সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে কৃষি সেবা

মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব
ডক্টর মো. নূরুল হুদা আল মামুন
  ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলায় ভাংনামারির চর এলাকার ভুলু মিয়া বেশ কয়েক বছর ধরে মাটি পরীক্ষা করে ফসলের জমিতে সার দেন। তিনি বলেন, 'আগে জমিতে এলাকার অন্যান্যের মতো অনুমান কইরা অনেক সার দিতাম। কতেক সার আদৌ দিতাম না। এতে ভালো ফলন পাইতাম না। অহন ভ্রাম্যমাণ মাটির গবেষোণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা কইরা সার দেই। এতে আগে চাইতে খরচ কম লাগে আবার অনেক ফলন পাই'।

ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার একজন আদর্শ কৃষক আব্দুল ওয়াদুদ মিয়া। তিনি বিগত প্রায় ১৫ বছর ধরে মাটি পরীক্ষা করে সার দেন। তিনি বলেন, 'আমি ফরিদপুর মৃত্তিকা গবেষণাগারে গিয়ে ও ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা কইরা দানা পেঁয়াজ, ধানের জমিতে স্যারদের পরামর্শে সার দিয়ে আমি ভালো লাভবান হয়েছি'।

জামালপুর জেলার চর যথার্থপুর গ্রামের আদর আলী বিগত কয়েক বছর ধরে মাটি পরীক্ষা করে সার দেন। তিনি বলেন, 'আমাদের চর যথার্থপুর গ্রামে প্রচুর সবজি চাষ হয়। আমাদের এলাকা কেউ মাটি পরীক্ষার বিষয় জানত না, পরে জামালপুর গবেষণাগার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে সবজি চাষ করি। আমরা কম সার দিয়ে ভালো ফলন পাচ্ছি'।

ভুলু মিয়া, আদর আলী আর ওয়াদুদ মিয়ার মতো অনেক স্মার্ট চাষি এখন নিয়মিত মাটি পরীক্ষা করে ফসল আবাদ করেন। এমন সফলতার গল্প এখন সারাদেশের কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ স্থায়ী মৃত্তিকা গবেষণাগার আবার কেউ ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করছেন। আসুন এ সফলতার পেছনের রহস্যটা জেনে নেওয়া যাক।

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাবার প্রয়োজন তেমনি সব গাছেরও খাবারের প্রয়োজন হয়। আমরা জানি, যে কোনো ফসলের জীবনচক্রে (বীজ থেকে বীজ) উদ্ভিদের যেসব খাদ্যোপাদানের দরকার হয় তার মধ্যে ১৭টা খাদ্যোপাদান অত্যন্ত জরুরি। যদিও ১৭টি খাদ্যোপাদানের বাইরে আরো অনেক উপাদান আছে, তবে সেগুলো বিশেষভাবে জরুরি নয়। ১৭টি খাদ্যোপাদানের মধ্যে মাত্র ৩টি খাদ্য প্রকৃতি থেকে উদ্ভিদ পেয়ে থাকে। গাছ আলোর উপস্থিতিতে বায়ুমন্ডল থেকে কার্বন ও অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং পানির মাধ্যমে হাইড্রোজেন নিয়ে নিজের খাবার নিজে তৈরি করে। গাছের বৃদ্ধি ও জীবন চক্রের উন্নতি অর্থাৎ ফুল ফলের মাধ্যমে পরিসমাপ্তির জন্য আরো ১৪টি পুষ্টি উপাদান আবশ্যক- যা শিকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। এগুলোর মধ্যে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, সালফার, ম্যাগনেসিয়ামকে ম্যাক্রো খাদ্য উপাদান বলা হয়। এ ছাড়া অনুখাদ্য হিসেবে লোহা, বোরন, ক্লোরিন, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, তামা, মলিবডেনাম, নিকেল ইত্যাদিও উদ্ভিদ মাটির থেকে খনিজ লবণের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে।

আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে মাটিতে মৌলিক উপাদানের ঘাটতি দেখা যায়। বাংলাদেশের মাটিতে নাইট্রোজেনের ঘাটতি দেখা দেয় ১৯৫১ সালে। এরপর ১৯৫৭ সাল থেকে ঘাটতির তালিকায় নাইট্রোজেনের সঙ্গে ফসফরাস যুক্ত হয়। এ তালিকায় পটাশিয়াম যুক্ত হয় ১৯৬০ সালের দিকে। ১৯৮০ সাল থেকে সালফারের ঘাটতি দেখা দেয়। ১৯৮২ সাল থেকে জিঙ্ক ঘাটতি তালিকায় যুক্ত হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে বোরণ ঘাটতি দেখা দেয়। এখন আটটি মৌলিক পদার্থ যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, জিঙ্ক, বোরণ, ম্যাগনেশিয়াম এবং মলিবডেনামের ঘাটতি নিয়ে চলছে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন। এখন যেভাবে চলছে এ ভাবে কৃত্রিম সার নির্ভর কৃষি উৎপাদন পরিচালিত হলে অদূর ভবিষ্যতে অন্তত ১৭টি মৌলিক পুষ্টি উপাদান তথা সার প্রয়োগ করে এ দেশে ফসল উৎপাদন করতে হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। একজন কৃষক বহু বছর ধরে চাষ করছেন, বছরের পর বছর একটার পর একটা ফসলের চাষ করছেন, ফলে জমি বিশ্রাম পাচ্ছে না। প্রতিটি চাষের সময় নানা রকমের রাসায়নিক সারের ব্যবহার করছেন।

মাটি পরীক্ষার গুরুত্ব: যে মাটিকে কেন্দ্র করে চাষাবাদ করা হচ্ছে তার স্বাস্থ্যের খবর রাখছেন না অনেকেই। এর জন্য দরকার নিয়মিত কৃষি জমির মাটি পরীক্ষা করা। মাটি পরীক্ষা করলে জানা যাবে কী কী খাদ্যোপাদান কী পরিমাণে আছে। কৃষক ফসল অনুযায়ী তার প্রয়োজনীয় মাত্রায় সারের ব্যবহার করেছেন, মাটি পরীক্ষার পর জানা যায় বেশ কিছু সারের অপব্যবহার হয়েছে। তাই প্রত্যেকটি জমির বছরে অন্তত একবার মাটি পরীক্ষা করতে হবে। সম্ভব না হলে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ বছর পরপর মাটি পরীক্ষা করা উচিত। এর ফলে শুধু সারের অপব্যবহারই কমবে তাই নয়, সেইসঙ্গে বেশি মাত্রায় বারবার সারের ব্যবহারে জমিতে সেইসব খাদ্যগুণ জমে অন্য খাদ্যকেও অগ্রহণযোগ্য করে দেয়। মাটিতে বিষাক্ততা তৈরি হয়। বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সারের ব্যবহারে মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুর সংখ্যাও কমতে থাকে ফলে ফসলের ফলন কমে যায় এবং মাটি মৃত হয়ে যায়, যেমন মরুভূমির মাটিকে মৃত মাটি ধরা হয়। মাটি পরীক্ষা করে মাটির স্বাস্থ্য জানার পর সুষম সার ব্যবহার করলে শুধু যে অথের্র সাশ্রয় হবে তা নয়, মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, পরিবেশ ভালো থাকবে। যখন জানা যাবে মাটিতে জৈব পদার্থের উপস্থিতি তলানিতে নেমেছে, তখন মাটি ও ফসল বাঁচাতে কৃষক উঠে পড়ে লাগলেও মাটির স্বাস্থ্য পুনুরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়বে। এছাড়া মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন খরচ শতকরা ১৫ থেকে ২৫ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। এসব কারণে মাটি পরীক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প উপায় নেই।

কোথায় মাটি পরীক্ষা করা যায়: প্রধানত মাটির পরিমাণ, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, বোরন ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। বাংলাদেশে দুই ধরনের গবেষণাগারে মাটি পরীক্ষা করা হয়। স্থায়ী গবেষণাগার এবং ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে সার সুপারিশ কার্ড দেওয়া হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ৭টি বিভাগীয় গবেষণাগার, ১৬টি আঞ্চলিক গবেষণাগার রয়েছে। বিভাগীয় এসব গবেষণাগার ঢাকা, কুমিলস্না, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর এবং বরিশাল অবস্থিত। আঞ্চলিক গবেষণাগারগুলো ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাংগাইল, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, যশোর, কুমিলস্না, নোয়াখালী, রাঙ্গামাটি এবং পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত। এসব স্থায়ী গবেষণাগারের মাধ্যমে বছরের যে কোনো সময়ে ৬৩ টাকার বিনিময়ে মাটির প্রায় সব উপাদান পরীক্ষা করা যায়।

এছাড়া জনগণের দোরগোড়ায় কৃষক সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে এবং মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে ১৯৯৬ সাল থেকে ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষা গবেষণাগার চালু করা হয়। বর্তমানে দেশব্যাপী যমুনা, তিতাস, তিস্তা, রূপসা, মধুমতি, কর্ণফুলী, বহ্মপুত্র, সুরমা, করতোয়া এবং কীর্তনখোলা নামে ১০টি ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষা গবেষণাগার চালু রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ এসব পরীক্ষাগারের মাধ্যমে বছরের রবি ও খরিপ এই দুই মৌসুমে সরজমিনে মাটি পরীক্ষা করে সার সুপারিশ কার্ড প্রদান করা হয়। এ সময় এসব ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগার থেকে নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (সাধারণত ৩-৫ দিন) অবস্থান করে এবং মাটি পরীক্ষা করে ফসলের সুষম মাত্রার সার সুপারিশ কার্ড প্রদান করা হয়। এসব উপজেলার আগ্রহী কৃষকরা নমুনাপ্রতি মাত্র ২৫ টাকা হারে নির্ধারিত ফি প্রদান করে (যদিও মৃত্তিকা নমুনা বিশ্লেষণের প্রকৃত খরচ ৪৪০ টাকা মাত্র) মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সুষম মাত্রার সার সুপারিশ কার্ড নিতে পারেন। মাটি পরীক্ষার জন্য সঠিক নিয়মে মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ করে উপজেলা কৃষি অফিসে জমা দিতে হয়। সংগৃহীত ওই মৃত্তিকা নমুনা মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে সার সুপারিশ কার্ড প্রণয়ন ও বিতরণ করে থাকেন।

\হলেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক গবেষণাগার, ফরিদপুর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে