রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
দুটি পাতা একটি কুঁড়ি নিয়ে চা শিল্প

চা রপ্তানিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে

১০ বছরে চায়ের চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণ
কৃষিবিদ ডক্টর মো. আল-মামুন
  ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

চা বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন ও ক্রমাগত নগরায়ণের ফলে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। গত দুই দশকে দেশের উত্তরাঞ্চলে সমতলে চা আবাদে বিপস্নব ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬৮ বছরের ইতিহাসে ২০২১ সালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে। মোট চা উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি। চা উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই অবদান চা বাগানসংশ্লিষ্ট সব চা শ্রমিক, কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশ টি বোর্ড ও চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের পরিশ্রমের ফসল। উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে চা রপ্তানির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

এক কাপ ধোঁয়া উঠা চা ছাড়া আমাদের অনেকেরই চলে না, আড্ডা জমে না কবি, সাহিত্যিক ও রাজনীতি বিশ্লেষকদের। চা বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষের সবচেয়ে প্রিয় পানীয়। ন্যাশনাল টুডে'র তথ্য অনুযায়ী, প্রতি সেকেন্ডে মানুষ ২৫ হাজার কাপ চা পান করেন। বছরের পর বছর ধরে চা নিয়ে নানান গবেষণা হয়েছে। গবেষকরা বলেন, চায়ের ভেতরের ক্যাফেইন মানুষের শরীর ও মনকে চাঙা করে এবং কাজে উদ্দীপনা জোগায়। ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করতে চায়ের জুড়ি নেই। বাজারে বস্ন্যাক টি, গ্রিন টি, সাদা টি ও ক্লোন টি ইত্যাদি বিভিন্ন নামে চা পাওয়া যায়। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে উচ্চফলনশীল ও আকর্ষণীয় গুনগতমান সম্পন্ন ২৩টি ক্লোন ও ৫টি বীজজাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১৬ সালে পাটের পাতা দিয়ে অর্গানিক চা উৎপাদন শুরু করে। পাটের সবুজ পাতা থেকে তৈরি এ চা চমৎকার ঔষুধি গুণসম্পন্ন- যা ডায়াবেটিস, ক্যানসারসহ মারাত্মক রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে। বর্তমানে বহু উদ্যোক্তা পাট পাতার চা দেশে-বিদেশে বাজারজাত করছে ভেষজ পণ্য হিসেবে। এছাড়া বিজেআরআই উদ্ভাবিত রোজেলা (চুকুর) চা ডায়াবেটিসবিরোধী, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এজেন্ট, হজমে সহায়তা করে এবং ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। ইতালি, আফ্রিকা ও থাইল্যান্ডে সবজি মেস্তার পাতা ভেষজ চা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে চীন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬৫০ সালে চীনে প্রথম চা উৎপাদন হয়। দেশটির বুদ্ধিজীবীদের প্রতিদিনকার জীবনের ৭টি কাজের একটি ছিল চা পান। ১৮০০ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ভারতবর্ষের আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় চা চাষ শুরু হয়। ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাবসংলগ্ন এলাকায় একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল- যা কুন্ডদের বাগান নামে পরিচিত। অতঃপর ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেটের মালিনীছড়া চা বাগানে চা চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সময় চা বাগান তৈরির জন্য ভারতের আসাম, উড়িষ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের এই ভূখন্ডে স্থানান্তর করা হয়। মূলত, মালনীছড়াই বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান। টি বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে সমতল ও পাহাড়ি মিলে টি-এস্টেট এবং চা বাগান আছে ১৬৭টি। সবচেয়ে বেশি চা বাগান রয়েছে মৌলভীবাজার জেলায় ৭৫টি টি-এস্টেট ও ১৫টি চা বাগান রয়েছে। মৌলভীবাজারের চায়ের রং, স্বাদ এবং সুবাসের জন্য এ জেলার চা পর্যটকদের কাছে বিস্ময়। হবিগঞ্জ জেলায় ২২টি টি-এস্টেট ও ৩টি চা বাগান রয়েছে এবং সিলেট জেলায় ১২টি টি-এস্টেট ও ৭টি চা বাগান রয়েছে। এছাড়াও চট্টগাম জেলায় রয়েছে ১৮টি টি-এস্টেট ও ৪টি চা বাগান।

পাকিস্তান টি অ্যাক্ট-১৯৫০ এর অধীনে ১৯৫১ সালের ২২ ফেব্রম্নয়ারি তৎকালীন পাকিস্তান চা বোর্ড গঠন করা হয়। ১৯৫৭ সালের ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসেবে তৎকালীন চা বোডের্র চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রত্যক্ষ দিকনির্দেশনায় ১৯৫৭ সালে শ্রীমঙ্গলে চা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং ঢাকার মতিঝিলে চা বোর্ডের কার্যালয় স্থাপিত হয়। বাংলাদেশ চা বোর্ড চা শিল্পের উন্নয়ন তথা চায়ের উৎপাদন, বিপণন ও রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সামগ্রিকভাবে চা শিল্পের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে চা বোর্ড কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় ক্ষুদ্রায়তন চা আবাদে ব্যাপক সফলতা লাভ করছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ৫২ বছরের হলেও চা শ্রমিকদের শ্রম ও ঘামের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের। ১৯২১ সালের ২০ মে, সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক নিজ জন্মভূমি কলকাতা ফিরতে চাওয়ার অপরাধে শত শত নিরীহ চা শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে ব্রিটিশ গোর্খা বাহিনীর সৈন্যরা। মূলত ১৯২১ সালে চা শ্রমিকরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তাদের ভাষায় এই আন্দোলনকে বলা হয় 'মুলস্নুকে চলো' আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় চা শ্রমিকরা ১৯৩৮ সালে শ্রমিক হত্যা ও নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন করে। ১৯৫৮ সালে ফ্রি মুভমেন্ট ও দ্বিপক্ষীয় আলোচনা এবং শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তি আন্দোলন করে। ১৯৭৮ সালে মজুরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির আন্দোলন এবং ১৯৮৩ সালের ৬ জুলাই মহিলা চা শ্রমিকদের আন্দোলনও উলেস্নখযোগ্য। বছরের পর বছর ধরে এসব চা বাগানে কমর্রত লক্ষাধিক চা শ্রমিক দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

চা রপ্তানির অতীত ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে সরকার রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। চা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার বৃহদায়তন বাগানের পাশাপাশি সমতলে ক্ষুদ্রায়তন চা আবাদে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। সরকার চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। চা শ্রমিক ও তাদের সন্তানদের জন্য কল্যাণ তহবিল, শিক্ষা স্ট্রাস্ট ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ভাতা ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করছে। চা বাগানের শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাগানগুলোতে পর্যাপ্ত স্কুল ও হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুদানের পরিপ্রেক্ষিতে চা বাগানের শ্রমিক পোষ্যদের শিক্ষার মান উন্নয়নে বাংলাদেশ চা বাগান শ্রমিক শিক্ষা ট্রাস্ট গঠিত হয়। ট্রাস্ট গঠনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ২৬ হাজারের অধিক শ্রমিক সন্তানদের বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। চা শ্রমিকদের সন্তানরাও এখন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে ভালো অবস্থানে আছে। এছাড়া চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে শ্রমিকদের মজুরি প্রধানমন্ত্রী ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৭০ টাকা বৃদ্ধি করায় চা শ্রমিকদের মাঝে এখন স্বস্তি ফিরে এসেছে। তবে এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সরকারের চলমান সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে তাদের জীবনমানের আরও উন্নতি হবে।

পৃথিবীব্যাপী গত ১০ বছরে চায়ের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়েছে। চা শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ০১ কোটি মানুষ। দেশে চা চাষের পরিমাণ বাড়লে একদিকে যেমন আমাদের দেশের জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল হবে, অপরদিকে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার গুণগত মানও বজায় রাখতে হবে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে চা শিল্পকে প্রতি বছরই খরার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ফলে অসংখ্য গাছ মরে যাচ্ছে। চা বাগানের ছায়া প্রদানকারী বৃক্ষ চুরি ও অনাবাদি জমি দখল হয়ে যাচ্ছে এবং চা বাগান এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। এসব কারণে চায়ের উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। চা শিল্পকে রক্ষা করার জন্য বিদেশ থেকে চায়ের আমদানি নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। আবার বিশ্বজুড়ে ক্রেতারা চায়ের রং, ঘ্রাণ ও স্বাদ এই তিনটি বিষয়ে গুণগত মান উন্নত করার জোরালো তাগিদ দিয়ে থাকে। চায়ের গুণগত মান উন্নত করার জন্য বিদেশ থেকে ভালো মানের ক্লোন চারা এবং উন্নত চাষ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের চা শিল্পকে উন্নতির শিখরে পৌঁছানো সম্ভব।

দেশের দুই লাখ ৮০ হাজার একর জমিতে ১৬৭টি চা বাগান ও টি এস্টেটে নিরলসভাবে কাজ করছে প্রায় সোয়া লাখ চা শ্রমিক। ধীরে ধীরে চা এ দেশে একটি কৃষিভিত্তিক শিল্প হিসেবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ শিল্পে জড়িত আছে হাজার হাজার শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তা। চা মালিকরা চা বাগানগুলোতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা বৃদ্ধি করেছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নযাত্রায় চা শিল্পের অবদান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবারই সততা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ,

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে