শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বৈরী প্রকৃতিতে লাভজনক ধান চাষে যা করতে হবে

ধান চাষে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধানের জমিতে সব সময় দাঁড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই। ধানের চারা রোপণের পর জমিতে ১০ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত ছিপছিপে পানি রাখতে হবে যাতে রোপণকৃত চারায় সহজে নতুন শিকড় গজাতে পারে। এরপর কম পানি রাখলেও চলবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, ধানগাছ যেন খরাকবলিত না হয়। বৃষ্টিনির্ভর রোপা আমন এলাকায় জমির আইল ১৫ সে. মি. উঁচু রাখলে অনেকাংশে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায় যা খরা থেকে ফসলকে কিছুটা হলেও রক্ষা করে। এরপরও যদি ধান ফসল খরাকবলিত হয় তাহলে প্রয়োজনমাফিক সম্পূরক সেচ দিতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, খরাকবলিত ধানের চেয়ে সম্পূরক সেচযুক্ত ধানের ফলন হেক্টরে প্রায় ১ টন বেশি হয়
ম ইমরান সিদ্দিকী
  ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। ধানের সঙ্গে অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি জড়িত। বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে চলছে এবং চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ জমিতে ধান চাষ করা হয়। বাংলাদেশে আউশ, আমন ও বোরো এই তিন মৌসুম মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার কোটি টনের অধিক ধান উৎপাদন হচ্ছে। কৃষক ও কৃষি গবেষকদের চেষ্টায় ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থান অধিকার করে নিয়েছে।

ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশের জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে, অপরদিকে বাড়িঘর, কলকারখানা, হাট-বাজার, সড়ক-জনপথ স্থাপন এবং নদীভাঙন ইত্যাদি কারণে আবাদি জমির পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমছে। উপকূলে লবণাক্ততায় প্রতিদিন দুই শতাংশ জমি নষ্ট হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরা, বন্যা, লবণাক্ততা, শৈত্যপ্রবাহ ও শিলাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বৈরী প্রকৃতি ও আবহাওয়াকে মোকাবিলা করে ধানচাষ লাভজনক করতে যা করতে হবে।

ধানচাষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধানের স্তর হলো ফুল ও দুধ অবস্থা। ফুল অবস্থায় বোরো ধানের বা রোপা আমন ধানের জমিতে কমপক্ষে ২ ইঞ্চি থেকে ৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখলে ভালো হয়। বিকালে সেচ দিলে পানি বাষ্পীভবন কম হয়। মাটির গর্ত বা ফাটল বন্ধ করা উচিত। জমির আইল ঠিক রাখতে হবে। রোপা আমন মৌসুমে বর্ষার অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করতে হবে।

সার হলো গাছের খাদ্য। গাছ মাটি থেকে শিকড়ের মাধ্যমে সার গ্রহণ করে। জমি ভালোভাবে প্রস্তুত করা হলে অতি সহজে শিকড় মাটি থেকে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। ধান ফসলে ব্যবহৃত ইউরিয়া সারের ২৫ থেকে ৩০ ভাগ কাজে লাগে। ধান গাছের বাড়তি বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন মাত্রায় নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। প্রথম দিকের কুশি গজানোর সময় ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে তা থেকে গাছ প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন গ্রহণ করে কার্যকরী কুশির সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। সর্বোচ্চ কুশি উৎপাদন থেকে কাইচথোর আসা অবধি গাছ প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন পেলে প্রতি ছড়ায় পুষ্ট ধানের সংখ্যা বাড়ে। ইউরিয়া ছাড়া অন্য সার যেমন টিএসপি, মিউরেট অব পটাশ, জিপসাম, জিংক সালফেট মাত্রানুযায়ী জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে ছিটিয়ে প্রয়োগ করে চাষ দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। তবে বেলে মাটিতে পটাশ সার দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। তিন ভাগের দুই ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং এক-তৃতীয়াংশ কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে প্রয়োগ করতে হবে। জৈবসার ব্যবহার করা সম্ভব হলে তা প্রথম চাষের সময়ই জমিতে সমভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জৈবসার খরিফ মৌসুমে ব্যবহার করাই শ্রেয়।

ইউরিয়া সার প্রয়োগ করার পরও ধান গাছ যদি হলদে থাকে এবং বাড়-বাড়তি কম হয় তাহলে গন্ধকের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। অতঃপর বিঘাপ্রতি ৮ কেজি জিপসাম সার প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। লিফ কালার চার্ট বা এলসিসি পস্নাস্টিকের তৈরি চার রং-বিশিষ্ট একটি স্কেল। এলসিসি পদ্বতি অবলম্বন করলে ধান গাছের চাহিদানুযায়ী ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যায়। ফলে ইউরিয়া সারের খরচ কমানো ও অপচয় রোধ করা যায় এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেছে, এলসিসি ব্যবহারে শতকরা ২০-২৫ ভাগ ইউরিয়া সাশ্রয় করা যায়। প্রয়োজনে গুটি ইউরিয়া সার ব্যবহার করা যায়। গুটি ইউরিয়া হল, ইউরিয়া সার দিয়ে তৈরি বড় আকারের গুটি যা দেখতে ন্যাপথলিন ট্যাবলেটের মতো। গুটি ইউরিয়া ব্যবহারে সারের কার্যকারিতা শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ফলে ইউরিয়া সার পরিমাণে কম লাগে। আবার গুটি ইউরিয়া জমিতে একবারই প্রয়োগ করতে হয়। এরপর সব সময় গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী নাইট্রোজেন সরবরাহ থাকায় গাছের কোনো সুপ্ত ক্ষুধা থাকে না। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের পূর্ব শর্ত হলো ধান রোপণ করতে হবে সারিবদ্ধভাবে। সারি থেকে সারি এবং গোছা থকে গোছার দূরত্ব হবে ২০ সেন্টিমিটার। বোরো মৌসুমে চারা রোপণের ১০ থেকে ১৫ দিন এবং আউশ ও আমন মৌসুমে চারা রোপণের ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে প্রতি ৪ গোছার মাঝখানে ৩-৪ ইঞ্চি কাদার গভীরে গুটি পুঁতে দিতে হবে।

আগাছা ফসলের একটি মারাত্মক শত্রম্ন। আগাছা ফসলের ক্ষেতে অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদ যেমন শ্যামা, চেঁচড়া, হলদে মুথা ইত্যাদি। যে উদ্ভিদ ভুল জায়গায় জন্মেছে যেমন ধান ক্ষেতে পাট গাছ। আগাছা ধান গাছের আলো, পানি ও খাদ্য উপাদানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এবং ফসলের ক্ষতি করে। অতিদ্রম্নত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। নিবিড় চাষাবাদের কারণে ধান ফসলে বিভিন্ন প্রকার রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন রোগ-বালাই ধানের ক্ষতি করে এবং ফলন কমিয়ে দেয়। এজন্য রোগ শনাক্ত করে তার জন্য ব্যবস্থাপনা নিতে হবে।

ধান চাষে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধানের জমিতে সব সময় দাঁড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই। ধানের চারা রোপণের পর জমিতে ১০ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত ছিপছিপে পানি রাখতে হবে যাতে রোপণকৃত চারায় সহজে নতুন শিকড় গজাতে পারে। এরপর কম পানি রাখলেও চলবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, ধানগাছ যেন খরাকবলিত না হয়। বৃষ্টিনির্ভর রোপা আমন এলাকায় জমির আইল ১৫ সে. মি. উঁচু রাখলে অনেকাংশে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায় যা খরা থেকে ফসলকে কিছুটা হলেও রক্ষা করে। এরপরও যদি ধান ফসল খরাকবলিত হয় তাহলে প্রয়োজনমাফিক সম্পূরক সেচ দিতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, খরাকবলিত ধানের চেয়ে সম্পূরক সেচযুক্ত ধানের ফলন হেক্টরে প্রায় ১ টন বেশি হয়।

বোরো মৌসুমে ধানের জমিতে সাধারণত মাটির নালা দিয়ে সেচ দেওয়া হয়। ফলে ফসলের জমি ও সেচের পানি উভয়েরই অপচয় হয়। এ অপচয় রোধকল্পে পিভিসি অথবা পস্নাস্টিক পাইপ ব্যবহার করে পানির অপব্যবহার ও অপচয় রোধ করা যায়। এ পদ্বতিতে সেচ দিলে পানির অপচয় কমানোর সঙ্গে সেচের খরচও কমানো যায়। গভীর অথবা অগভীর নলকূপ থেকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে সেচ দিলে একই পরিমাণ পানি দিয়ে কাঁচা নালার তুলনায় শতকরা প্রায় ৪০ থেকে ৪২ ভাগ বেশি জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব। যখনই গাছে থোড় দেখা দেবে তখন থেকে দানা শক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ক্ষেতে স্বাভাবিক ২ থেকে ৫ সে.মি. পানি রাখতে হবে। এই পদ্বতি ব্যবহারের ফলে সেচের পানি, জ্বালানি ও সময় সাশ্রয় হয় এবং উৎপাদন খরচও হ্রাস পায়।

অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শিস ভেঙে যায়, শিসকাটা লেদাপোকা এবং পাখির অক্রমণ হতে পারে। শিসের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। কাটার পর ধান মাঠে ফেলে না রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাড়াই করা উচিত। কাঁচা খলার ওপর ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে নিন। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে। মাড়াই করা ধান অন্তত ৪-৫ দিন রোদে ভালোভাবে শুকানোর পর যেন বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে এবং এমতাবস্থায় গুদামজাত ও আর্দ্রতা-রোধক গুদামে সংরক্ষণ করতে হবে।

আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদনে অনেক অর্জন রয়েছে। স্বাধীনতার আগে দেশের লোকসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি বা তার চেয়ে বেশি কিছু হবে। তখন দানাজাতীয় ফসল উৎপাদন ১ কোটি টন থেকে দশ-পনেরো লাখ টন কম ছিল। দানাজাতীয় ফসলের মধ্যে ধান ফসলই প্রধান ছিল। সামান্য কিছু জমিতে গম চাষ হতো। এখন আমরা ধান, গম, ভুট্টা চাষ করে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টন উৎপাদনে সক্ষম হয়েছি। প্রায় চারগুণ দানাজাতীয় ফসল উৎপাদন করেছেন এদেশের কৃষক। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা এবং প্রতি বছর ২২ থেকে ২৪ লাখ লোকসংখ্যা যোগ হচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে