সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

পরির বনে কুঁজো

রূপান্তর: মোস্তাফিজুল হক
  ২৩ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

বহু বহুদিন আগের কথা। পরিরাজ্যের মাঝখানে ছিল এক বিশাল বন। সেই বন এতটাই বড় ছিল যে, তা পেরিয়ে যেতেও বহুদিন লেগে যেত। এটা ছিল এক মায়াবী বন। সারা রাত ধরে আশপাশের ছোট্ট পরিদের দখলে থাকত। পরিরা রাতভর লাফালাফি আর নাচনাচি করত। তবে দিনের বেলায় দূরেই থাকত। দুপুরে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়লে তারা সবাই দৌড়ে চলে যেত। তারপর শাপলা আর গোলাপী পদ্মফুলের পাপড়ির ফাঁকে বিছানা গড়ে শুয়ে যেত। আমুদে রাতের জায়গাটা চিনে রাখার জন্য ঘাসের উপরে গোলচক্কর এঁকে রাখত।

পরিদের বনে একটা সুন্দর উদ্যান ছিল। উদ্যানের মাঝখানে ছিল বিশাল দীঘি। দীঘির চারপাশে ছিল উঁচু উঁচু ছায়াবৃক্ষ। সেই বনে মানুষ নয়, পরি আর অন্যান্য পশুর বিশেষ অনুকূলে ছিল। বিশেষ করে তিনটে ছোট পরি ছিল, যারা রোজ সূর্যোদয়ের আগেই চলে আসতো। সেই পরিরা প্রাণভরে জায়গাটা উপভোগ করত। ওদের খুবই পছন্দের একটা নাচ আছে। হাত ধরে মিলেমিশে ঘুরে ঘুরে সেই বিশেষ নাচটা নাচে। নাচে আর গায়, 'হাম্পটি ডাম্পটি! হাম্পটি ডাম্পটি!'

এক ছিল বেঁটে কুঁজওয়ালা। একদিন খুব ভোরে লাকড়ি জোগাড় করতে বের হলো। কুঁজো লোকটা সেই চমৎকার উদ্যানে ঢুকে গেল। সে দেখল, সেখানে তিনটে ছোট্ট পরি গোল হয়ে হাত ধরে নাচছে। নেচে নেচে, হেসে হেসে গাইছে, 'হাম্পটি ডাম্পটি! হাম্পটি ডাম্পটি!'

কুঁজো ছেলেটি সেই নাচ দেখে ভীষণ আনন্দিত হলো। সে তার হাতের লাকড়ির বোঝাটা ফেলে দিল। এরপর ওদের সঙ্গে নাচগানে মেতে উঠল। ছেলেটা খুবই চমৎকার নাচল। তাছাড়া উল্টো ডিগবাজিও দিল। সে ছোট্ট পরিদের তাজ্জব বানাল। পরিরাও কুঁজোকে জগতের সবচেয়ে দরদি মানুষ মনে করল। তাই তারা ভাবল, দরদি মানুষের পিঠের বাজে কুঁজটা এখনই শেষ করা উচিত।

পরিরা দীঘি থেকে ছোট্ট সোনার কলসে কিছু জল তুলে নিয়ে এলো। কলসের জল কুঁজোর পিঠে ঢেলে বলল,

'কুঁজ নিয়ে প্রিয়তম নাচে ঘুরে ঘুরে,

নেচে নেচে গান গায় মধুময় সুরে!

বাসন্তী বায়ু প্রিয়- কী যে ফুরফুরে,

উঁচু কুঁজ উবে যাও; চলে যাও দূরে!'

সবাই আবার হাতে হাত রেখে চারপাশে ঘুরে ঘুরে কুঁজোর সঙ্গে নাচ জুড়ল। নেচে নেচে গাইতেও লাগল। কুঁজ চলে যাওয়ায় সে এবার আগের চেয়েও সুন্দর করে গাইলো আর ডিগবাজি দিল। এতটা আনন্দ নিয়ে আর হেসে হেসে খুব কমই 'হাম্পটি ডাম্পটি' গাওয়া যায়। ছেলেটি পরিদের সবার হাতে চুমুও দিল।

দুপুরে পরিরা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ছেলেটি ছোট ছোট পায়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে ছুটল। সে তার উটকো কুঁজ থেকে মুক্তি পেয়ে ভীষণ খুশি। সমস্ত বাধা পেরিয়ে 'হাম্পটি ডাম্পটি' সুরের ঝরনা ছড়িয়ে বাড়ির পথে ছুটে চলল।

কুঁজোরা দুই ভাই। অন্য ভাইটাও তার মতোই কদাকার ও বাঁকা কুঁজের অধিকারী। সোজা হয়ে ছোট্ট মানুষটি কুঁড়েঘরের দরজার কাছে এলো। তার ভাই তাকে দেখতে পেল। কুঁজ ছাড়াই লাফালাফি করতে দেখে ভীষণ অবাক হলো। সে জিজ্ঞাস করল, 'কীভাবে এই বাজে কুঁজ থেকে মুক্তি পেল?'

'ওহ! এ এক আশ্চর্য ঘটনা! আজ খুব ভোরে লাকড়ির খোঁজে বের হই। কাঠবাগানে হঠাৎ তিনটা ছোট্ট পরি দেখতে পাই। ওরা গোল হয়ে নাচছিল। আর নেচে নেচে গাইছিল 'হাম্পটি ডাম্পটি! হাম্পটি ডাম্পটি!' ওরা এতটাই খুশিমনে নাচছিল যে, ওই নাচে আমারও যোগ দিতে ইচ্ছে হয়। তাই আমি সাহস করে ওদের হাত ধরে গোল হয়ে নেচে নেচে গেয়ে চলি, 'হাম্পটি ডাম্পটি! হাম্পটি ডাম্পটি!'

আমার গান আর নাচানাচি পরিদের খুব পছন্দ হয়েছিল। নেচে নেচে ক্লান্ত হয়ে এক সময় ওরা থেমে যায়। তখন ওরা ছোট্ট সোনার কলস ভরে পুকুর থেকে জল তুলে আনে। সে জল আমার পিঠে ঢেলে দিয়ে নতুন একটা গান ধরে। ওদের সেই গানের সুরে আর জলে ধুয়ে আমার বাজে কুঁজটা সত্যি সত্যিই মিশে যায়!'

যমজ ভাইটা তার আজব গল্প শুনে খুবই অবাক হলো। এটাই স্বাভাবিক। তার ভাইয়ের যে খাড়া কুঁজ নেই! ও যে সুদর্শন কাঠুরে হয়ে যাবে, এ তো চিন্তারও বাইরে! এবার তার ভাইয়ের প্রতি ভীষণ ঈর্ষা তৈরি হলো। তার একটাই চিন্তা, পরিদের খুঁজে বের করতেই হবে। তাকেও যে ভাইয়ের মতোই আকর্ষণীয় হওয়া চাই। ঈর্ষায় সে দৌড় শুরু করল। দেরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে সে ভীষণ জোরে দৌড়াতে লাগল। এতে সে পরিদের কাছে এসে দম ফুরিয়ে হাঁপাতে লাগল।

পরিরা আগের মতোই নেচে নেচে গান গাইছে। বেকুব ছেলেটা ভালো করে গাইতেও পারে না, নাচতেও পারে না! কারণ, সময় বাঁচাতে গিয়ে একেবারেই দম নেই। তারা নেচে নেচে গাইতে লাগল, 'হাম্পটি ডাম্পটি! হাম্পটি ডাম্পটি!' সে ছোট্ট পরিদের খুব হতাশ করল। হাত মিলিয়ে নাচতে নেমেও গেল।

গতিময় চক্করে কুঁজো ছেলেটা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ল। সে হাম্পটি ডাম্পটি গানের বদলে 'হ্যাম্পিট ড্যাম্পিট' গাইতে লাগল! পরিরা যেমন করে গাইল, তা না করে সে একটা দেয়ালের ওপরে বসেই গাইল! এতে পরিরা ভীষণ বিরক্ত হলো। তারা তাদের ছোট্ট সোনার কলসে পুকুর থেকে জল তুলে এনে তার পিঠে ঢালল।

তবে তারা 'উঁচু কুঁজ উবে যাও/ চলে যাও দূরে!' না গেয়ে গাইল,

'বাজে সুরে গান ধরে, কী অলস ছেলে;

ভাব নিয়ে বসে থাকে ও যে নাচ ফেলে!

দুইগুণ বেড়ে যাক উঁচু কুঁজ তবে,

হাঁদারাম কুঁজো বেটা শায়েস্তা হবে।'

মুহূর্তেই নির্বোধ হিংসুটের কুঁজ আগের চেয়েও দ্বিগুণ হয়ে গেল! ভারী কুঁজ নিয়ে নিচু হয়ে পথ হাঁটতে গিয়ে শেষে পথও হারিয়ে ফেলল।

\হউৎস: 'দ্য টুইন হান্সব্যাকস্‌' গল্প অবলম্বনে

(গল্পকার: ব্যারনেস অর্কি, হাঙ্গেরি

সূত্র: ফেয়ারি টেলজ্‌ ডটকম)

বাংলা রূপান্তর ও ছড়া সংযোজক: মোস্তাফিজুল হক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে