সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর রসের ঐতিহ্য

কিছুদিন আগেও হেমন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গাছ কাটার প্রাথমিক কাজগুলো করার হিড়িক পড়ত। গায়ের পথে-ঘাটে, নদী বা পুকুরপাড়ে, বড় রাস্তার দুধারে বা খেতের আল ঘেঁষে শত শত গাছের শীর্ষভাগ বিশেষভাবে কাটতেন গাছিরা। ১৫-১৬টি পাতা রেখে গাছের উপরিভাগের বাকলসহ অপ্রয়োজনীয় অংশ পরিষ্কার করতেন। আড়াআড়িভাবে বাঁধা বাঁশের দন্ডে দাঁড়িয়ে কোমরে ও গাছে রশি পেঁচিয়ে ধারালো দা দিয়ে গাছিদের গাছ চাঁছা বা কাটার দারুণ দৃশ্য এখন তেমন চোখে পড়ে না
ইমরান ছিদ্দিকি
  ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

শীতের মৌসুম এলেই এক সময়ে গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে খেজুরের রস দিয়ে ফিরনি, পায়েস, রসের গুড়ের ভাপা পিঠা, রস পিঠা এবং গাড় রস তৈরি করে মুড়ি, চিড়া, খই ও চিতই পিঠাসহ হরেক রকম পিঠাপুলির মহোৎসব চলত। গ্রামের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে আত্মীয়স্বজন এবং জামাই-মেয়েদের দাওয়াত করে পিঠা খাওয়ানো হতো। কিন্তু গ্রামে সেই ঐতিহ্য আজ দেখা যায় না।

সুমিষ্ট খেজুরের রস পছন্দ করে না এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে মিষ্টি রোদে মধুবৃক্ষ থেকে আহরণ এক গস্নাস সুমিষ্ট খেজুরের রস মানুষকে সতেজ করে তোলে। আবার এই রস জ্বাল দিয়ে খেতে দারুণ সুস্বাদু। এই ছবি বলে দেয় এটি একটি শীতের সকাল। খুব ভোরে গাছ থেকে রস পাড়ে গাছিরা। এটিই বাঙালির ঐতিহ্য।

খেজুরগাছ, শীতের সঙ্গে রয়েছে যার নিবিড় সম্পর্ক। শীতকালে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুরগাছ থেকে পাওয়া যায় সুমিষ্ট রস, গুড়। ফল হিসেবেও খেজুরের জুড়ি নেই। শীতের মিষ্টি রোদে খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ি খেতে কে না ভালোবাসে। কিন্তু বর্তমানে খেজুর গাছের কদর নেই। এ গাছকে ঝোপঝাড়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কোথাও-বা ইটভাটার উৎকৃষ্ট জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শীতকালে গাছিরা আর যান না তার কাছে। দা-কাঁচি, একগাছি রশি, একদন্ড বাঁশ ও কোমরে ঝোলানো লম্বা-গোল আকৃতির বিশেষ পাত্র (ঠুঙ্গি) নিয়ে গাছে উঠতে দেখা যায় না গাছিদের। শীতের প্রতু্যষে কাঁধে ভার চেপে ঝুলন্ত কলস নিয়ে ছেঁড়া স্যান্ডেলে তাদের ছুটতে দেখা যায় না, হাল আমলে।

কিছুদিন আগেও হেমন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গাছ কাটার প্রাথমিক কাজগুলো করার হিড়িক পড়ত। গায়ের পথে-ঘাটে, নদী বা পুকুরপাড়ে, বড় রাস্তার দুধারে বা খেতের আল ঘেঁষে শত শত গাছের শীর্ষভাগ বিশেষভাবে কাটতেন গাছিরা। ১৫-১৬টি পাতা রেখে গাছের উপরিভাগের বাকলসহ অপ্রয়োজনীয় অংশ পরিষ্কার করতেন। আড়াআড়িভাবে বাঁধা বাঁশের দন্ডে দাঁড়িয়ে কোমরে ও গাছে রশি পেঁচিয়ে ধারালো দা দিয়ে গাছিদের গাছ চাঁছা বা কাটার দারুণ দৃশ্য এখন তেমন চোখে পড়ে না।

দুর্লভ এ ছবি কেবল বইয়ের পাতায়ই শোভা পাচ্ছে। খেজুরের রস ও গুড় দিয়ে দেখা যায় না মা-চাচিদের রসের বা ভাপা-পুলিপিঠা বানাতে। বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলা খেজুরগাছের জন্য সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরেও উলেস্নখযোগ্য খেজুরগাছ জন্মে। দেশের অন্যান্য জায়গাতেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক খেজুরগাছ। হারানো এ ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে সরকারি উদ্যোগ জরুরি। গাছিদের গাছ কাটার সরঞ্জাম, পোশাক, প্রণোদনা ইত্যাদি প্রদান করার মাধ্যমে তাদের এ কাজে উৎসাহিত করতে হবে, ব্যবস্থা করতে হবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের।

সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে কৃষকদেরও। তাদের উচিত হবে গাছিদের মজুরি বাড়িয়ে দেওয়া। খেজুরগাছ থেকে উৎপাদিত রস ও গুড়ের উপযুক্ত মূল্য দিতে হবে। বন বিভাগ স্বল্প ব্যয়ে রাস্তার পাশে বা ডিভাইডারে বনায়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে হাজার হাজার খেজুরগাছ রোপণ করতে পারে। রক্ষণাবেক্ষণ এবং রস আহরণের জন্য স্থায়ীভাবে গাছি নিয়োগ দিতে পারে তারা। এতে রাস্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে এবং সুযোগ সৃষ্টি হবে অনেক দরিদ্র গাছির কর্ম-সংস্থানেরও।

আগের মতো গ্রাম্য রাস্তার দুপাশে সারি সারি খেজুর গাছ আর নেই। গ্রামের রাস্তাগুলো সংস্কার করার কারণে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। নতুন করে খেজুর গাছ রোপণে মানুষের আগ্রহের অভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও খেজুরের রস ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনো রাস্তার আশপাশে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু খেজুর গাছ। আর রস আহরণে এখনো গ্রাম্য রীতিতেই ঝুঁকি নিয়ে কোমরে রশি বেঁধে শীতের সাত সকালে ছোট-বড় মাটির হাঁড়ি গাছে বেঁধে তা থেকে রস সংগ্রহ করছেন গাছিরা। আগে তারা এই কাঁচা রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাটবাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। আবার কেউ কেউ সকালে রস জ্বাল দিয়ে গুড়-মিঠাই তৈরি করত। প্রতি বছর এই মৌসুমে খেজুর গাছের রস ও গুড় বিক্রি করে দু'টাকা বাড়তি আয় করত তারা। তবে কিছু খেজরের গুড়চাষি এখনো ধরে রেখেছে এই ঐতিহ্যকে।

রাজশাহী জেলায়, দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায় খেজুরের গাছ অনেক কমে গিয়েছে। আব্দুর রহমান এক সময় গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিক্রি করতেন খেজুরের রস। কিন্তু সেই কাজ আর করতে পারে না, বয়সের ভারে। গাছি আব্দুর রহমান বলেন, রাস্তাগুলো সংস্কার হওয়ার কারণে খেজুর গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে এবং ক্ষেতের জমিগুলোতে আম গাছ লাগানোর কারণে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। নতুন করে আর কেউ গাছ লাগাচ্ছে না। খেজুরের রস ক্রেতা জামান হৃদয় বলেন, 'আসলেই খেজুর রসের স্বাদ ভোলার মতো নয়। তৃপ্তিভরে খেজুরের রস খেলাম, বেশ ভালো লাগছে। কিন্তু সচরাচর খেজুরের রস পাওয়া যায় না, সরকারিভাবে এসব গাছ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া দরকার'। দুর্গাপুর উপজেলায় আগে অনেকেই শীত মৌসুমে খেজুরের রস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু এখন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন আর সম্ভব নয়।

খেজুর গাছের রস ও গুড় আমাদের সংস্কৃতির একটি বিশেষ অংশ। শীতের সকালে খেজুরের রস, রসের পিঠা, গুড়-মুড়ি আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য। রাজধানীর ডেমরায় গত কয়েক বছর আগেও শত শত খেজুর গাছ ছিল। ওইসব গাছ থেকে শীতকালে যত খেজুরের রস সংগ্রহ হতো তা দিয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে তৈরি হতো খেজুরের গুড়- যা এখন আর হচ্ছে না। ফলে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে নকল গুড়ে। এখন এসব গুড়েই তৈরি হচ্ছে পিঠা-পুলিসহ অন্যান্য মিষ্টান্ন। গাছি সংকট, অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও নগরায়ণের প্রতিযোগিতায় ক্রমেই এখানে হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর গাছ। এসবের মধ্যেও ৪০ বছর ধরে ফরিদপুর থেকে এসে এখনো রস সংগ্রহ করেন আমীন সরদার। এলাকাবাসীর রসের পিপাসা মিটিয়ে চলেছেন তিনি।

শীতকালে গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের হাতে বানানো হরেক রকমের পিঠা-পুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। আর পিঠা তৈরির অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে খেজুরের রস। সেজন্য তীব্র শীতের মাঝেও রস সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত থাকেন গাছিরা। কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে ক্রমবর্ধমান মানুষের বাড়িঘর নির্মাণ আর নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে ক্রমেই খেজুরগাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যার ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুরের রস। সরজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন জায়গায় মানুষের ঘরবাড়ি নির্মাণ আর নির্বিচারে গাছ কাটার সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে, খেজুরের গাছের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেকটাই কমে যাচ্ছে। পূর্বেও শীতকালে এসব এলাকার গাছিরা খেজুরগাছের রস সংগ্রহে খুবই ব্যস্ত সময় কাটাতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে তা ক্রমশ বিলুপ্ত হতে বসেছে। খেজুর রস দিয়ে শীত মৌসুমে পিঠা ও পায়েস তৈরির প্রচলন থাকলেও শীতকালীন খেজুরগাছের রস এখন পাওয়া দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে।

অনেকে শখের বশে খেজুরগাছকে মধুবৃক্ষ বলে থাকতেন। ওই সময় শীতের মৌসুমে খেজুর রসের নলেন গুড়ের মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠতো গ্রামীণ জনপদ। খেজুর রস দিয়ে গৃহবধূদের সুস্বাদু পায়েস, বিভিন্ন ধরনের রসে ভেজানো পিঠা তৈরির ধুম পড়ত। রসনা তৃপ্তিতে খেজুরের নলেন গুড়ের পাটালির কোনো জুড়ি ছিল না। গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষ শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁপতে কাঁপতে ঠান্ডা খেজুর রস না খেলে যেন দিনটাই মাটি হয়ে যেত।

বর্তমানে যে হারে খেজুরগাছ হারিয়ে যেতে বসেছে, হয়তো এক সময় আমাদের এলাকা থেকে খেজুরগাছ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চাইলে আমাদের সবার উচিত তালগাছের মতো বেশি করে খেজুরগাছ লাগানো এবং তা যত্ন সহকারে বড় করা। যদি আমরা আমাদের এই হাজার বছরের ঐতিহ্যকে আগামী প্রজন্মের জন্য ধরে রাখতে চাই তাহলে এই কাজে আমাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে