সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

শীতে নিয়ন্ত্রণে রাখুন ডায়াবেটিস

শরীরে যখন পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি হয় না বা কোষীয় বিপাকে ইনসুলিনের ইউটিলাইজেশন বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন রক্তে অত্যধিক গস্নুকোজ থেকে যায়। যা পরবর্তীতে হৃদরোগ, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস এবং কিডনি রোগের মতো গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল
  ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

ডায়াবেটিস এমন একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ যা আমাদের গ্রহণ করা খাবারকে শক্তিতে রূপান্তর হতে প্রভাবিত করে। আমরা দৈনন্দিন যেসব খাবার খাই তার বেশিরভাগ খাবার গস্নুকোজে রূপান্তরিত হয়ে রক্তে মিশে যায়। যখন রক্তে গস্নুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ হতে ইনসুলিন নিঃসৃত হয় এবং গস্নুকোজকে শক্তিতে রূপান্তর করতে ট্রিগারের মতো কাজ করে। ডায়াবেটিস তখনই বলা হয় যখন শরীরে পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি হয় না বা ইনসুলিন তৈরি হলেও নানা কারণে শরীর তা ব্যবহার করতে পারে না। শরীরে যখন পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি হয় না বা কোষীয় বিপাকে ইনসুলিনের ইউটিলাইজেশন বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন রক্তে অত্যধিক গস্নুকোজ থেকে যায়। যা পরবর্তীতে হৃদরোগ, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস এবং কিডনি রোগের মতো গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। ডায়াবেটিসের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিকার ব্যবস্থা নেই, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ গ্রহণ, ওজন কমানো, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত থাকে।

ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ

ডায়াবেটিস সাধারণত তিন প্রকার : টাইপ-১, টাইপ-২ এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (গর্ভাবস্থায় যে ডায়াবেটিস হয়)।

টাইপ-১ ডায়াবেটিস :

টাইপ-১ ডায়াবেটিস একটি অটোইমিউন প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় শরীরে কোনো ইনসুলিন তৈরি হয় না। ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ০৫-১০ % লোকের টাইপ-১ ডায়াবেটিস আছে। টাইপ-১ ডায়াবেটিস জন্মগত হলেও যে কোনো বয়সে হতে পারে। টাইপ-১ ডায়াবেটিস প্রতিরোধের উপায় এখনো অজানা। তাই টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীকে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন ইনসুলিন নিতে হয়।

টাইপ-২ ডায়াবেটিস :

টাইপ-২ ডায়াবেটিসে শরীর ঠিক মতো ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না এবং রক্তে গস্নুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর প্রায় ৯০-৯৫% লোকের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রয়েছে। এটি বহু বছর ধরে বিকাশ লাভ করে এবং সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে নির্ণয় করা হয় (কিন্তু শিশু, কিশোর এবং অল্প বয়স্কদের মধ্যে বেশি পাওয়া যায়)। অনেক সময় কোনো উপসর্গ নাও থাকতে পারে, তাই যদি কেউ ঝুঁকিতে থাকেন তাদের নিয়মিত রক্তে গস্নুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ যোগ্য।

গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস :

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে দেখা যায়, যাদের গর্ভ ধারণের পূর্বে কখনো ডায়াবেটিস হয়নি। যদি কারো গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়ে থাকে তবে তার গর্ভের শিশুর উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সাধারণত শিশুর জন্মের পরে আপনা আপনি ভালো হয়ে গেলেও এটি পরবর্তী জীবনে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ধরনের শিশুর শিশু বা কিশোর বয়সে স্থূলতা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং পরবর্তী জীবনে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

প্রি-ডায়াবেটিস :

বর্তমানে বিশ্বে প্রতি ৩ জনের মধ্যে ১ জনেরও বেশি প্রি-ডায়াবেটিস কন্ডিশনে রয়েছে যাদের ১০ জনের মধ্যে ৮ জনের বেশি জানে না যে, তারা এই কন্ডিশনে আছে। প্রি-ডায়াবেটিস কন্ডিশনে রক্তে গস্নুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, কিন্তু টাইপ-২ ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য যথেষ্ট প্রমানক থাকে না। প্রি-ডায়াবেটিস কন্ডিশন সাধারণত টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

শীতকালে ঠান্ডা আবহাওয়া বস্নাড সুগার বাড়াতে পারে :

ঠান্ডা তাপমাত্রা শরীরের স্ট্রেস বাড়িয়ে দেয়। ফলে শরীরে কর্টিসলের মতো স্ট্রেস হরমোন বেড়ে যায়। এই হরমোনগুলো ইনসুলিনের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। যেহেতু ইনসুলিন শরীরের কোষগুলোকে রক্তের গস্নুকোজ (বস্নাড সুগার) শোষণ করতে সাহায্য করে, তাই কম ইনসুলিন থাকা মানে রক্তে গস্নুকোজের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি স্ট্রেস হরমোনগুলো লিভারকে অধিক মাত্রায় গস্নুকোজ তৈরি করতে এবং তা রক্তে মুক্ত করতে উদ্দীপিত করে। ফলস্বরূপ রক্তে গস্নুকোজ বা শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়।

ইনফ্লুয়েঞ্জার (ফ্লু) প্রকোপ প্রায়ই অক্টোবরে বাড়তে শুরু করে এবং ডিসেম্বর থেকে ফেব্রম্নয়ারির মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। ফ্লু হওয়ায় শরীর তার নিজের শক্তি বাড়াতে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করতে ট্রিগার করতে পারে, ফলে রক্তে গস্নুকোজ বা শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়।

শীতের মাসগুলো সাধারণত ছুটির মৌসুম। পার্টি, পারিবারিক ভোজ এবং উপহারের ঝুড়িতে উচ্চ-ক্যালোরিযুক্ত খাবারের কারণে খাবারের তালিকায় পরিকল্পনাকে ব্যাহত করে। তাছাড়া বাইরের ঠান্ডা আবহাওয়া আমাদের একরকম গৃহবন্দি করে রাখে। খাদ্যাভ্যাস এবং কার্যকলাপের পরিকল্পনায় ব্যাঘাত রক্তে শর্করাকে বাড়িয়ে দিতে পারে।

শীতে যেভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখবেন :

প্রায়ই অসুস্থ হলে বা রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে নিয়মিত বস্নাড গস্নুকোজ চেক করতে হবে। শীতকালে রক্তের গস্নুকোজ পরীক্ষা করা অনেকের পক্ষে কঠিন হতে পারে। কারণ শীতে হাত ঠান্ডা হয়ে যায়, যা পরীক্ষার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। পরীক্ষা করার আগে একটি হিটারের কাছে বা এক কাপ গরম পানির চারপাশে হাত রেখে গরম করে নিতে হবে যাতে একটি পাফেক্ট রেজাল্ট পাওয়া যায়।

সব সময় উষ্ণ পরিবেশের মধ্যে থাকতে হবে। তবে বৈদু্যতিক কম্বল, হিটিং প্যাড বা ফুট ওয়ার্মার ব্যবহার করার সময় অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নয়তো বেশি হিটে ত্বক পুড়ে যেতে পারে।

প্রতি বছর শীতের সময় ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমন বেশি হয়। এ জন্য ফ্লু টিকা নিতে হবে। যদি ফ্লুতে আক্রান্ত হন এই টিকা অসুস্থতার তীব্রতা কমাতে পারে।

প্রতিদিন ত্বক এবং পায়ের যত্ন নিতে হবে। ঠান্ডা আবহাওয়া, শুষ্ক বাতাস, ইনডোর এবং কার হিটার ত্বককে শুষ্ক করে দেয়। ত্বকের শুষ্কতা, ত্বকের চুলকানি ইত্যাদি কারণে ত্বক ফেটে যেতে পারে। এই সুযোগে জীবাণু ফাটা অংশে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। ত্বক এবং পায়ের প্রতি গভীর মনোযোগী হতে হবে যাতে তাড়াতাড়ি সমস্যাগুলো লক্ষ্য করা যায় এবং তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা গ্রহণ করা যায়।

দৈনন্দিন রুটিনে ইনডোর ব্যায়াম যোগ করতে হবে। পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এটিকে মজাদার করা যেতে পারে।

যা-ই রান্না হোক না কেন ট্র্যাকে থাকতে হবে। খাবারের সময় কার্বোহাইড্রেট কমানোর পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের চেষ্টা করতে হবে।

ওষুধের যথেষ্ট জোগান নিশ্চিত করা এবং সরঞ্জামগুলোকে প্রচন্ড ঠান্ডা থেকে দূরে রাখতে হবে। ইনসুলিন তাপমাত্রার প্রতি সংবেদনশীল। এটিকে রুম তাপমাত্রায় রাখতে হবে। ইনসুলিন প্রায় ৩২০ফা. (০০ সে.) এ হিমায়িত হয় এবং হিমায়িত ইনসুলিন কার্যকারিতা হারায়, এমনকি গলে গেলেও।

একটি ব্যাকআপ কিট রেডি রাখতে হবে। ডায়াবেটিস কেয়ার কিট থাকলে জরুরি সময়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করবে।

ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা

নীলফামারী সদর, নীলফামারী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে