সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গু রোগীর পস্নাটিলেট নিতে হয় কেন আর কখন?

মানুষের রক্তে তিন ধরনের ক্ষুদ্র রক্তকণিকার মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি পস্নাটিলেট। যাকে বাংলায় অণুচক্রিকা বলা হয়। অণুচক্রিকার উৎপাদন হয় অস্থিমজ্জায়। পস্নাটিলেট রক্ত জমাট বাঁধতে ও রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরের প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে পস্নাটিলেটের মাত্রা দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ পর্যন্ত। এই পরিমাপের চাইতে পস্নাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না। ফলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি দেখা দেয়। রক্তে পস্নাটিলেট কমতে শুরু করাকে চিকিৎসাশাস্ত্রে বলা হয় থ্রোম্বোসাইটোপেনিয়া...
সুস্বাস্থ্য ডেস্ক
  ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর জন্য রক্ত চেয়ে দেওয়া পোস্টের সংখ্যা জানান দেয় পরিস্থিতি কতটা জটিল রূপ নিয়েছে। মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে পস্নাটিলেটের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণেই রক্তের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। মানুষের রক্তে তিন ধরনের ক্ষুদ্র রক্তকণিকার মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি পস্নাটিলেট। যাকে বাংলায় অণুচক্রিকা বলা হয়। অণুচক্রিকার উৎপাদন হয় অস্থিমজ্জায়। পস্নাটিলেট রক্ত জমাট বাঁধতে ও রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরের প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে পস্নাটিলেটের মাত্রা দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ পর্যন্ত। এই পরিমাপের চাইতে পস্নাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না। ফলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি দেখা দেয়। রক্তে পস্নাটিলেট কমতে শুরু করাকে চিকিৎসা শাস্ত্রে বলা হয় থ্রোম্বোসাইটোপেনিয়া।

পস্নাটিলেট কমে যাওয়া কেন বিপজ্জনক?

কেবল ডেঙ্গু নয়, আরও নানা রোগে রক্ত সংক্রমণে পস্নাটিলেটের সংখ্যা কমতে পারে। তবে, পস্নাটিলেট এক লাখের নিচে নেমে গেলে তাকে জটিল পরিস্থিতি বলে ধরে নেওয়া যায়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ সতর্ক করেছেন, এ পস্নাটিলেটের সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে নেমে এলে কোনো প্রকার আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে। রক্তে পস্নাটিলেটের সংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নামা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময় শরীরের যে কোনো জায়গা থেকে অনবরত রক্তপাত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকি থাকে।

পস্নাটিলেট কমে গেলেই কি রক্ত নিতে হয়?

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ বি এম আবদুলস্নাহ জানিয়েছেন, পস্নাটিলেট কমে গেলেই যে রক্ত নিতে হবে এমনটা নয়। কেননা, ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে শুধু পস্নাটিলেট কমে যাওয়াই একমাত্র সমস্যা নয় বরং শরীরের রক্তরস কমে যাওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়াও পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে। সেক্ষেত্রে লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিলে রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব। এক্ষেত্রে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে, বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগীর পস্নাটিলেট কমে গেলে রক্ত দেওয়ার কোন প্রয়োজন হয় না। রক্তে পস্নাটিলেটের সংখ্যা কমে যায় খুব কম সময়ের জন্য- হয়তো দুই তিন দিন। এরপর নিজে থেকেই পস্নাটিলেট বাড়তে থাকে। তাই আমরা ঢালাওভাবে রক্ত নেওয়ার পরামর্শ দেই না।

'আমাদের এমন রোগীও আছে ১০ হাজারে পস্নাটিলেট নেমেছে, তাও রক্ত লাগেনি। রোগী ভালো হয়ে গেছে। যদি রোগীর রক্তক্ষরণ বেশি হয়, রক্তরস কমে যায়, হিমোগেস্নাবিন কমে যায়, প্রেশার কমে যায়- তাহলেই রক্ত দেওয়ার কথা বলি', বলেন অধ্যাপক এ বি এম আবদুলস্নাহ।

আবার অনেক সময় পস্নাটিলেটের সংখ্যা বেশি থাকলেও এর কার্যকারিতা কমে যাওয়ার কারণে রোগীর অবস্থার অবনতি হতে পারে।

সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লে দেরী না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ।

ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। তবে এনএসওয়ান নামে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু হয়েছে কিনা দ্রম্নত বোঝা যায়। জ্বর হওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে এই পরীক্ষাটি করানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এছাড়া রক্তের সিবিসি (কমপিস্নট বস্নাড কাউন্ট) পরীক্ষা করার মাধ্যমে পস্নাটিলেটের সংখ্যা নিরূপণ করা যায়। পরীক্ষায় পস্নাটিলেট কম এলেই যে রোগীকে পস্নাটিলেট বা রক্ত দিতে হবে এমনটি নয় বলে জানিয়েছেন ডা. ঘোষ।

সাধারণত চিকিৎসকরা রোগীর বয়স, স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

সাধারণত এক ইউনিট পস্নাটিলেটের জন্য চারজন দাতার থেকে রক্ত নিতে হয়। এক ইউনিট পস্নাটিলেট দিলে ২০ হাজার কাউন্ট পস্নাটিলেট বাড়তে পারে।

পস্নাটিলেট সঞ্চালন বেশ ব্যয়বহুল ও জটিল পদ্ধতি। বাংলাদেশের সব হাসপাতালে রক্ত থেকে পস্নাটিলেট পৃথক করার যন্ত্রও নেই।

এ কারণে ঘরে ডেঙ্গু রোগী থাকলে আগে থেকেই আশপাশের কোনো হাসপাতালে পস্নাটিলেট সঞ্চালনের ব্যবস্থা আছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজ রাখতে হবে। সাধারণত ডেঙ্গু জ্বর জটিল রূপ নিলে বা রক্তক্ষরণ দেখা দিলে সেটাকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়। এক্ষেত্রে রক্ত নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকে।

প্রথমত, পস্নাটিলেট এক লাখের নিচে থাকবে, রক্তের হেমাটোক্রিট বা পিসিভি অর্থাৎ প্যাকড সেল ভলিউম বেড়ে যাবে, রক্তনালি থেকে রক্তরস বেরিয়ে আসার সমস্যা দেখা দেবে।

কখন রক্ত নিতে হয়?

দ্ব ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে মূলত রোগীর রক্তনালিগুলোর দেওয়ালে যে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে, সেগুলো বড় হয়ে যায়। এতে রক্তনালির দেওয়াল ভেদ করে রক্তের জলীয় উপাদান বা রক্তরস নালির বাইরে বের হয়ে আসে।

দ্ব একে পস্নাজমা লিকিংও বলা হয়। এতে রোগীর পেটে ও বুকে পানি জমতে পারে। সেইসঙ্গে রোগীর রক্তচাপ কমতে থাকে।

দ্ব পস্নাটিলেট কমার চাইতে, রক্তচাপ কমে যাওয়া ডেঙ্গু রোগীর জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ঘোষ।

দ্ব পস্নাটিলেট কমে যাওয়াসহ এমন আরও কয়েকটি কারণে রোগীর মস্তিষ্ক, কিডনি, হৃৎপিন্ডেও রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে। এমনকি হেমারেজিক শকের কারণে রোগীর মৃতু্য পর্যন্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে দ্রম্নত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, 'যদি আমরা দেখি যে, অ্যাকটিভ বিস্নডিং হচ্ছে এবং পস্নাটিলেট ২০ হাজারের নিচে নেমে এসেছে, তাহলে আমরা রোগীর পরিস্থিতি বুঝে রক্ত নেওয়ার পরামর্শ দেই। তবে ডেঙ্গু রোগীর মূল সমস্যা পস্নাটিলেট কমে যাওয়া নয়। এখানে আশঙ্কার জায়গা হলো রোগীর রক্তচাপ কমে যাওয়া। কারণ প্রেশার কমে গেলে শরীরে অক্সিজেনের অভাব হয়। এতে বিভিন্ন অঙ্গ সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।'

এসব জটিলতার পাশাপাশি যদি রোগীর রক্তচাপ অনেক কমে যায়, হৃৎস্পন্দন বাড়ে, হিমোগেস্নাবিন স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কমে যায় সেইসঙ্গে অন্যান্য জটিলতা দেখা, তবেই রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

চিকিৎসকরা যেসব লক্ষণ দেখলে রক্ত নিতে বলেন, তার মধ্যে রয়েছে-

দ্ব পস্নাটিলেট কমে যাওয়ার লক্ষণ।

দ্ব ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ। ত্বকে বেগুনি রঙের ক্ষত দেখা দিবে।

দ্ব শরীরে লাল বা কালো র?্যাশ দেখা দেয়।

দ্ব মাসিকে অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া।

দ্ব মুখ, মাড়ি বা নাক থেকে রক্তপাত হতে পারে।

দ্ব প্রস্রাব বা মলের সঙ্গে রক্তপাত। কালো রঙের নরম পায়খানা হওয়া।

দ্ব ক্ষতস্থান থেকে বা কোথাও কাটলে অনেকক্ষণ ধরে রক্তপাত হওয়া।

দ্ব অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ ও শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়।

যেসব খাবারে পস্নাটিলেট বাড়ে

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে সুষম খাবারের পাশাপাশি তরল জাতীয় খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে কিছু খাবার রয়েছে- যা খেলে রক্তে কমে যাওয়া পস্নাটিলেট আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

এমন পাঁচটি খাবার হলো:

১. মিষ্টি কুমড়া এবং এর বীজে থাকা ভিটামিন 'এ' রক্তে পস্নাটিলেট তৈরিতে সাহায্যে করে। তাই ডেঙ্গু রোগীর রক্তে পস্নাটিলেট কমে গেলে মিষ্টি কুমড়া বা তার বীজও খেতে পারেন।

২. লেবুর রসে থাকা প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন 'সি' রক্তে পস্নাটিলেটের পরিমাণ বাড়ায়। এছাড়া শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়। তাই ডেঙ্গু রোগীকে প্রচুর লেবু শরবত খাওয়ানো উচিত।

৩. আমলকীতেও রয়েছে প্রচুর ভিটামিন 'সি' ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। আমলকী খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং পস্নাটিলেট ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করে।

৪. রক্তের যে কোনো সংক্রমণ দূর করতেও অ্যালোভেরা খুবই উপকারী। নিয়মিত অ্যালোভেরার জুস পান করলে রক্তের পস্নাটিলেট বাড়ে।

৫. ডালিম ফলে প্রচুর আয়রন রয়েছে। যা রক্তে পস্নাটিলেট বাড়াতে এবং শরীরের দুর্বলতা দূর করতে খুবই ভালো কাজ করে। তাই রোগীর রক্তে পস্নাটিলেট বাড়াতে তাকে নিয়মিত ডালিমের জুস খেতে দিন।

মালয়েশিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজির এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পেঁপে পাতার রস এবং পাকা পেঁপের জুস ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর রক্তে কমে যাওয়ার পস্নাটিলেটের পরিমাণ দ্রম্নত বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

সবুজ শাকসবজি, ভিটামিন সি যুক্ত ফল বা তাজা ফলের রস, সেইসঙ্গে ভিটামিন বি কমপেস্নক্স, প্রোটিন, ভিটামিন কে, ই সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে প্যাকেটজাত খাবার এবং অতিরিক্ত মসলাদার খাবার এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে