সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সবজি ফসল ব্যবস্থাপনা উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক

অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
  ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ফসল চাষাবাদের ক্ষেত্রে গাছের যথাযথ বৃদ্ধি এবং কাঙ্ক্ষিত ফলনের জন্য বীজবপন অথবা চারা রোপণের পর থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত যেসব কাজ বা পরিচর্যা পর্যায়ক্রমে করা হয় তাদের একত্রে ফসল ব্যবস্থাপনা বলে।

মালচিং : পচা কচুরিপানা, খড়কুটা, শুকনা ঘাস, লতাপাতা ইত্যাদি দ্বারা মাটির উপরিভাগ ঢেকে দেওয়াকে মালচিং বলে। গাছের গোড়ায় খড়কুটা বিছিয়ে দিয়ে এ কাজ করা হয়। মালচিং সঠিক পরিমাণ হচ্ছে ২.৫-৫ সেমি। নিড়ানি, আঁচড়া ইত্যাদি দ্বারা ২-৪ সেমি গভীর করে মাটির ওপরের শক্ত স্তর ভেঙে দেওয়াকেও মালচিং বলা হয়। অনেক সময় মালচিংয়ে পিঁপড়া ও উইপোকা বাসা বেঁধে থাকে। তাই মাঝে মধ্যে খেয়াল রাখতে হবে এবং এ অবস্থা সৃষ্টি হলে মালচ উল্টিয়ে দেওয়া যেতে পারে অথবা কয়েকদিনের জন্য মালচ সরায়ে রাখা যেতে পারে। মালচিংয়ের ফলে জমিতে আগাছা কম হয়, মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও মাটির সঠিক আদ্রতা বজায় থাকে। মাটির সঠিক আদ্রতা বজায় থাকে বিধায় উপকারী অনুজীবের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও মালচ পচে মাটিতে জৈব সার যুক্ত হয়।

ছায়া দেওয়া : চারা রোপণের পর রোদের তাপে অথবা বৃষ্টিতে চারার সমূহ ক্ষতি হতে পারে। এ অবস্থায় গাছের শিকড় সহজে মাটিতে বিস্তার লাভ করতে পারে না এবং চারার খাদ্য গ্রহণে অসুবিধা হয়। ফলে চারা মারা যায় অথবা চারা মাটিতে লেগে যেতে বেশ সময় লাগে। তাই চারা রোপণের পরপরই কলার খোল বা অন্য কিছু দিয়ে চারাকে সূর্যের তাপ এবং বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য ছায়া দেওয়া প্রয়োজন- যাতে করে চারা সহজে বেঁচে ওঠে মাটিতে লেগে যেতে পারে।

বেড়া দেওয়া : সবজি ফসল চাষাবাদের জন্য জমিতে বীজবপন বা চারা রোপণের পর যে কাজটা অবশ্য করণীয় তা হচ্ছে বেড়া দেওয়া। এটা করা হয় গরু, ছাগল ও মানুষের অনিষ্ট থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য। বাঁশ, কঞ্চি বা অন্যান্য বৃক্ষ জাতীয় গাছের ডালপালা দিয়ে এ কাজ করা যায়। তবে স্থানীয়ভাবে সহজপ্রাপ্য জিনিস দিয়ে বেড়া দেওয়ার কাজ সুবিধাজনক।

পানি সেচ : ফসলের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও জন্মানোর জন্য কৃত্রিম উপায়ে পানি সরবরাহকে পানি সেচ বলে। মানুষের জীবনধারণের জন্য যেমন পানির প্রয়োজন, তেমনি ফসলের জীবনধারণের জন্যও পানির প্রয়োজন। ফসল তার প্রয়োজীয় খাদ্যের অনেকটা মাটি থেকে শিকড়ের সাহায্যে গ্রহণ করে থাকে। শিকড় শক্ত খাদ্য মাটি থেকে গ্রহণ করতে পারে না। তাই সেচের প্রয়োজন হয়। গাছ মাটি থেকে পানি গ্রহণ করে তার পানির চাহিদা মেটায়। তাই পানির চাহিদা পূরণের জন্য বীজবপন বা চারা রোপণের পর থেকেই সেচ দেয়া প্রয়োজন। ঝরনা অথবা ছোট বালতি ইত্যাদির মাধ্যমে চারার উপরে ও চারপার্শ্বে ভালোভাবে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে- যাতে করে পানি মাটির গভীরে প্রবেশ করতে পারে।

আগাছা দমন : আগাছা ফসলের মারাত্মক শত্রম্ন। সবজি জমি সব সময় আগাছামুক্ত রাখা দরকার। সময় মতো আগাছা দমন না করলে ফসলের কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যায় না। কারণ, আগাছা মূল ফসলের সঙ্গে খাদ্য, পানি, আলো-বাতাস ও জায়গা ইত্যাদির জন্য প্রতিযোগিতা করে। আগাছা পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। তাই ফসল চাষাবাদের প্রাথমিক পর্যায়েই আগাছা দমন করা অপরিহার্য। নিড়ানি, কোদাল, আঁচড়া ইত্যাদি দিয়ে আগাছা দমন করা যায়। জমিতে আগাছা দেখামাত্রই নিড়ানি দিয়ে মূলসহ দমন করতে হবে। ভালো ফলন পেতে হলে ৩-৪ বার আগাছা দমন করা দরকার। চারা গজানোর পর থেকে কমপক্ষে ৩০-৪০ দিন পর্যন্ত জমি আগাছামুক্ত রাখা প্রয়োজন।

মাটি আলগাকরণ : জমিতে সবজি ফসল থাকা অবস্থায় মাটিকে নরম ও ঝুরঝুরে রাখার জন্য বিভিন্ন সময় যে কাজ করা হয় তাকে মাটি আলগাকরণ বলে। নিড়ানি, কোদাল, আঁচড়া ইত্যাদির মাধ্যমে মাটি আলগাকরণ করা হয়। বৃষ্টিপাত বা সেচের পর আইলের মাটি শুকিয়ে চটা বেঁধে গেলে এ কাজ করা দরকার। এতে মাটিতে সহজে আলো, বাতাস, পানি চলাচল করতে পারে এবং মৃত্তিকাস্থ অণুজীবের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।

চারা পাতলাকরণ : বপন পদ্ধতিতে সবজি চাষাবাদ করার ক্ষেত্রে সব সময়ই সঠিক দূরত্ব বজায় রেখে বীজবপন করা সম্ভব হয় না। সে সব ক্ষেত্রে বীজ গজানোর পর দেখা যায় যে, গাছ ঘন হয়েছে। এসব গাছ একে অপরের সঙ্গে খাদ্য, আলো-বাতাস ও স্থানের জন্য প্রতিযোগিতা করে, গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ফলন কম হয়। তাই এ অবস্থায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত চারা ছোট সময়েই উঠায়ে ফেলতে হয়।

সারের উপরি প্রয়োগ : গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার খাদ্য চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। খাদ্যের অভাবে গাছের বৃদ্ধি থেমে যায়; যার ফলে, ফুল ও ফল উৎপাদন কম হয়। তাই জমিতে ফসল থাকা অবস্থায় সার উপরিপ্রয়োগ করা দরকার। সাধারণত ইউরিয়া এবং এমপি সার গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধি শুরু হলে পার্শ্ব প্রয়োগের মাধ্যমে প্রয়োগ করা যায়।

শূন্যস্থান পূরণ : চারা রোপণের পর কখনো কখনো বিভিন্ন সবজির চারা মারা যায়। আবার কখনো দেখা যায় যে, বপনকৃত বীজ গজায় না। ফলে জমিতে চারার পরিমাণ কমে যায়। জায়গা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয় এবং ওই জায়গায় আগাছার জন্ম হয়। এতে ফসলের ফলন কমে যায়। সুতরাং, ওইসব শূন্যস্থানে আবার নতুন করে ওই একই জাতের, একই বয়সের চারা লাগানো বা বীজবপন করা উচিত।

গাছের গোড়ায় মাটি দেওয়া : ফলন বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কিছু ফসলের ক্ষেত্রে গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধির সময় ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে গাছের গোড়া ঢেকে দিতে হয়। এর ফলে কন্দের বৃদ্ধি ভালো হয়। যেমন- আলু, মিষ্টিআলু, গাজর প্রভৃতি।

খুঁটি/বাউনি দেওয়া : লতানো সবজি ফসলসহ অন্যান্য বিশেষ কিছু ফসল চাষাবাদের ক্ষেত্রে গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধির সময় খুঁটি/বাউনি দেওয়া প্রয়োজন। খুঁটি না দিলে গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। গাছ মাটিতে নুয়ে পড়লে, ফলে ফলন কম হয়। বাঁশ, কঞ্চি, পাটকাঠি, ধৈঞ্চা ইত্যাদি দিয়ে এ কাজ করা হয়। এ ছাড়া জমিতে পাতলা করে ধৈঞ্চা গাছ জন্মিয়ে সেগুলিকেও খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। খুঁটি দেওয়ায় গাছ পরিমিত আলো বাতাস পায়, সবজি ফল পচনের হাত থেকে রক্ষা পায় ও ফলন বেশি হয়। সিম জাতীয় ফসল, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, বরবটি প্রভৃতি ফসলের ক্ষেত্রে খুঁটি দেওয়ার প্রয়োজন হয়।

মাচা দেওয়া : সব রকমের ফসলই মাটির ওপরে মুক্তভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। বিশেষ করে লতানো সবজি ফসল। এসব ফসল মাটিতে থাকলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়, গাছ পচা যেতে পারে, ফলনও কমে যায়। এসব গাছ মাটির ওপরে কোনো অবলম্বন পেলে তাতে খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে। তাই লতানো প্রকৃতির সবজি চাষাবাদ করতে হলে গাছের শাখা-প্রশাখা বিস্তারের জন্য বাঁশ, কঞ্চি, পাটকাঠি, ধৈঞ্চা ইত্যাদি দিয়ে মাচা তৈরি করে দিতে হয়। বিশেষ করে কুমড়াজাতীয় ফসল, করলা, পটল, শসা প্রভৃতির ক্ষেত্রে মাচা দেওয়ার প্রয়োজন হয়।

ছাঁটাইকরণ : গুণগত মানসম্পন্ন সবজি ফল পাওয়ার জন্য অনেক সময় ছাঁটাইকরণের প্রয়োজন হয়। ফলজাতীয় ফসলের অঙ্গজ অংশ খুব বেশি বৃদ্ধি পেলে গাছ উপযুক্ত পরিমাণে ফলন দিতে ব্যর্থ হয়। তাই গাছের দৈহিক বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ ও ফলায়নকে উৎসাহিত করার জন্য অতিরিক্ত শাখা-প্রশাখা অঙ্গজ বৃদ্ধির সময়েই কেটে দিতে হয়। এ ছাড়া রোগ ও পোকা আক্রান্ত ডালপালা, লতাপাতা কেটে গাছ ছাঁটাই করে দিতে হয়। ফলে গাছে ফুল ও ফল বেশি হয় ও ফলন বৃদ্ধি পায়। ঝিঙা ও ধুন্দুল চারার অগ্রভাগ ছাঁটাই করলে তা আগাম শাখা বিস্তার করে।

পরাগায়নকরণ : কুমড়া পরিবারের অধিকাংশ সবজির ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, গাছে স্ত্রী ফুল ফোটার কিছুদিন পর ফল পচে যায় বা ঝরে যায়। পোকা ও মৌমাছির অনুপস্থিতিতে পরাগায়ন না হওয়ার ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাই কৃত্রিম উপায়ে এসব ফসলের পরাগায়ন করা দরকার। ফল ধারণের জন্য হাত দিয়ে ফলের পরাগায়ন করতে হয়। সকালের অথবা বিকালের দিকে একটি সদ্য ফোটা পুরুষ ফুল নিয়ে ফলের পুংকেশর ঠিক রেখে পাঁপড়িগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হয়। তৎপর ওই পুংকেশর দিয়ে স্ত্রী ফুলের গর্ভকেশরের উপর কোমল হাতে ২-৩ বার ছুঁয়ে দিলেই পরাগায়নের কাজ হয়। এভাবে একটি পুরুষ ফুল দিয়ে ৮-১০টি স্ত্রী ফুলের পরাগায়ন করা যায়। কৃত্রিম পরাগায়নের ফলে গাছে ফল ধারণের পরিমাণ বেড়ে যায়।

ফল পাতলাকরণ : অনেক সময় পেঁপে, টমেটো এবং অন্যান্য গাছে বা থোকায় ছোট বড় অনেক ফল ধরে। পুষ্টির অভাবে সবগুলো ফল যথাযথভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে না। এগুলো আকারে ছোট থাকে, বিকৃতরূপ ধারণ করে এবং নিম্নমানের হয়। ছোট ফলগুলো ছোট অবস্থাতেই তুলে ফেলে দিয়ে সতেজ ও আকর্ষণীয় ফলগুলোকে রেখে দিলে ওইগুলো আরও বড় হয়। রোগাক্রান্ত, বিকৃত ও ক্ষুদ্রাকৃতির ফল পাতলা করে দিতে হবে।

পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা : রোগবালাই ও পোকামাকড় ফসলের চরম শত্রম্ন। রোগবালাইয়ের হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে না পারলে ফসলের বৃদ্ধি থেমে যায় এবং পরিমাণে ফলনও কম হয়। অনেক সময় ফসল পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়। ভালো ফলন পেতে হলে ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করা দরকার।

লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে