সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি উৎপাদনে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে

গত চার দশকে দেশে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে প্রায় শতভাগ। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচ, এমনকি দৈনন্দিন কাজেও ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মানুষ। এখন সুপেয় ও চাষাবাদের জন্য চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পানিই মেটাতে হচ্ছে ভূ-গর্ভ থেকে।
ডক্টর এম এ হোসেন
  ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

পানির অভাবে- বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে, গৃহস্থালি, খামার ও শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পানি জোগাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। পানির অপরিকল্পিত ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর খালি হচ্ছে তা কিন্তু নয়, এর সঙ্গে দূষণের একটি সম্পর্কও রয়েছে। পানি দূষণের হার ও কারণ যখন দুটোই বেড়েছে, তখন পানি নিয়ে ভাবনা কিন্তু আমাদের বাড়াতেই হবে। দিনের পর দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী, খাল-বিল, পুকুর শুকিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন দেশের জনসংখ্যা দ্রম্নত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ও তাদের বহুমাত্রিক ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে পুকুর, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে কৃষি জমিতে সেচ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারছে না কৃষকরা।

দেশের কৃষি উন্নয়ন ব্যবস্থা সেচব্যবস্থার ৮০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। ভূগর্ভস্থ পানি হতে প্রতি বছর প্রায় ৩০ দশমিক ২১ ঘন কিলোমিটার পানি উত্তোলন করা হয়। যার মধ্যে প্রায় ৮৬ শতাংশই ব্যবহার করা হয় সেচ কাজে। প্রতি বছর অধিক পরিমাণ উত্তোলনের ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খরা মৌসুমে গভীর ও অগভীর নলকূপগুলোতে পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। অত্যাধিক উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামলে থাকলে ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে সুপেয় পানির উৎস। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে কৃষি ও শিল্প খাতে। এছাড়া আশঙ্কা আছে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের। জাতিসংঘের চালানো সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা হতে দেখা যায়, অধিক পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১০টি দেশ স্থান পেয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।

সেচের পানির জন্য কৃষকদের ফসল ফলাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এছাড়াও খাস পুকুর-জলাশয় ভরাট হয়ে গেলে স্থানীয় প্রভাবশালীরা তা দখলে নিয়ে নিচ্ছে বলেও অনেকের অভিযোগ। ফলে বিভিন্ন থানা সদর, ইউনিয়নগুলোতে সরকারের সম্পত্তি দখলেও চলে যাচ্ছে। কোন ফসলের জন্য কী পরিমাণ পানি লাগবে তার একটি সঠিক হিসাব জানা থাকা প্রয়োজন। একটি সেচ পাম্প দিনের মধ্যে যত ইচ্ছে পানি তুলবে এটা নিয়ম হতে পারে না। অনেক সময় সেচের জন্য পাম্প থেকে জমি পর্যন্ত মাটির ড্রেন ব্যবহার করা হয়; এর ফলে ড্রেনেই অনেক পানির অপচয় হয়ে যায়। পাইপিং সিস্টেম চালু না করা গেলে এই অপচয় রোধ করা সম্ভব নয়। পানির অপচয় রোধ ও ভূগর্ভস্থ পানির যত্নে মনোযোগী হওয়ার জন্য এ বিষয়গুলো নজরে আনা প্রয়োজন। পানি জমিয়ে রাখার ব্যাপারেও কাজ করা যেতে পারে। বৃষ্টির পানি ধরে রেখে কৃষিতে ব্যবহারের পরিকল্পনাও প্রয়োজন। এছাড়াও পানির অভাবে গরিব চাষিরা কৃষিকাজে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

বিশ্বে স্বাদু পানির প্রায় ৩০ শতাংশ আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। তবে আহরণযোগ্য সাধু পানির প্রায় ৯৭ শতাংশ আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। নদী জলাশয়ে এই পানির পরিমাণ এক শতাংশেরও কম। বাদ বাকি ৬৯ শতাংশ হিমবাহ আকারে সঞ্চিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, বিশেষ করে সুপেয় পানি দিন দিন ব্যাপক হারে হ্রাস পাচ্ছে। কারণ আমরা আমাদের দৈনন্দিন প্রায় প্রতিটি কাজে প্রচুর পরিমাণ সুপেয় পানি ব্যবহার করি। দেশে বর্তমানে ওই বিষয়টি প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন যে হারে সুপেয় পানি উত্তোলন করি, কিন্তু সেই হারে গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ হয় না। এর একটি অন্যতম প্রধান কারণ দেশব্যাপী বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ওই বিষয়টি সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ মানুষের বাস তাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর পরিমাণ সুপেয় পানি প্রয়োজন। দূষণ, দখল ও বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণে রাজধানীসহ চারপাশের নদী ও জলাশয়ের পানি বর্তমানে প্রায় ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়ায়, নগরীর প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ বাসিন্দার ঘরে ও শিল্প-কারখানাসমূহের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে মাটির নিচ থেকে প্রতিদিন প্রায় ৭০ শতাংশ পানি উত্তোলন করা হয়। অবাক করার মতো বিষয় এই যে, শুধু ঢাকা ওয়াসাই প্রতিদিন প্রায় ৩৩ লাখ ঘনমিটার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর দেয়া তথ্যমতে, দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। দেশে অভ্যন্তরে বসবাসরত এ বিশাল জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন বিভিন্ন কার্যকলাপের জন্য বিপুল পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই) থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে দেখা যায়, দেশব্যাপী প্রতিদিন প্রায় ২৭ লাখ ৫০ হাজার লিটার পানি ব্যবহার হয়ে থাকে, যার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ করা হয় ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে নানা প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করে উত্তোলনের মাধ্যমে। উলেস্নখযোগ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রসমূহ হলো- খাবার পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, সেচ ও শিল্পক্ষেত্রে। দিন দিন দেশের জনসংখ্যা দ্রম্নত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ও তাদের বহুমাত্রিক ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে।

পৃথিবীর স্বাদু প্রায় ৩০ শতাংশ পানি আসে ভূগর্ভ থেকে। তবে আহরণযোগ্য ৯৭ শতাংশই আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। গ্রামে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। শহরাঞ্চলের সরবরাহও প্রধানত ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনে প্রতি বছরই পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ খাবার পানির সঙ্গে নলকূপে উঠে আসছে ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও দূষিত পদার্থ- যা পান করায় মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত অগভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করা হয়। অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে এখন বছরের একটা সময়ে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ।

গত চার দশকে দেশে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে প্রায় শতভাগ। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচ, এমনকি দৈনন্দিন কাজেও ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মানুষ। এখন সুপেয় ও চাষাবাদের জন্য চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পানিই মেটাতে হচ্ছে ভূ-গর্ভ থেকে। আর অপরিকল্পিতভাবে গভীর ও অগভীর নলকূপ দ্বারা এই পানি উত্তোলনের ফলে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়, প্রতি বছর ভূগর্ভের পানির স্তর দুই থেকে তিন মিটার করে নিচে নামছে। দেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে আশঙ্কাজনক হারে। সারা দেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামায় বিপাকে কৃষক। নদীর প্রবাহ ঠিক না করলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা। মিঠা পানির প্রধান উৎস নদী। তাই নদী প্রবাহ ঠিক না করলে মিঠা পানির চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে দেশ। জলবায়ু গবেষকরা আশঙ্কা করে বলছেন, কৃষি সেচ ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে পানির চাহিদা বাড়ছে। যা সামনে আরও তীব্র হবে। এই সংকট মোকাবিলায় ভূগর্ভের পানির বিকল্প হতে পারে সাগর, নদী ও বৃষ্টির পরিশোধিত পানি।

কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের কৃষিতে বাড়ছে গভীর নলকূপের ব্যবহার। বোরো মৌসুমে সারা দেশে প্রায় ত্রিশ লাখ পাম্প ও শেলো মেশিন ব্যবহার হয়। প্রচলিত সেচ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে প্রয়োজন প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার হাজার লিটার পানি। এতে সারা দেশেই ভূ-ভাগের পানির স্তর প্রায় ত্রিশ ফুট নিচে নেমে গেছে। কৃষি, শিল্প ও জনবসতির পানি চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভের পানি ব্যবহার চরম বিপদ ডেকে আনছে। এ থেকে বাঁচতে নদী, খাল ও জলাধার সচল করার বিকল্প নেই। তাই আন্তর্জাতিক ৫৭ নদীর প্রবাহ ঠিক করা জরুরি। দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়ার অনেক আলামতই দৃশ্যমান হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি অত্যধিক পরিমাণে উত্তোলন করা হলেও বৃষ্টির পানি যথেষ্ট পরিমাণে ভূগর্ভে প্রবেশ করতে পারছে না। তাই দ্রম্নত নামছে ভূগর্ভের পানির স্তর। পানির স্তর দক্ষিণাঞ্চলেও নামছে। সেখানে পানির এই শূন্যস্তর পূরণ করছে নোনা পানি। ফলে ভূগর্ভে নোনা পানির এই বর্ধিত উপস্থিতি ক্রমে দেশের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে, তা না হলে চরম বিপর্যয় দেখা দেবে। এ থেকে রক্ষা পেতে ভূগর্ভের পানির ব্যবহার কমাতে হবে, ভূগর্ভে পানির অনুপ্রবেশ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে এবং জলাধার ও জলাশয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে