সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
খাবার রান্না গোসল ও সেচসহ সব কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ

পানির দুষ্প্রাপ্যতায় বাড়ছে কৃষকের সেচ খরচ

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) 'গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ' অনুযায়ী- গত কয়েক বছরে দেশের ৪১ জেলার ১৯২ উপজেলায় দেখা দিয়েছে সেচের পানি সংকট। দেশের অধিকাংশ এলাকায়ই শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। মহুরী সেচ প্রকল্প, জিকে প্রকল্প, বরেন্দ্র সেচ প্রকল্প এবং মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পথে। রংপুর, রাজশাহী, খুলনা অঞ্চলেও সেচের পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা ও রাজশাহীতে পানির স্তর গড়ে ২০ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে। ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় পানির স্তর নেমে গেছে প্রায় ২৫ ফুট। সবচেয়ে বেশি নেমেছে রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায়।
ইমরান ছিদ্দিকি
  ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

বাংলাদেশে বোরো, আমনসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন সম্পূর্ণ পানির ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ুর প্রভাবে কোনো কোনো বছর ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টির দেখা মিলে না। ফেটে চৌচির হয় ফসলের মাঠ। দেশে বোরো ও আমন মৌসুমে ডিজেল চালিত ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল মাটির নিচ থেকে পানি তুলে। এগুলো ২০ থেকে ২৪ ফুট মাটির নিচ থেকেও পানি তুলতে পারত। কিন্তু বর্তমানে অনেক এলাকায় মাটির ৩০ ফুট নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির এ দুষ্প্রাপ্যতায় বেড়ে যাচ্ছে কৃষকের সেচ খরচ।

বোরো মৌসুমে এক কেজি ধান উৎপাদনে প্রায় দুই হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এ পানির জোগান আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শুধু বোরো উৎপাদনে সেচবাবদ ৯ হাজার ৮৭ কোটি টাকার জ্বালানি ব্যয় হচ্ছে। এতে বাড়ছে কৃষকের উৎপাদন ব্যয়। দেশে কৃষকের সেচের পেছনে মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। ধান উৎপাদনে এ খরচ বিশ্বে সর্বোচ্চ।

দেশের মূলত মধ্যভাগ ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত ৩১ জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। পানির স্তর এক ফুট নিচে চলে গেলে কৃষকদের বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়। এক ফুট বেশি দেবে গেলে বেশি হর্সপাওয়ারের সেচ পাম্প দরকার হয়। এতে জ্বালানি তেল বা বিদু্যৎ বেশি প্রয়োজন হয়। ১৯৬৮ সালে যখন বাংলাদেশে ডিপ-টিউবওয়েল বসানো হয়, তখন সর্বোচ্চ ৫০ ফুট নিচে বসানো হতো। এখন ১৫০ ফুট নিচে বসানো হলেও পানি মিলছে না। পানির অপর নাম জীবন। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচসহ সব কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। সুপেয় ও চাষাবাদের পানির চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে।

বাংলাদেশে সুপেয় পানি পাচ্ছেন না প্রায় তিন কোটি মানুষ। বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় পাঁচ হাজার শিশু মারা যাচ্ছে সুপেয় পানি সুবিধার অভাবে। দেশের উপকূল, পার্বত্য এলাকা, হাওরাঞ্চল, বরেন্দ্র এলাকা, চা বাগান ও দুর্গম এলাকায় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। আশঙ্কাজনকভাবে ঢাকার পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, নিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই এমন ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে সুপেয় খাবার পানি অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। গ্রীষ্মের শুরুতেই বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামগুলোতে খাবার পানির সংকটে ব্যাহত হয় জনজীবন। ক্রমেই পানি সংকটাপূর্ণ হয়ে উঠছে বরেন্দ্র অঞ্চল। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার অধিকাংশ এলাকা এবং নাটোরসহ বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার কিয়দংশ এলাকা জুড়ে বরেন্দ্র অঞ্চল অবস্থিত। সুপেয় খাবার পানি নিয়ে সংঘাতে প্রাণহানিও হয়েছে একাধিকবার। পানি না পেয়ে এলাকা ছাড়ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ।

বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপের অন্যতম। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়াবহ সেচের পানি সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। কয়েক বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই সারাদেশে কৃষি কাজে ব্যবহৃত প্রায় আড়াই লাখ শ্যালো টিউবওয়েলে সেচের পানি ওঠেছে না। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।

ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘন ঘন আঘাত হানছে। ফলে লবণাক্ততা বেড়ে নষ্ট হচ্ছে মিষ্টি পানির আধার। খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকায় সুপেয় পানি প্রায় দুষ্পাপ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানি এখন সোঁনার হরিণ।

দেশের প্রান্তিক

জনগোষ্ঠী, উপকূল, পার্বত্য এলাকা, হাওরাঞ্চল, বরেন্দ্র এলাকা, চা বাগান ও দুর্গম এলাকায় নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যাপক সংকট রয়েছে। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাত্র ৫৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছেন। জাতিসংঘ পানি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় পানি ফোরাম 'দ্য এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে পানি সংকট ভয়াবহ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৯ দেশের মধ্যে ৩৭ দেশেই পানি সংকট রয়েছে। এর মধ্যে সুপেয় পানির সংকট ভয়াবহ রূপ পেতে চলেছে বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়ায়।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) 'গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ' অনুযায়ী- গত কয়েক বছরে দেশের ৪১ জেলার ১৯২ উপজেলায় দেখা দিয়েছে সেচের পানি সংকট। দেশের অধিকাংশ এলাকায়ই শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। মহুরী সেচ প্রকল্প, জিকে প্রকল্প, বরেন্দ্র সেচ প্রকল্প এবং মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পথে। রংপুর, রাজশাহী, খুলনা অঞ্চলেও সেচের পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা ও রাজশাহীতে পানির স্তর গড়ে ২০ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে। ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় পানির স্তর নেমে গেছে প্রায় ২৫ ফুট। সবচেয়ে বেশি নেমেছে রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায়।

আন্তর্জাতিক পর্বত গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্টের (আইসিআইএমওডি) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে আগামী ৮০ বছরের মধ্যেই গলে যাবে হিন্দুকুশ ও হিমালয় পবর্তমালার দুই তৃতীয়াংশ বরফ। দুই পবর্তমালার হিমবাহগুলো অন্তত আটটি দেশের পানির প্রধান উৎস। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমবাহ গলে গেলে চরম ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে এ অঞ্চলের দুইশ' কোটিরও বেশি মানুষ। কেউ কেউ আগামী দিনে পানি নিয়ে বিশ্ব যুদ্ধের আশঙ্কাও করছেন।

বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০২০ সালেই বিশ্বের প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ পানির স্বল্পতার শিকার হয়েছে। ২০৩০ সাল নাগাদ পানির অভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ধান ও ভুট্টার ফলন ১০ শতাংশ কমে যাবে। পানির অভাবে এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে। পাকিস্তানে ইতোমধ্যে শস্যের উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততা, আর্সেনিক দূষণ আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানীয়জলের সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকায় পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ২১২ ফুট নিচে চলে গেছে। ঢাকায় সমুদ্রের লবণ পানি চলে আসার আশঙ্কা করা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে