সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

দিনাজপুরে বাড়ছে সরিষা চাষ

সরিষা শুধু ভোজ্যতেলের চাহিদাই পূরণ করে না, ভোজ্যতেলের আমদানিতে চাপ কমায়, এতে একদিকে যেমন কৃষকরা লাভবান হয় অন্যদিকে, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করে।
মো. রজব আলী
  ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে দিগন্তজুড়ে হলুদের সমারোহ, যতদূর চোখ যায় সরিষার হলুদ ফুলে ভরে উঠেছে। মাঠের পর মাঠ এখন সরিষার হলুদ ফুলে ভরা। প্রকৃতি যেন কিশোরীর হলুদ শাড়িতে সেজে বসেছে মাঠে। সরিষার ফুলে ফুলে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহের জন্য গুন গুন করছে। চলছে মধু আহরণের পালা। মৌমাছিরা মধু সংগ্রহে মাঠে নেমেছে। শীতের শিশির সিক্ত মাঠভরা সরিষা ফুলের গন্ধ বাতাসে ভাসছে। মানুষের মনকে পুলকিত করছে। সরিষার ক্ষেতগুলো দেখে মনে হয় কে যেন হলুদ চাদর বিছিয়ে রেখেছে।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ সরিষা চাষ হয়েছে, কৃষকরা বলছেন, এক সময় এ জমিতে শুধু আমন ও বোরো ধান চাষ হতো, এখন আমন ধান কেটে নিয়ে জমিতে সরিষা চাষ করছে; সরিষার ফসল তুলে নিয়ে একই জমিতে আবার বোরো রোপণ করবে। আবার অনেক কৃষক বলছেন, এক সময় যে জমিতে আলু চাষ হয়েছিল সেই জমিতেও সরিষা চাষ করছে কৃষকরা। কৃষকরা বলছেন, কয়েক বছর থেকে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে সরিষার চাহিদা ও দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে সরিষা চাষ এখন লাভজন ফসল হিসেবে পরিণত হয়েছে; এ কারণে সরিষা চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরিষা শুধু ভোজ্যতেলের চাহিদাই পূরণ করে না, ভোজ্যতেলের আমদানিতে চাপ কমায়, এতে একদিকে যেমন কৃষকরা লাভবান হয়, অন্যদিকে, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করে। যা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে।

জানা গেছে, গত বছরের তুলুনায় এ বছর সরিষা চাষ বেড়েছে একশ' হেক্টরেরও বেশি। কৃষকরা বলছেন, বাজারে দিন দিন ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সরিষার চাহিদা বাড়ছে। আমন ও বোরো চাষের মধ্য ভাগেতারা একই জমিতে বাড়তি ফসল হিসেবে সরিষা চাষ করছেন, এতে একদিকে যেমন পরিবারের ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণ হচ্ছে; অন্যদিকে, বাজারের সরিষার চাহিদা থাকায় তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। সরিষা চাষি আব্দুর রহমান বলেন বাজারে দিন দিন ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, গত মৌসুমে তিনি এক বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছিলেন; এ বছর তিনি দুই বিঘা জমিতে চাষ করেছেন, আগামীতে এ চাষ আরো বৃদ্ধি করবেন বলে জানান। সরিষা চাষি কাজেম মিয়া বলেন, বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সরিষা চাষ করে পরিবারের ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণ করছেন। একই কথা বলেন সরিষা চাষি রাজারামপুর গ্রামের লোকমান হোসেন ও বাবু মিয়া।

এদিকে, সরিষার চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে শহরের তেলের মিলগুলো, তেলের মিল মালিকরা বলছেন, এক সময় বাজারে ভোজ্যতেল হিসেবে সোয়াবিন ও পামওয়েল বেশি ব্যবহার হতো, সেই সময় সরিষার তেল বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তেমন কেউ কিনত না, এখন একদিকে যেমন ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে, সরিষার চাষও বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন অধিকাংশ মানুষ সরিষার তেলেই ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার করছে। এ কারণে তেলের মিলগুলোর কর্মব্যস্থতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকজন তেলের মিল মালিক বলেন, এক সময় যে মিল মালিকেরা তেলের মিল বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা আবার নতুন করে মিল বসাচ্ছেন।

এদিকে, উপজেলার সনামধারী চিকিৎসক একেএম রেজাউল ইসলাম লাবু বলেন, সরিষার তেল স্বাস্থ্যসম্মত, এ তেল শরীরকে জটিল ও কঠিন রোগের হাত থেকে রক্ষা করে।

সাইফুল ইসলাম বলেন, সরিষা ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে ধরে রাখে, তিনি বলেন, সরিষা যেমন ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণ করে তেমনি ভোজ্যতেল আমদানির উপরে চাপ কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে এতে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে।

সরিষা ফুলের মধুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি। এই মধু একেবারেই কোলেস্টেরলমুক্ত। বিশেষ করে মধু রোগ প্রতিরোধ, শক্তি বৃদ্ধি, হার্ট শক্তিশালী, কোষ্ঠকাঠিন্য ও অনিদ্রা দূর করে। শারীরিক দুর্বলতা দূরসহ পাকস্থলী সুস্থ রাখে। অনেক ঔষুধি গুণের এ মধু অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমেই সরিষা ফুলসহ অন্যান্য সময়ে কালোজিরা ফুল, লিচু ও গুজি তেলের ফুল থেকে মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যলয় সূত্রে জানা গেছে, বারী সরিষা-৯, বারী সরিষা-১১, বারী সরিষা-১৪, বারী সরিষা-১৫, বারী সরিষা-১৭ ও ১৮ জাতের সরিষা চাষ হয়েছে বেশি। এছাড়া স্থানীয় জাতের দেশি সরিষাও চাষ হয়েছে। আমাদের দেশে শীতের সময়ে মধুর প্রচলন ও ব্যবহার বহুগুণে বেড়ে যায়। আর এই মধুর চাহিদা অনেকাংশ পূরণ করে থাকে সরিষা ফুলের থেকে সংগৃহীত মধু। কৃষিসমৃদ্ধ পাবনা জেলাতে তাই শীতের এই সময়ে সরিষা ফুলের মধু দেশের চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ হচ্ছে বিদেশে। জেলাতে এ বছরে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১০ টন। যার বাজারমূল্যে প্রায় ১০ কোটি টাকার মধু সংগ্রহ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুম্মান আক্তার বলেন, গত মৌসুমে এ উপজেলায় সরিষা চাষ হয়েছে ১৮২৩ হেক্টর জমিতে, এ বছর আরো একশ' হেক্টর বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, আমন ধান কেটে কৃষকরা সরিষা চাষ করে, আবার সরিষা তুলে নিয়ে ওই জমিতে বোরো রোপণ করে, এতে করে দো'ফসলি জমিতে তিনটি করে ফসল উৎপাদন করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। তিনি বলেন, সরিষা সুধু ভোজ্যতেলেই দেয় না, সরিষার খৈল গো-খাদ্য ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়; এছাড়া সরিষার গাছ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার হয। এ কারণে সরিষা একটি লাভজনক ফসল। আগামীতে সরিষা চাষ এ অঞ্চলে আরো বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

লেখক: মো. রজব আলী : ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে