখান থেকে এই গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। এমন উপকারী গাছ যদি কাটতেই হয় তাহলে অবশ্যই একটা পরিকল্পনা থাকা উচিত। গাছটি কাটার পূর্বে পরিবেশ পরিস্থিতি যাচাই-বাছাই করে সেখানে আরো কিছু গাছ রোপণ করে তবেই কাটা উচিত। এসব উদ্ভিদের আদিনিবাস নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল। এসব উদ্ভিদ পর্নমোচি ও চিরসবুজ; এরা সাধারণত সোপবেরী হিসেবে পরিচিত। কারণ এই ফলে সাবান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এর মবহবৎরপ নামটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ঝধঢ়ড় থেকে। ইন্ডিয়া অঞ্চলের অর্থাৎ এই উপমহাদেশের নিজস্ব উদ্ভিদ। এদের পাতা সাধারণত ধষঃবৎহধঃব, ১৫-৪০ সেমি লম্বা। ফুলের গঠন লম্বা যৌগিক মঞ্জুরি (ষধৎমব ঢ়ধহরপষবং) প্রতিটি ফুল ছোট ও ক্রিমের মতো সাদা। ফল ছোট দেখতে সুপারির মতো। ফলের খোসা দেখতে চামড়ার মতো ও ড্রুপ জাতীয় ১-২ সেমি। ফল পাকলে ধূসর হলুদ বর্ণের হয়। প্রতিটি ফলে ১-৩টি বীজ থাকে।
এদের (ঝড়ধঢ়হঃঁং) ড্রুপ জাতীয় ফলে ংধঢ়ড়হরহং থাকে- যাহা প্রাকৃতিক সাবান। এশিয়া ও আমেরিকা মহাদেশের লোকজন এই ফল হাজার বছর যাবত ব্যবহার করে আসছে প্রাকৃতিক সাবান হিসেবে, কাপড় ধৌতকরণে ও শ্যাম্পু হিসেবে। বিশেষ করে শীতের শেষে পশমি কাপড় এই প্রাকৃতিক সাবান দিয়ে ধুয়ে রাখা হতো। এই সাবান দিয়ে ধুইলে কাপড়ে পোকার আক্রমণ হতো না। যেহেতু পুনরায় শীত আসা না পর্যন্ত এই কাপড়গুলো আলমারি কিংবা সিন্দুকে ঢুকিয়ে রাখা হতো।
বর্তমানে রিঠা উদ্ভিদ আর দেখা যায় না। তাই সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে এই উদ্ভিদ ধ্বংসের কারণে খাদ্য শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটেছে বলে এটা পরিষ্কার প্রতীয়মান হয়। উদ্ভিদ ধ্বংসের ফলে খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙে যাওয়ার কারণে আমরা অনেক বিপদের দিকে ধীরে ধীরে ধাবিত হচ্ছি। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে একদিন বিভিন্ন রকম অসুখে ও জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে মানবজাতি বিপদের সম্মুখীন হবে- তা নিশ্চিত।
আগেকার দিনে উলেন কাপড়, পশমি কাপড় ও সিল্কের কাপড় ধৌত করার একমাত্র সাবান ছিল রিঠা বা সোপ বেরি। বাজারের মনোহারী দোকানে এই প্রাকৃতিক সাবান (রিঠা) বিক্রি করতে দেখেছি। বর্তমানে হয়তো এটা আর মনোহারী দোকানে পাওয়া যায় না। কারণ আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমাদের আজ অনেক কিছুই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। হয়তো ভবিষ্যতে আরো হারাব। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, গ্রামাঞ্চলের মানুষ শ্যাম্পু কি জিনিস জানতো না। মাথা ও চুলের পরিচর্যার জন্য একমাত্র প্রাকৃতিক শ্যাম্পু ছিল রিঠা বা সোপ বেরি। দাদি ও নানিরা শীতের শেষে পশমি কাপড় ধোয়ার জন্য বাজারের ফর্দে রিঠার নাম লিখে দিতেন। এছাড়া তখনকার সময়ের আধুনিক মেয়েরা তাদের রূপচর্চায় রিঠা নামক প্রাকৃতিক সাবান ব্যবহার করতেন। কারণ সাবানে ক্ষার থাকে, সেই ক্ষার ত্বকের ক্ষতি করে। তাই তখনকার দিনের রূপসিরা তাদের ত্বকের যত্নে ও ত্বকের কোমলতা ধরে রাখতে রিঠা ব্যবহার করতেন। শুধু তাই নয়, সোনা রূপার দোকানেও এই রিঠা দিয়েই পরিষ্কার করত গহনা। তবে আজকাল মনে হয়, সোনা রুপা পরিষ্কার করতে রিঠার ব্যবহার আর নেই। কেননা, এই উপকারী উদ্ভিদ আজ বিপন্ন প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। গ্রামেগঞ্জে খুঁজে একটি রিঠা গাছও আর এখন পাওয়া যাবে না। এখনই সময় আর দেরি নয়, আমাদের উচিত এই তরুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সচেতন হওয়া ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। না হয় পারুল ফুলের মতই একদিন এই উপকারী উদ্ভিদ আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে যাবে।
আজহারুল ইসলাম: উদ্ভিদ ও প্রকৃতি বিষয়ক লেখক