সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

'খামারি অ্যাপ' ব্যবহারে স্মার্ট ও প্রযুক্তিনির্ভর হবে কৃষি খাত

কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় ২০১৭ সাল থেকে ২০২৫ সাল মেয়াদে 'ডেভেলপমেন্ট অব উপজেলা ল্যান্ড সুইটেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড ক্রপ জোনিং সিস্টেম অব বাংলাদেশ' নামক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। এ প্রকল্পের উপজাত হিসেবে 'খামারি' অ্যাপটি তৈরি করা হয়েছে।
আবদুলস্নাহ-আল-বাক্কী
  ২২ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

বিশ্বায়নের বর্তমান যুগে আধুনিক নানা প্রযুক্তির উদ্ভব, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব, যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনসহ সমগ্র উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়েছে। অর্থনীতির শিল্প খাত ও সেবা খাতের মতো কৃষি খাতও দিন দিন হয়ে উঠেছে স্মার্ট ও প্রযুক্তিনির্ভর। কৃষির আধুনিকায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থাও নিয়মিত নানা কার্যক্রম গ্রহণ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল মুঠোফোনে 'খামারি' অ্যাপ পরীক্ষামূলকভাবে উন্মোচন করেছে- যা নানা বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় ২০১৭ সাল থেকে ২০২৫ সাল মেয়াদে 'ডেভেলপমেন্ট অব উপজেলা ল্যান্ড সুইটেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড ক্রপ জোনিং সিস্টেম অব বাংলাদেশ' নামক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। এ প্রকল্পের উপজাত হিসেবে 'খামারি' অ্যাপটি তৈরি করা হয়েছে। এ অ্যাপে আধুনিক ক্রপ জোনিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ক্রপ জোনিংয়ে মূলত এলাকাভিত্তিক মাটির বৈশিষ্ট্য, আবহাওয়া-জলবায়ু ও ফসলের অর্থনৈতিক দিক এ তিনটি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য দিয়ে কোন এলাকার জমি কোন মৌসুমে কোন ধরনের ফসলের জন্য উপযোগী, এলাকাভিত্তিক কোন ফসল অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক তা চিহ্নিত করা অত্যন্ত সহজ। এক কথায়, প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে অধিক ফসল উৎপাদনের যোগ্য এলাকা নির্ধারণ করার মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে ক্রপ জোনিং। এছাড়াও খামারি অ্যাপে ভূ-স্থানিক প্রযুক্তি তথা আধুনিক জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) ও রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। একই সঙ্গে অ্যাপটিতে উঁচু-নিচু জমির ক্ষেত্রে শাটল রাডার টপোগ্রাফি মিশনের (এসআরটিএম) তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। কৃষকদের সুবিধার্থে এটি সম্পূর্ণ বাংলায় তৈরি করা হয়েছে। অ্যাপটির পরিকল্পনাকারী ও স্বত্বাধিকারী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ভূমি ও মৃত্তিকা সংক্রান্ত তথ্য প্রদানকারী মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ও নির্মাতা ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং।

অ্যাপটিতে প্রবেশ করলেই ফসল উপযোগিতা, সার সুপারিশ, ফসল জোন, শস্য বিন্যাস, সংরক্ষিত তথ্য ও মাটির গুণাগুণ নামক ভিন্ন ভিন্ন মেনু্যবার পাওয়া যায়। ফসল উপযোগিতা মেন্যুতে প্রবেশ করলে অবস্থানভিত্তিক ও ইউনিয়নভিত্তিক দুটি অপশন পাওয়া যায়। অবস্থানভিত্তিক অপশনে প্রবেশ করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোবাইল ফোনটির অবস্থানকৃত স্থানের ম্যাপ, দ্রাঘিমাংশ, অক্ষাংশ ও এইজেডের তথ্য প্রদর্শন করে। এছাড়াও এই অপশনে মৌসুম, ফসল, ফসল পরিবেশ ও লাভজনক ফসল নির্ধারণের মেন্যু বার পাওয়া যায়। মৌসুম অপশনে রবি, খরিপ-১ ও খরিপ-২ নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে। ফসল অপশনে ওই এলাকায় চাষ করা সব ফসলের তালিকা রয়েছে। এছাড়াও লাভজনক ফসল অপশনে প্রবেশ করলে ওই এলাকায় যেসব শস্য চাষ লাভজনক তার প্রতি শতাংশে মুনাফার হারের পরিমাণ জানা যায়। একই সঙ্গে ইউনিয়নভিত্তিক অপশনে প্রবেশ করলে বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নের মেন্যু বার পাওয়া যায়। এখানে কাঙ্ক্ষিত এলাকার তথ্য সঠিকভাবে প্রদান করলে মৌসুম অনুযায়ী শস্য গ্রম্নপ ও উপযোগী ফসলের তালিকা পাওয়া যায়। বসতবাড়িতে অবস্থান করলে পার্শ্ববর্তী কৃষি জমিতে ম্যাপের অবস্থান নির্ধারণ করে নিতে হয়।

সার সুপারিশ মেন্যু বারে প্রবেশ করলে অবস্থানভিত্তিক ও ইউনিয়নভিত্তিক দুটি অপশন পাওয়া যায়। এ দুটি অপশনের অধীনে আবার ফসল অনুসারে ও ফসল বিন্যাস অনুসারে শিরোনামের দুটি অপশন রয়েছে। এসব অপশনের মাধ্যমে মৌসুমভিত্তিক কাঙ্ক্ষিত ফসলের তথ্য জানতে চাইলে ওই শস্যের বিভিন্ন জাতভিত্তিক প্রতি শতাংশে সার সুপারিশ ও সার প্রয়োগ পদ্ধতির পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়।

ফসল জোন মেন্যু বারে প্রবেশ করে কাঙ্ক্ষিত এলাকার মৌসুমভিত্তিক ফসলের তালিকা পাওয়া যায়। শস্য বিন্যাস মেন্যু বারে কাঙ্ক্ষিত এলাকার মৌসুমভিত্তিক বর্তমান শস্য বিন্যাস ও লাভজনক শস্য বিন্যাসের তালিকা, লাভ ও আয়-ব্যয় অনুপাতের তথ্য জানা যায়। মাটির গুণাগুণ মেন্যু বারে কাঙ্ক্ষিত এলাকার মাটির বৈশিষ্টসমূহ ও মাটির পুষ্টি উপাদানের মান সম্পর্কে জানা যায়। উপরোক্ত যে সমস্ত তথ্য আমাদের জন্য জরুরি তা সংরক্ষণ করা যায় ও পরবর্তী সময়ে সংরক্ষিত তথ্য মেনু্য বার থেকে সহজেই তা ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও অন্যান্য মেন্যু বারের অধীনে কৃষি প্রযুক্তি, কৃষি সেবা, ইনফোগ্রাফিক্স, আবহাওয়া, কৃষি কল সেন্টার ও দুর্যোগের আগাম বার্তা সম্পর্কিত নানা তথ্য জানা যায় ও অ্যাপটি সম্পর্কিত যে কোনো পরামর্শ প্রদান করা যায়।

এ অ্যাপের তথ্যের ভিত্তিতে কৃষক সহজেই তার জমির জন্য লাভজনক ফসল নির্ধারণ করতে পারবে এবং সেই ফসলের উৎপাদন পদ্ধতিও ঠিক করতে পারবেন। একই সঙ্গে অ্যাপের তথ্য গবেষক ও নীতি নির্ধারকদের নানা কার্যক্রমেও সহায়তা করবে। এখন পর্যন্ত অ্যাপটিতে দেশের ৩৬০টি উপজেলার ৭৬টি ফসলের ক্রপ জোনিং পাওয়া যায়। অ্যাপটি বর্তমানে গুগল পেস্ন স্টোরে পাওয়া যাচ্ছে এবং এটি ডাউনলোড করা হয়েছে ১০ হাজার বারের বেশি। এছাড়াও ইতোমধ্যে ৫৩টি উপজেলায় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষক প্রতিনিধি ও সার ব্যবসায়ীদের নিয়ে ৪০ জনের দল গঠন করে অ্যাপটির ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশে খামারি অ্যাপের উদ্ভাবন নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। অ্যাপটি ব্যবহার করে অন্যান্য ফসলের পাশপাশি পাট চাষ করে উপকৃত হতে পারে কৃষকরা। অ্যাপটিতে পাটের বিভিন্ন জাত, এগুলোর সার সুপারিশ, সার প্রয়োগ পদ্ধতি ও মুনাফার হার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। পাট চাষিরা এটি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিমিত সার প্রয়োগ করে সর্বোচ্চ ফলন পেতে পারে। পাট উৎপাদনপ্রবন ৪৬টি জেলায় উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি অবশিষ্ট জেলাগুলোতেও পাটচাষ সম্প্রসারণে 'খামারি' অ্যাপ কৃষক ও গবেষকদের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ

পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে