সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

রক্তের জন্য কান্না, আর না!

বোরহান উদ্দিন
  ০২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
রক্তের জন্য কান্না, আর না!

রক্তের জন্য কান্না করতে ছিল মধ্য বয়স্ক একজন নারী। আশেপাশে অনেক মানুষ থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। মধ্য বয়স্ক নারীর কান্নারত অবস্থায় বলছিল ডাক্তার বলেছে ইমারজেন্সি রক্ত দিতে না পারলে তার মুমূর্ষু মাকে (ক্যানসার আক্রান্ত) বাঁচানো সম্ভব হবে না। বিষয়টি গভীরভাবে দাগ কাটে পাশেই থাকা এক যুবকের। দিনটিতে ছিল তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে তিনি ছুটে যান হাসপাতালে। রক্ত দেওয়ার পর হাসপাতাল থেকে তড়িঘড়ি করে রওনা হন পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। কিন্তু সঠিক সময়ে উপস্থিত হতে না পারায় পরীক্ষা দেওয়া তার সম্ভব হয়নি- বলছিলাম সাতক্ষীরা জেলার দরগাহপুর গ্রামের আব্দুল কাদেরের ছেলে শাকিলের কথা।

গল্পটি ছিল ২০১৭ সালের, জীবনের ১মবারের মতো রক্তদানের অনুভূতি অর্জন করে শাকিল? এরপর থেকে শুরু হয় মানবিক কাজ নিয়ে তার পথচলা। মানবিক কাজের জন্য সংগ্রাম মোটেও সহজ ছিল না। রক্তদানের পর দীর্ঘদিন অসুস্থতার বোঝা শরীরকে টানতে হয়। তবুও তিনি দমে যায়নি।

এরপর ২০১৮ সালে শাকিল সাতক্ষীরা থেকে চলে আসে ঢাকায়, ভর্তি হয় রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত সরকারি বাঙলা কলেজে। ক্যাম্পাসের আশপাশে অবস্থিত প্রায় ডজনখানেক হাসপাতাল থেকে রোগীর আত্মীয়স্বজনরা রক্তদাতা খোঁজার জন্য বাঙলা কলেজের ক্যাম্পাসে আসত। এসব ঘটনা শাকিলের নজরে প্রতিনিয়ত পড়তে থাকল। কী করা যায়? তখন শাকিলের স্মার্ট ফোন ছিল না। শাকিল চিন্তাভাবনা করল রক্তের জন্য রোগীর স্বজনরা ক্যাম্পাসে এলে নিঃস্বার্থভাবে ?রক্ত মেনেজ করে দিয়ে পাশে দাঁড়াবে। কম দামি একটা স্মার্ট ফোন কিনে নিজে উদ্যোগে অনলাইনের মাধ্যমে বস্নাডের সংগঠন তৈরি করল। নামকরণ করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের নাম অনুসারে '৭ কলেজ বস্নাড অর্গানাইজেশন'। যেখানে নিঃস্বার্থভাবে শ্রম দিচ্ছে ৭ কলেজের স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীরা। এরপর রক্তের প্রয়োজনে পিছনে তাকাতে হয়নি শাকিলের। ক্যাম্পাসে প্রতিদিন রোগীর স্বজনরা আসত, তাদের বিনামূল্যে রক্তের ব্যবস্থা করে দিত শাকিল ও তাদের টিম। কিন্তু মানবিক কাজ করার জন্য অনেক বাধা বিপত্তি প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে শাকিলের।

৭ কলেজ বস্নাড অর্গানাইজেশন ৬ বছর ধরে মানবসেবায় নিয়োজিত রয়েছে। রক্তের গ্রম্নপ নির্ণয়, রক্তদানের আহ্বান, সচেতনতার বার্তা, মুমূর্ষু রোগীকে রক্তদাতা ম্যানেজসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। গরিব, অসহায় ও অভুক্তদের জন্য 'রুটি দিবস' বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবী অঙ্গনে শাকিল এখন অনেকটাই পরিচিত একটা মুখ। নিজের মেধা, শ্রম ও বুদ্ধি দিয়ে দেশের ৬৪ জেলার ভলান্টিয়ারদের মাঝে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে পেরেছে। কোভিড-১৯ এর সময়ে নিজ এলাকায় করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা করেছে। এছাড়া কয়েকজন যুবকদের নিয়ে বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা ও অসহায়দের খাবার বিতরণের মতো মহান কাজেও শাকিল ছিল সক্রিয়।

বেকারত্বের মাঝেও নিজের কথা চিন্তা না করে প্রতিনিয়ত পথশিশুদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাঠদান করাচ্ছে। বর্তমানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের তিনটা স্কুলে শিক্ষকতা হিসেবে ব্যস্ত সময় পার করছে। বিভিন্ন জেলায় ভলান্টিয়ার প্রোগ্রাম ও ফেসবুক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে মানুষকে রক্তদানসহ বিভিন্ন মানবিক কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান করছে। বর্তমানে সব ধরনের মানবিক কাজের সাথে জড়িত শাকিল। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার মাঝে কুড়িগ্রাম বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কোরবানির ঈদও পরিবার ছাড়া অপরিচিত কুড়িগ্রামে করেছে। ফলে পড়াশোনায় কম সময় দেওয়ায় পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। এটা নিয়েও বিন্দুমাত্র আফসোস নেই শাকিলের।

কারণ জানতে চাইলে শাকিল বলে, ভালো কাজের পিছনে সময় দিতে পাচ্ছি এটা নিশ্চয়ই আলস্নাহ তায়ালার এক ধরনের নেয়ামত। সুতরাং আমি সেই নেয়ামত থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাই না। এছাড়া শাকিল তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা যারা ভালো কাজের সাথে জড়িত আছেন তারা কখনও ভুলেও এটার প্রতিদান আশা করবেন না। মনে রাখা উচিত এগুলো আলস্নাহ তায়ালার এক ধরনের নেয়ামত। আমরা সৌভাগ্যবান যে ভালো কাজের সাথে নিজেদের জড়িয়ে রাখতে পেরেছি। এজন্য সবসময় শুকরিয়া করা উচিত।

শাকিল তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ছোটবেলা থেকে আমি আমার বাবাকে দেখছি মানুষের বিপদে এগিয়ে যেতে। সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করতে। বাবার এমন মানবিক কাজ দেখে প্রতিনিয়ত হৃদয়ে কড়া নাড়ত। সংসারে অভাব অনটনের ভিতরও বাবা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তখন থেকে স্বপ্ন দেখতাম কখনও সুযোগ পেলে আমিও বাবার মতো ভালো কিছু করব, মানুষের বিপদে পাশে থাকব, তাদের সাহায্য করব। তাই বাবার মতো আমিও চেষ্টা করে যাচ্ছি মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। বাবার মানবিক কাজ থেকে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমার বাবা এখনও মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে, এটা আমাকে প্রতি মুহূর্তে আনন্দ দেয়।

নিজ গ্রামে শাকিলকে এসব মহান কাজের জন্য সবাই ভালোবাসে ও সর্বদা পাশে থাকে। এছাড়া হাসপাতালে রোগীকে সেবা করতে গিয়ে নির্ঘুম রাত কাটানো হয় শাকিলকে প্রতিনিয়ত। ব্যস্ততার মাঝেও রক্তদান করতে ভুলেন না। ২২ তম রক্তদান সম্পন্ন করেছে চলমান ভাষার মাসে। মৃতু্যর পর নিজের চোখ দুটোকে দান করার অঙ্গীকার বদ্ধও করা শাকিলের। সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে মরণোত্তর চক্ষুদাতা হিসেবে নিজের নাম লিখেছে। কনকনে শীতের ভিতরও নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে মানব সেবায়। শীতবস্ত্র, গরম পোশাকের মাধ্যমে ভালোবাসা কুড়িয়েছে উত্তরবঙ্গের অসহায় শীতার্ত মানুষের কাছে থেকে।

শাকিল একজন স্বেচ্ছাসেবী, একজন রক্তদাতা, একজন মরণোত্তর চক্ষুদাতা, পথশিশুদের সেবক, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষক, কোভিট-১৯ যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত।

শাকিল বলেন, পথশিশু/সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলো তাদের মাঝে পৌঁছে দিয়ে মানবসম্পদে পরিণত করতে চাই। শাকিল ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে পাঠদান করায় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শাকিল স্যার হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে সবার মাঝে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে