বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

মৌসুমি ফলে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন

মো. সাজ্জাদ হোসেন
  ১০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
মৌসুমি ফলে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন

হঠাৎ কোনো কিছুর সঙ্গে হোঁচট খেলাম। একটি বাচ্চা ছেলে। না, ওর কোনো দোষ নেই। ও খেলছিল। দোষটা আমারই। আমি খেয়াল করতে পারিনি। মনটা ভালো নেই। হাসপাতালে গিয়েছিলাম এক আত্মীয়কে দেখতে। শিশু ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে আসার সময় এক মায়ের আর্তচিৎকারে বুকের ভেতরটা যেন দুমড়ে-মোচড়ে গেল। কোলের শিশুটা মারা গেছে- হয়ত মাত্র কিছুক্ষণ আগেই। বয়স ৪ কিংবা ৫ হবে হয়ত। বাচ্চটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুষ্টির অভাব। মায়ের শরীরও সেই একই দশা। অভাব আর দৈনতায় এভাবেই প্রতিদিন অকালে হারিয়ে যাচ্ছে কত শত শিশু। মায়ের বুক খালি হচ্ছে। কখনো বা আবার সন্তান জন্ম নেয়ার সময় কিংবা আগেই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিচ্ছে অপুষ্টির শিকার মা। আর কত কাল এ অবস্থা চলবে। এ দুনিয়ায় গরিবের কি কোনোই ঠাঁই নেই।

বাড়ি ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে ল্যাপটপের সামনে বসলাম। ইন্টারনেটে সার্চ দিতেই বেরিয়ে এলো ভয়াবহ চিত্র। সারাবিশ্বের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এ সংখ্যা প্রায় ২৩০ কোটি! ৫ বছরের কম বয়সের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। এ বয়সের প্রায় ১৪.৯০ কোটি শিশু খর্বাকৃতির অর্থাৎ বয়সের হিসাবে খাটো এবং প্রায় ৪.৫ কোটি শিশু রুগ্ন। কম ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এ প্রবণতা বেশি। অপর এক পরিসংখ্যান মতে সারাবিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ অপর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণ করে থাকে। মধ্য আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় এ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। দক্ষিণ এশিয়া মানে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ এই দেশগুলোর কথাই বলা হয়েছে।

ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন এডিশনে চোখ আটকে গেল। ২০১৭ সালের ১৪ আগস্ট তারিখের একটি আর্টিকেল। সংবাদ শিরোনাম 'কম প্রোটিনে ব্যাহত হচ্ছে শিশুর বিকাশ'। একটি বেসরকারি সংস্থা ভারতের বিভিন্ন শহরে ৮ থেকে ১৬ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রোটিনের অভাব বিষয়ে সমীক্ষা চালিয়েছিল। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভারতে সবচেয়ে বেশি প্রোটিনের অভাবে ভুগছে লখনৌ শহর। এ শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু প্রোটিন সমস্যায় আক্রান্ত। দিলিস্নতে এ সংখ্যা ৬০ শতাংশ। এরপরে আছে মুম্বাই, বিজয়ওয়াড়া ও চেন্নাই। কলকাতায় এ সংখ্যা ৪৩ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৯৩ শতাংশ ভারতীয় খাবারের গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন নন। বিশেষত, গর্ভাবস্থায় কী ধরনের খাবার খাওয়া উচিত, সন্তান ও মা দু'জনের শরীরের জন্য কতটা প্রোটিন, ভিটামিন জরুরি সেগুলো নিয়ে সচেতনতার অভাব আছে। প্রায় ৯৭ শতাংশ গর্ভবতী মহিলা প্রতিদিনের খাবারে যে সব খাদ্য দরকার তার গুরুত্ব সম্পর্কে জানেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রোটিন ও ভিটামিন এবং কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার অধিক খাওয়ার কারণে হার্টের সমস্যা ও ডায়াবেটিসের মতো সমস্যা বাড়ছে। চিকিৎসক অর্ণব হালদারের বক্তব্য উদ্ধৃত করে আনন্দবাজারের সংবাদটিতে বলা হয়েছে- খাদ্য তালিকায় শুধু নিরামিষ খাবার থাকলে চলবে না- এর সঙ্গে চাই দুধ, সয়াবিন জাতীয় খাবার- যার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়াও উচিত। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ রুচিরেন্দু সরকার বলেছেন, শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠতেও প্রোটিন জরুরি। যে কোনো অস্ত্রোপাচারের পরে শিশুর শরীরে প্রোটিনের অভাব থাকলে ক্ষতস্থান সারতে বেশি সময় লাগে। তাছাড়া অস্ত্রোপাচারের পরবর্তী সময়েও সমস্যা তৈরি হতে পারে।

ভারতের মতো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে যদি এই অবস্থা হয়- তবে আমাদের দেশের অবস্থা কি তা বুঝতেই পারেন? ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিলের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, প্রতি ৩ জন বাংলাদেশির মধ্যে একজন মনে করে যে, প্রোটিনের ঘাটতি তাদের শরীরে তেমন একটা প্রভাব ফেলে না। সমীক্ষায় অংশ নেয়া ৪৪ শতাংশ মনে করেন যে, প্রোটিনের চেয়ে ভিটামিন এবং মিনারেল ঢের বেশি দরকারি। তাছাড়া বেশিরভাগ বাংলাদেশীই জানেন না, প্রতিদিন কতটুক প্রোটিন গ্রহণ করা দরকার।

মনটা আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে পুষ্টি নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যবান ও মেধাবি জাতি গঠন ২০৪১ সালের উন্নত দেশ, ২১০০ সালের ডেল্টা পস্ন্যানে লক্ষ্যগুলো কীভাবে অর্জিত হবে?

বারডেমের প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ মহুয়া আপার কাছে ফোন করলাম। আমার কণ্ঠ শুনে আপা বললেন, কী হয়েছে সাজ্জাদ ভাই? কোনো সমস্যা? আমার মন খারাপের কারণটি খুলে বললাম। মহুয়া আপা বললেন, খাবারের অপ্রতুলতা কিংবা দারিদ্র্য যতটা না দায়ী তারচেয়ে বেশি দায়ী আমাদের অজ্ঞানতা। আমাদের আশপাশে প্রচুর খাবার আছে যেগুলোতে প্রচুর প্রোটিন আছে, দামও কম কিন্তু আমরা তা জানি না। অনেকেই মনে করেন, কেবল দামি খাবারেই বুঝি প্রোটিন বা পুষ্টি আছে। ধারণাটি ঠিক না। ১০০ গ্রাম ওজনের একটি ডিমে প্রায় ১৪ গ্রাম প্রোটিন থাকে অথচ দাম ১১-১২ টাকা। ১০০ গ্রাম তেলাপিয়া মাছে প্রোটিন আছে প্রায় ৬০ গ্রাম, পাঙ্গাশ মাছে ১৭ গ্রাম, ডালে ৬ গ্রাম এবং লাল চালে ৩ গ্রাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক প্রফেসর ডক্টর খালেদা ইসলামের কথা মনে পড়ল। তিনি বলেছিলেন, আমাদের হাতের কাছে আরও একটি খুবই সস্তা দামের খাবার আছে। ভারতে খাবারটি বেশ জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য তালিকায় এ খাবারটি এখনো অনেকটাই অবহেলিত বলা চলে। খাবারটি হচ্ছে সয়াবিন। প্যাকেটে ও খোলা দুভাবেই খুবই কম টাকায় কেনা যায় সয়াবিনের বড়ি। সয়াবিনে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ প্রোটিন। ভুট্টাতেও প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রোটিন। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর প্রতিদিন ৪৬ থেকে ৫৬ গ্রাম প্রোটিন দরকার হয় আর একজন গর্ভবতী মায়ের প্রথম ত্রৈমাসে দিনে ৪৬ গ্রাম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসে প্রয়োজন হয় ৭১ গ্রাম প্রোটিন। ডিম, ডাল দিয়ে খিচুরি রান্না করে খেলে ফাস্টক্লাস প্রোটিনের উপকার পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রোটিন রয়েছে দেশি ফলে।

বলা হয়ে থাকে আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। তাই আগামী দিনের সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে হলে শিশুদের খাদ্য ও পুষ্টি এবং বিশেষ করে প্রোটিন চাহিদা পূরণের দিকে নজর দিতে হবে।

সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এ কারণে যে, দেরিতে হলেও এক যুগান্তকারী পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো দেশের ১৫০টি উপজেলার ১৮ থেকে ১৯ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৫ লাখ শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে পাঁচ দিন পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। স্কুল ফিডিং প্রকল্পের আওতায় শিক্ষার্থীদের দুধ, ডিম, মৌসুমি ফল, কলা, ফর্টিফাইড বিস্কুট, কেক ও পাউরুটি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ একটাই- প্রকল্প শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে যেন অসাধারণ এই কার্যক্রমটি বন্ধ হয়ে না যায়। আগামী দিনের মেধাবী প্রজন্ম দেশের জন্য আর্শিবাদ হবে।

মো. সাজ্জাদ হোসেন: যোগাযোগ ও মিডিয়া উপদেষ্টা, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে