সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মসংস্থান ও রপ্তানিতে সম্ভাবনাময় খাত মধু

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি মধু রপ্তানি হয়। বিসিক সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপে বাংলাদেশের মধু বিপণনের লক্ষ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ স্স্নোভেনিয়ার ঐতিহ্যবাহী মধু উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান মেডেক্সের সঙ্গে বিসিকের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। বিশ্বের বৃহত্তম মধু রপ্তানিকারক দেশটির নাম চীন। মধু রপ্তানিকারক অন্য দেশগুলো- আর্জেন্টিনা, নিউজিল্যান্ড, মেক্সিকো। সবচেয়ে বেশি মধু আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে-ভারত, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জাপান। নতুন বাজার সৃষ্টি হওয়ায় বাংলাদেশের মধু এখন বিশ্বের বেশ কিছু দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশের কয়েকটি কোম্পানি ২০১৪ সাল থেকে ভারতে ও জাপানে মধু রপ্তানি করছে।
সাজ্জাদ হোসেন
  ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

মানুষ এখন নিয়মিত মধু খাচ্ছে। বেচাবিক্রি অনেক ভালো। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রায় প্রত্যেক ঋতুতে কোনো না কোনো ফুল ফোটে। আর এসব ফুল থেকে মধু আহরণের বিরাট সুযোগ রয়েছে। একটা সময় মধু আহরণ ছিল শুধু সুন্দরবনকেন্দ্রিক। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে মধু উৎপাদন ও ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণে। এখন মধু চাষ হয় ব্যাপকভাবে। দেশে মধুর উৎপাদন ও বহুমাত্রিক ব্যবহার বেড়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে মধু এখন রপ্তানি পণ্য তালিকায় নাম লিখিয়েছে। দেশের মৌ চাষিরা রপ্তানির জন্য বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষ করছেন। দেশে এখন সাত হাজার চাষি দুই হাজার মৌ খামারে বছরে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টন মধুর জোগান দিচ্ছে।

ফসলের মাঠে মৌমাছি বিচরণ করলে সেখানে বাড়তি পরাগায়নের কারণে ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। মৌচাষের মাধ্যমে মধু আহরণে সমৃদ্ধি ও শস্য বা মধুভিত্তিক কৃষিজ উৎপাদন বাড়ে। মৌসুমে সরিষা, ধনিয়া, তিল, কালিজিরা, লিচুসহ আবাদ হয় মোট প্রায় ৭ লাখ হেক্টর জমিতে বা বাগানে। এর মাত্র ১০ শতাংশ জায়গায় মৌ বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করা হচ্ছে। প্রায় ২৫ হাজার মৌ চাষিসহ মধু শিল্পে জড়িত প্রায় ২ লাখ মানুষ। দেশে মধুর বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ১০ হাজার টন। ফসলের এই পুরো সেক্টরটিকে মধু আহরণের আওতায় আনতে পারলে ফসলের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি হবে। দেশে এখন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়। পুরো সরিষার মাঠ মধু সংগ্রহের আওতায় আনা গেলে উৎপাদন যেমন বাড়বে তেমনি ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত প্রযুক্তি ও মৌ চাষির সংখ্যা বাড়ালে মধুর উৎপাদন বছরে ১ লাখ টন উৎপাদন সম্ভব। সুন্দরবনের মধু আহরণ ছাড়া সরিষা ফুল থেকে সবচেয়ে বেশি মধু সংগ্রহ করা হলেও লিচু, কালোজিরা, মুহরি, ধনিয়া, তিসিসহ বিভিন্ন ফুলের মধুও সংগ্রহ করেন মৌ চাষিরা। মৌ চাষে বাড়ছে জনপ্রিয়তা ও সম্ভাবনা বাংলাদেশের মধু একটি সম্ভাবনাময় অর্থকরী খাত। দেশে বর্তমানে দুই প্রজাতির মৌমাছির দ্বারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌ বাক্সে চাষ করা হয়। মৌ চাষ বিশেষজ্ঞ ও কৃষি গবেষকদের মতে, ফসলের মাঠে মৌমাছি বিচরণ করলে সেখানে বাড়তি পরাগায়নের কারণে ফসলের উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়বে। তার মানে মৌ চাষের মাধ্যমে মধু আহরণে লাভ দুটি- অর্থকরী খাত হিসেবে মধু আহরণে সমৃদ্ধি ও শস্য বা মধুভিত্তিক কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি। অথচ অধিকাংশ কৃষকের এ বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেই।

কৃষি উৎপাদন বাড়াতে চাষি পর্যায়ে এ ধারণা ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। সুন্দরবনের পাশাপাশি পেশাদার মৌ চাষিরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৌসুমে মৌসুমে সরিষা, ধনিয়া, তিল, কালোজিরা, লিচু এসব ফসলের জমিতে বা বাগানে মৌ বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করে। আধুনিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে মৌ চাষ করে শত শত টন মধু উৎপাদন করা হচ্ছে। এর ফলে মধু আহরিত শস্য যেমন সরিষা, তিল, কালোজিরা, লিচু ইত্যাদির ফলনও বেড়েছে অনেক গুণ। মৌ চাষিরা বিভিন্ন ঋতুতে তাদের মৌ বাক্সে নিয়ে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, সাভার, দিনাজপুর, রাজশাহী, বরগুনা ও সুন্দরবনের সাতক্ষীরায় মধু সংগ্রহে চলে যান। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেখানে তারা অবস্থান করেন এবং মধু সংগ্রহ করে ফিরে আসেন। সংগ্রহকারীর কেউ কেউ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে মধু বিক্রি করেন। বড় খামারিরা সংগ্রহীত মধু প্রসেসিং পস্ন্যান্টে পরিশোধন করে বাজারজাত করেন। সরিষা, লিচু, তিল ও কালোজিরা ফুল থেকে সংগৃহীত মধু আলাদা আলাদাভাবে বাজারজাত করছেন ব্যবসায়ীরা।

দেশের মধু বিদেশে যাচ্ছে বিশ্ব বাজারে মধুবাণিজ্য এখন বেশ জমজমাট। বাংলাদেশেও মধুর জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দেশি উদ্যোক্তারা মধু উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত মধুর ব্যবসা দেশের বাজারে দ্রম্নত প্রসার লাভ করছে। কিন্তু বিস্ময়ের খবর হলো- ঢাকা ও বিদেশের বাজারে বেশি বিক্রি হওয়া ভারতের ডাবর ব্র্যান্ডের 'ডাবর হানি' মধু কিনে নেয় বাংলাদেশ থেকে। তার মানে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডেড কোম্পানিগুলোর সামনে অনেক সম্ভাবনা আছে এই মধু শিল্পকে কেন্দ্র করে। দেশে উৎপাদন বাড়ার ফলে মধু রপ্তানির বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে ৫৫০ টন বা ৫৫ কোটি টাকার মধু ভারত, আরব আমিরাত ও অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়েছে। আগামীতে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে রপ্তানি হবে শত কোটি টাকার মধু।

জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি মধু রপ্তানি হয়। বিসিক সূত্রে জানা

গেছে,

\হইউরোপে

\হবাংলাদেশের মধু বিপণনের লক্ষ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ স্স্নোভেনিয়ার ঐতিহ্যবাহী মধু উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান মেডেক্সের সঙ্গে বিসিকের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। বিশ্বের বৃহত্তম মধু রপ্তানিকারক দেশটির নাম চীন। মধু রপ্তানিকারক অন্য দেশগুলো- আর্জেন্টিনা, নিউজিল্যান্ড, মেক্সিকো। সবচেয়ে বেশি মধু আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে-ভারত, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জাপান। নতুন বাজার সৃষ্টি হওয়ায় বাংলাদেশের মধু এখন বিশ্বের বেশ কিছু দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশের কয়েকটি কোম্পানি ২০১৪ সাল থেকে ভারতে ও জাপানে মধু রপ্তানি করছে। বাংলাদেশের মধু চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এখন চেষ্টা চলছে ইউরোপে রপ্তানির। বিসিএসআইআরের ল্যাবরেটরিতে বাংলাদেশি মধু পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আমাদের দেশের মধুর গুণগত মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্ভাবনা কাজে লাগালে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ১ থেকে দেড় লাখ টন মধু বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। মৌচাষের বিষয়টি স্বল্পশ্রম ও স্বল্প পুঁজির বিনিয়োগের তুলনায় অধিক মুনাফা লাভের সম্ভাবনাময় পেশা ও ব্যবসা হিসেবে জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। তবে আমাদের সম্ভাবনার সর্বোচ্চ অংশটুকু নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও মৌ চাষ ও বিপণনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজনীয় রয়েছে। এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মোট ৩০ শতাংশ নারী জড়িত। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে চাই কৃষিসহ ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে সুউচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন। কৃষিকে প্রকৃত বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করতে হবে, এর জন্য বাজারজাত বিপণন ও রপ্তানি অপরিহার্য। জাপান আমাদের দেশ থেকে মধু রপ্তানি করে, তাহলে সে দেশে আরও অনেক কিছু রপ্তানি করা যাবে সেগুলো বের করতে হবে। আমাদের প্রক্রিয়াজাত ও দেশীয় ব্রান্ড না থাকায় কাঁচা মধুও রপ্তানি করতে হচ্ছে। মৌমাছি প্রকৃতির বন্ধু। পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে মৌমাছির বিভিন্ন প্রজাতি আজ বিপন্ন প্রায়। তাই প্রকৃতির সুরক্ষায় সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। বিশ্ববাজারে মধুবাণিজ্য এখন বেশ জমজমাট। দেশেও মধুর জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে দেশি উদ্যোক্তারা মধু উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। দেশে উৎপাদন বাড়ার ফলে মধু রপ্তানির বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছে।

দেশে মধু চাষের অপার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে সুজলা সুফলা ষড়ঋতুর বাংলাদেশে- যার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আছে ফসলের মাঠ, বৃক্ষরাজি, সবজি ও ফলবাগান। এখানে প্রায় প্রত্যেক

\হএলাকাতেই কোনো না কোনো ফুল ফোটে। এসব জায়গা থেকে মৌমাছি প্রায় সারা বছরই মধু আহরণ করতে পারে। বর্তমানে প্রায় ২৫০০ জন মৌ চাষি বাণিজ্যিকভাবে মধু উৎপাদন করছে এবং বছরে প্রায় ৬ হাজার টন মধু উৎপাদিত হচ্ছে। যথাযথ পরিকল্পনা ও আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে মধুর উৎপাদন এক লাখ টনে উন্নীত করা সম্ভব। বাণিজ্যিকভাবে মৌমাছি চাষের মাধ্যমে আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে এবং মৌ কলোনি ফসলের পরাগায়নে ব্যবহার করে ফসলের অধিক ফলনপ্রাপ্তি সম্ভব। মৌ কলোনির উপজাত মানুষের পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। তাছাড়া ওষুধ ও নানা শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার এবং বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের মৌ খামার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করছে। দেশে প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে মৌ খামার ব্যাপকতা লাভ করলে দেশে গুণগত মানের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিতে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে এবং সেই সঙ্গে মৌ কলোনির উপজাত এবং সেসব থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে