শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

রাজকুমার ও নীলপদ্ম

শাকিব হুসাইন
  ১৬ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
রাজকুমার ও নীলপদ্ম

সে অনেক দিন আগের কথা। রাজা বিধান সিংহের রাজ্য ছিল বিশাল বড়। হাতি, ঘোড়া ও সিপাহসালা অনেক অনেক ছিল। রাজ্যের সবাই সুখে-শান্তিতে দিন কাটাত। রাজার ছিল এক রানি। রানির সঙ্গে সুখে-শান্তিতেই দিন কাটত। কয়েক বছর পর তাদের ঘর আলো করে এলো ফুটফুটে একটা ছেলে সন্তান। রাজা ছেলে সন্তান পেয়ে ভীষণ খুশি হলো। রাজ্যে উৎসবের রব পড়ে গেল। পুরো ছয়মাস সেই উৎসব চলল। রাজা ছেলের নাম রাখল বীর সিংহ। ধীরে ধীরে বীর সিংহ বড় হতে থাকল।

এখন বীর সিংহ যৌবনে উপনীত হয়েছে। সে যেমন সুদর্শন তেমনি যুদ্ধে পারদর্শী। তীর-ধনুক চালাতে তার মতো আশপাশে দশটা রাজ্যে কেউ ছিল না।

দেখতে দেখতে বীর সিংহের বিয়ের বয়সও হয়ে গেছে। রাজা মনে মনে ভাবলেন বীর সিংহকে বিয়ে দেবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। আশপাশের রাজ্য থেকে রাজকুমারীরা আসতে থাকল। কিন্তু বীর সিংহের কাউকেই পছন্দ হচ্ছিল না। রাজা পড়লেন মহাবিপদে। একদিন বীর সিংহকে কাছে ডেকে বললেন, 'পুত্র আমার। এই রাজকুমারীদের মধ্য থেকে কাউকে কি তোমার পছন্দ হয় না?'

বীর সিংহ বিনা দ্বিধায় বলল, 'আপনি ঠিক ধরেছেন পিতা। এদের কাউকে আমার পছন্দ হয় না।'

রাজা বলল, 'পুত্র আমার, তাহলে এখন তুমি কি করতে চাচ্ছো?'

বীর সিংহ বলল, পিতা! আমি বিভিন্ন রাজ্য ঘুরতে চাই। ভ্রমণে যাকেই আমার পছন্দ হবে তাকেই বিয়ে করব।'

রাজা বলল, 'ঠিক আছে। আমি তোমার যাত্রার সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।'

বীর সিংহ বলল, 'পিতা! আমি কাউকে আমার সঙ্গী করতে চাই না। আমি একাই যাব।'

পরের দিন বীর সিংহ সবার থেকে বিদায় নিয়ে রাজ্য ভ্রমণে যাত্রা শুরু করল। তার প্রিয় ঘোড়া আর কিছু শুকনো খাবার সঙ্গে করে নিয়ে। দেখতে দেখতে অনেক দূর পথ চলে এলো বীর সিংহ। সন্ধ্যা হয়ে আসছে দেখে একটা বুড়ো বটগাছের নিচে বসে পড়ল। তার জলের তৃষ্ণা পেল। যতটুকু জল ছিল তা পথেই শেষ হয়ে গেছে। সে জলের ধারার শব্দ পেল। পাশেই মনে হয় কোথাও একটু এগিয়ে দেখতে পেল একটা সরোবর। কি সুন্দর স্বচ্ছ তার জল। সরোবরে গিয়ে জল পান করল। জল পান করে আসার সময় তার নজর পড়ল একটা নীলপদ্ম ফুলের উপর। ফুলটা জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু একি! ফুলটার চারপাশ দিয়ে দুটো বড় বড় কুমির ঘোরাঘুরি করছে। বীর সিংহ ভাবল, নিশ্চয়ই এখানে কিছু একটা আছে। তাই সে জলে নামার প্রস্ততি নিল। যেই জলে নামতে যাবে তখনই একটা কুমির তার সামনে এসে বিশাল মুখ হা করল। বীর সিংহ কিছুটা পিছু সরে গেল। তারপর ভাবল, নীলপদ্মর কাছে যেতে হলে আগে কুমির দুটোকে বধ করতে হবে। বীর সিংহ তার তীর-ধনুক বের করল। নিশানা করে কুমির দুটোর উপর ছুড়ল। সঙ্গে সঙ্গে কুমির দুটো মারা গেল। বীর সিংহ জলে নেমে নীলপদ্মর কাছে গেল। নীলপদ্ম ফুলকে যখনই ছিঁড়ল তখনই নীলপদ্ম একটা রূপবতী রাজকন্যায় পরিণত হলো। এ দেখে বীর সিংহ চমকে উঠল।

তারপর বলল, 'কে তুমি? '

\হমেয়েটি বলল, 'আমি তোমার মতোই সাধারণ মানুষ। আমাকে এখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।'

বীর সিংহ বলল, 'কে তোমাকে এখানে বন্দি করে রেখেছিল? '

\হমেয়েটি বলল, 'আমার সৎ রাক্ষসী মা।'

বীর সিংহ বলল, 'কেন তোমাকে বন্দি করেছিল?'

\হমেয়েটি বলল, 'আমার নাম রাজকুমারী রূপ মিনি। আমাদের রাজ্যের নাম রূপনগর। একদিন আমার পিতা শিকারে গেলেন। শিকার থেকে ফিরে আসলেন একটা সুন্দরী মেয়ে নিয়ে।

পিতা বললেন, 'এ আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। আজ থেকে ও এখানে থাকবে। 'কিন্তু কে জানতো ও একটা রাক্ষসী। পিতাকে সে বশ করে রেখেছিল। আজও পিতা তার বশে আছে। একরাতে রাক্ষসীটা আমার মাকে মেরে ফেলল। তারপর আমাকে মারতে এলে সে ব্যর্থ হয়। কারণ আমাকে যে মারতে আসবে তার শরীরে আগুন ধরে যাবে। এই শক্তি আমাকে নীল পরী দিয়েছিল। আমাকে মারতে না পেরে ছল করে সরোবরে কাছে এনে নীলপদ্ম করে রেখে দিয়েছিল। যাওয়ার বেলায় রাক্ষসী বলেছিল, ' যদি কোনো রাজপুত্র এসে নীলপদ্মকে স্পর্শ করে তাহলেই তুই মুক্তি পাবি। 'আর এটা কখনোই সম্ভব না। সেই থেকে আমি এখানে নীলপদ্ম হয়ে আছি। এই হলো আমার জীবন কাহিনী। তুমি না এলে আমি মনে হয়তো কোনো দিন আর নীলপদ্ম থেকে মানুষ হতে পারতাম না। তোমার প্রতি আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। আমি যদি রাক্ষসীকে মারতে না পারি তাহলে রূপনগর রাক্ষস নগরীতে পরিণত হবে যাবে।'

বীর সিংহ বলল, 'আমিও তোমার সঙ্গী হতে চাই। নেবে আমায়?'

রূপ মিনি বলল, 'তুমি সত্যিই আমার সঙ্গে যাবে?'

বীর সিংহ বলল, 'অবশ্যই যাব।'

রূপ মিনি বলল, 'এত আমার জন্য খুশির খবর। কিন্তু রাক্ষসীকে মারা অতো সহজ হবে না। ওর জীবন অন্যখানে লুকানো আছে। আমি একবার শুনেছিলাম, ওর জীবন আমাদের প্রাসাদের উত্তর পাশে একটা গুহার ভেতর লুকানো আছে। রাক্ষসী জীবন নাশ করতে পারলেই সব রাক্ষস এমনিতেই মারা যাবে।'

বীর সিংহ বলল, 'চল তাহলে সেই গুহায় যাই।'

রূপ মিনি বলল, 'সেখানে যাওয়া অতো সহজ না। সেখানে বিশাল বড় বড় রাক্ষস থাকে। ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমাদের গুহায় ঢুকতে হবে।'

বীর সিংহ বলল, 'চল তাহলে সেখানে যাই।'

রূপ মিনি বলল, 'দাঁড়াও আমি কিছু ঘুনারি পাতা নিয়ে আসি।'

কিছুক্ষণ পর রূপ মিনি ঘুনারি পাতা নিয়ে ফিরে এলো।

বীর সিংহ বলল, 'এই পাতা দিয়ে কি হবে?'

রূপ মিনি বলল, 'এই পাতা দিয়ে রাক্ষসদের ঘুম পাড়িয়ে দেব। এই পাতা রাক্ষসদের সামনে রাখলে তারা সেখানেই ঘুমিয়ে যায়।'

দুজন মিলে গুহার কাছে গেল। গুহার কাছে যেতেই দেখল এই বড় বড় রাক্ষসরা গুহার মুখ পাহারা দিচ্ছে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রূপ মিনি ঘুনারি পাতা গুহার কাছে রেখে এলো। ঘুনারি পাতার সুগন্ধে সব রাক্ষস সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর তারা গুহার মুখে গেল।

রূপ মিনি বলল, 'একটা মন্ত্র পড়তে হবে। তা না হলে গুহার মুখ খুলবে না। মন্ত্রটা আমার জানা আছে। একবার রাক্ষসীর মুখে শুনেছিলাম।'

এই বলে রূপ মিনি মন্ত্র পড়া শুরু করল।

\হ'গুম! গুম!গুহারে! একটা পাথর নে,

\হএসেছি আমি রাক্ষস রানি মুখ খুলে দে।'

এই বলে রূপ মিনি একটা পাথর গুহাতে ছুড়ল। অমনি গুহার মুখ খুলে গেল। দুজনে গুহাতে প্রবেশ করল। আবার গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা রাক্ষসীর জীবন পেয়ে গেল। একটা টিকটিকিতে রাক্ষসী লুকিয়ে রেখেছে তার জীবন। ওটার কাছে যেতেই একটা বিশাল রাক্ষস তাদের সামনে দাঁড়াল। বীর সিংহ তার তীর-ধনুক দিয়ে একটার পর একটা তীর চালাতে লাগল। কিন্তু রাক্ষসটার কোনোই কিছু হচ্ছিল না। এমন সময় রূপ মিনি ওখানে থাকা একটা তলোয়ার দিয়ে রাক্ষসটার পায়ে আঘাত করল সঙ্গে সঙ্গে রাক্ষসটা মারা গেল। রূপ মিনি শুনেছিল কিছু কিছু রাক্ষসদের জীবন পায়ে থাকে। তাই সে পায়েই তলোয়ার চালিয়েছে। আর সে সফলও হলো। এরপর তারা খুব সহজে রাক্ষসীর জীবন পেয়ে গেল। ওদিকে রাক্ষসী সব বুঝতে পাড়ল তার জীবন কেউ হাতে নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রাক্ষসী গুহার ভেতরে ঢুকে পড়ল। আর দেখল, রূপ মিনির হাতে তার জীবন।

রাক্ষসী রূপ মিনিকে বলে, 'রূপ মিনি মা আমার ওটা আমাকে দিয়ে দে মামা। আমি তোকে অনেক হীরে, মুক্তা ও মানিক দেব মা।'

রূপ মিনি বলল, 'না রাক্ষসী। এটা তুই কিছুতেই পাবি না। আমি জানি, এটাতে তোর জীবন আছে। এটা ধ্বংস করে দিলেই তুই মরে শেষ হয়ে যাবি।'

বীর সিংহ বলল, 'তোকে বাঁচিয়ে রাখলে আমাদের মনুষ্য জাতির বিপদ। মরার জন্য প্রস্তত হয়ে যা রাক্ষসী। রূপ মিনি টিকটিকিটাকে তলোয়ার দিয়ে মেরে ফেল।'

রূপ মিনি আর বিলম্ব করল না। সঙ্গে সঙ্গে টিকটিকিটার বুকের উপর তলোয়ার বসিয়ে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে রাক্ষসী মরে উধাও হয়ে গেল।

রাক্ষসদের হাত থেকে মুক্ত হলো রূপনগর। রূপ মিনির পিতার বশ কেটে গেল।

রূপ মিনি গুহার কাছে এসে আবার মন্ত্র পড়া শুরু করল, 'গুম! গুম! গুহারে! একটা পাথর নে,

বাইরে যাবে রাক্ষস রানি মুখ খুলে দে।'

এই বলে গুহার মুখে একটা পাথর ছুড়ে মারল রূপ মিনি। সঙ্গে সঙ্গে গুহার মুখ খুলে গেল।

দুজনে গুহা থেকে বের হয়ে এলো। এতক্ষণে রূপ মিনির পিতা সব বুঝতে পেরেছে। রাজ্যে আবার সুখ শান্তি ফিরে এলো? রূপ মিনির সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল বীর সিংহের। সবাইকে বিদায় দিয়ে রূপ মিনিকে নিয়ে বীর সিংহ তার রাজ্যে রওয়ানা দিল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে